সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/আলিনগরের সন্ধি

উইকিসংকলন থেকে

একবিংশ পরিচ্ছেদ।

আলিনগরের সন্ধি।

 মুসলমান ইতিহাস-লেখক সাইয়েদ গোলাম হোসেন লিখিয়া গিয়াছেন যে, “ইংরাজেরা যখন হুগলী লুণ্ঠনে অবসরশূন্য, ঠিক সেই সময়ে বিলাত হইতে সংবাদ পাইলেন যে, এদেশে ফরাসীদিগের সঙ্গে আবার সমরকলহ উপস্থিত হইয়াছে। ইংরাজ এবং ফরাসী শান্তভাবে জীবনধারণ করিতে শিখিল না! ইহাদের মধ্যে পাঁচ ছয় শত বৎসর কেবল যুদ্ধকলহ চলিয়া আসিতেছে। কখন কখন রণশ্রান্ত হইলে পরামর্শ করিয়া হাঁপ ছাড়িবার জন্য উভয়েই কিছুদিনের মত সন্ধিসংস্থাপন করে; কিন্তু কিছুদিন বিশ্রামলাভ করিয়াই পুনরায় সমর-পিপাসায় উন্মত্ত হইয়া উঠে!”[১]

 আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন ইংরাজদিগের মত ফরাসীরাও ভারতবর্ষে ধীরে ধীরে বাহুবল সুবিস্তৃত করিতেছিলেন। তাঁহারা বাণিজ্যোপলক্ষে বাঙ্গালাদেশে তিনশত গোরা এবং অনেকগুলি সুশিক্ষিত গোলন্দাজ রাখিতেন। এদেশের লোকের নিকট ইংরাজ অপেক্ষা ফরাসীরাই বীরকীর্ত্তির জন্য সমধিক সুপরিচিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। স্বদেশে ফরাসীজাতির সহিত সমর-কোলাহল উপস্থিত হওয়ায়, ইংরাজদিগের অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠিল। চিরশত্রু ফরাসীসেনার সঙ্গে নবাবের সেনাদল মিলিত হইলে, ইংরাজের সর্ব্বনাশ হইতে কতক্ষণ? ক্লাইব তাহা বুঝিতেন। তিনি বিলাতের সংবাদ পাইবামাত্র শিহরিয়া উঠিলেন, এবং এই দুঃসময়ে সহসা গায়ে পড়িয়া সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে কলহের সূত্রপাত করিয়া যে সমূহ অমঙ্গল আহ্বান করিয়া আনিয়াছেন, তাহা ভাবিয়া ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন।[২] তাড়াতাড়ি উমিচাঁদ এবং জগৎশেঠের শরণাগত হইয়া কিংকর্ত্তব্য অবধারণ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এদিকে অকস্মাৎ হুগলী লুণ্ঠনের সমাচার শুনিয়া সিরাজদ্দৌলা ক্রোধোন্মত্তহৃদয়ে কলিকাতাভিমুখে সসৈন্যে অগ্রসর হইতেছেন; ইংরাজগণ সন্ধির জন্য ব্যাকুল হইলে কি হইবে? নবাব কি আর সন্ধির প্রস্তাবে কর্ণপাত করিবেন? সকলেই বলিতে লাগিলেন যে, এতদিনে ইংরাজের পাপের ভরা পূর্ণ হইয়া আসিল।[৩] সিরাজদ্দৌলা ‘নরশোণিতলোলুপ নৃশংস নরপতি’ হইলে তাহাই হইত। কিন্তু তিনি অগ্রপশ্চাৎ বিচার করিয়া শান্তি সংস্থাপনের জন্যই সমধিক আগ্রহ প্রকাশ করিলেন। কর্ণেল ক্লাইব নিজেই স্পষ্টাক্ষরে স্বীকার করিয়াগিয়াছেন যে, সন্ধির জন্য তাঁহাকে সবিশেষ উদ্বেগ পাইতে হয় নাই;—স্বয়ং সিরাজদ্দৌলাই সর্ব্বাগ্রে সন্ধির প্রস্তাব উপস্থিত করিয়া সকল আশঙ্কা নিবারণ করিয়াছিলেন।[৪]

 সিরাজদ্দৌলা সন্ধির প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন কেন? ইংরাজের সঙ্গে সন্ধি,—সে ত কেবল বালির বাঁধে সমুদ্রতরঙ্গের গতিরোধ করিবার নিস্ফল প্রয়াস! যদি সত্যসত্যই সন্ধি সংস্থাপিত হয়, তথাপি কয়দিন তাহার মর্য্যাদা রক্ষিত হইবে? স্বদেশের নিকটতম প্রতিবাসীর সঙ্গে যাঁহাদিগের কলহবিবাদ ছয়শত বৎসরেও শান্তিলাভ করিল না, বিদেশে তাঁহাদিগের ধর্ম্মপ্রতিজ্ঞা কয়দিন প্রতিপালিত হইবে? সন্ধিপত্র ত কেবল ইংরাজের মুখের কথা;—তাঁহাদের কথায় বিশ্বাস কি? এই ত সেদিন তাঁহারা বিপদে পড়িয়া সন্ধির প্রস্তাব তুলিয়াছিলেন; কিন্তু সেকথা পুরাতন না হইতেই লুণ্ঠনলোভে হুগলীর কিরূপ সর্ব্বনাশ করিয়া আসিয়াছেন! সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়াও ক্ষুৎক্ষামোদর পূর্ণ হয় নাই, কত বহুমূল্য অট্টালিকা ভূমিসাৎ হইয়াছে, কত নিরন্ন কাঙ্গালকুটীর দগ্ধ হইয়া গিয়াছে, হুগলীর ইতিহাসবিখ্যাত, সমৃদ্ধজনপদ শ্মশানভস্মে পরিণত হইয়াছে! আজ না হয় আবার ফরাসী-সমর-শঙ্কায় চিন্তাকুলহৃদয়ে খৃষ্টীয়ান ইংরাজ নিতান্ত নিরীহ-স্বভাব মেষশাবকের ন্যায় করুণকণ্ঠে “শান্তিঃ শান্তিঃ” বলিয়া কাতর ক্রন্দনে নবাব-দরবারের শরণাপন্ন হইয়াছেন; কিন্তু সময় পাইলেই তাঁহারা যে আবার সিংহমূর্তি ধারণ করিবেন না, তাহার প্রমাণ কি?

 যদিও অনেকে এই সকল কথা উপস্থিত করিয়া সন্ধির প্রস্তাবে বাধা দিবার আয়োজন করিতে ক্রটি করিলেন না, তথাপি সিরাজদ্দৌলা সে সকল কথায় কর্ণপাত করিলেন না। তিনি কলিকাতায় শিবির-সংস্থাপন করিয়াই সন্ধিপত্র নির্দ্ধারণ করিবার জন্য ইংরাজদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলেন। সিরাজদ্দৌলা কি ইংরাজ-ভয়ে ভীত হইয়াই সন্ধির জন্য এরূপ ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন? কেহ কেহ বলেন যে, তাহাই একমাত্র কারণ। কিন্তু ইংরাজেরা তৎকালে যেরূপ বিপদবেষ্টিত, তাহাতে ভীত হইবার কারণ ছিল না;—তাহাদের সেনাবল অল্প; তাহারও কিয়দংশ বঙ্গোপসাগরে তরঙ্গতাড়িত হইয়া কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে; যাহারা বঙ্গদেশে পদার্পণ করিয়াছিল, তাহারাও সকলে জীবিত নাই; আর যাহারা জীবিত, বাঙ্গালার জলবায়ু অল্পদিনের মধ্যই তাহাদিগকে জীবন্মৃত করিয়া ফেলিয়াছে। মহাবীর ক্লাইব সিরাজসেনার গতিরোধ করিতে গিয়া নিজেই পলায়ন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন![৫] সুতরাং ইহাদের ভয়ে ভীত হইবার কারণ ছিল না;—তথাপি সিরাজদ্দৌলা সন্ধির জন্য ব্যাকুল হইয়াছিলেন কেন?

 সিরাজদ্দৌলা ইংরাজদিগকে ভাল মানুষ বলিয়া বিশ্বাস করিতেন না, তাঁহার বাল্যসংস্কারের সহিত যৌবনের অভিজ্ঞতা মিলিত হইয়া তাঁহাকে বুঝাইয়া দিয়াছিল যে, ইংরাজদমন করিতে না পারিলে সিংহাসন নিষ্কণ্টক হইবে না। নবাব আলিবর্দ্দীও অন্তিম সময়ে তাহাই বুঝাইয়া দিয়াছিলেন। সিরাজদ্দৌলা সে কথার ক্রমশঃ পরিচয় পাইতে লাগিলেন, এবং দিব্যনেত্রে ইংরাজের কীর্ত্তিকলাপ পর্য্যবেক্ষণ করিয়া আতঙ্কযুক্ত হইলেন। আজ হুগলী বিপর্য্যস্ত হইল, কাল হয়ত অন্য কোন স্থান বিধ্বস্ত হইবে। সিরাজ দেখিলেন যে, ইংরাজেরা দ্বিতীয় বর্গীর হাঙ্গামার সূত্রপাত করিবে;—কত সম্পন্ন জনপদ শ্মশান হইবে, কত নিরীহ নাগরিক হাহাকার করিবে;—কত রুধিরকর্দ্দমে বঙ্গভূমি কলঙ্কিত হইবে; এবং এত করিয়াও একদিনের জন্য শান্তিসুখ উপভোগ করিবার অবসর ঘটিবে না! ইংরাজদিগকে বশীভূত করিবার দুইটিমাত্র সদুপায়;—হয় শত্রুতাসাধনে, না হয় মিত্রবন্ধনে; হয় করাল কৃপাণমুখে, না হয় লেখনীসাহায্যে। আলিবর্দ্দীর অন্তিম উপদেশ স্মরণ করিয়া শত্রুতাসাধন করিয়া দেখিলেন;—তাহাতে হিতে বিপরীত হইল। ইংরাজদমন হইল না; বরং চিরশত্রুতার সূত্রপাত হইল। সুতরাং মিত্রতা-বন্ধনে ইংরাজদিগকে বশীভূত করিবার জন্যই সিরাজদ্দৌলা ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। ইহাতে তাঁহার প্রজাহিতৈষণা ও তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচয় পাইয়া কুচক্রী মন্ত্রিদল তাঁহার প্রস্তাবে নানা প্রকারে বাধা প্রদান করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 নওয়াজেস মোহম্মদ এবং শওকতজঙ্গের পরলোকগমনে কুচক্রিদলের সকল আশাই নির্ম্মূল হইয়াছিল। ইংরাজ একমাত্র শেষ সম্বল। তাঁহারা যদি সিরাজের সঙ্গে মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ হইবার অবসর প্রাপ্ত হন, তাহ হইলে সিরাজ নিশ্চিন্ত হইবেন। তাহাতে দেশের কল্যাণ, কিন্তু দুষ্টদলের সর্ব্বনাশ। নবাব এত দিন বিপদবেষ্টিত বলিয়াই তাঁহারা বাঁচিয়া রহিয়াছেন। সুতরাং তাঁহাকে নিশ্চিন্ত হইবার অবসর প্রদান করিতে কাহারও সাহস হইল না। ইংরাজের সঙ্গে চিরশত্রুতা সঞ্জীবিত রাখিয়া সিরাজদ্দৌলাকে সর্ব্বদা সশঙ্কিত রাখিবার জন্যই সন্ধির প্রস্তাবের প্রতিবাদ আরম্ভ হইল। কিন্তু সিরাজদ্দৌলা আর কাহারও কথায় কর্ণপাত করিতে সম্মত হইলেন না।

 ইংরাজেরা সন্ধির জন্য ব্যাকুল; সিরাজদ্দৌলাও সন্ধির জন্য লালায়িত! এ সন্ধির গতিরোধ করিবে কে? তখন কুচক্রীদলের কুমন্ত্রণা আরম্ভ হইল। প্রকাশ্য প্রতিবাদে পরাজিত হইয়া অপ্রকাশ্য কৌশলবলে সিরাজদ্দৌলার শান্তি-পিপাসার গতিরোধ করিবার আয়োজন হইল!

 সেকালের কলিকাতা সহরে বণিকরাজ উমাচরণের রাজবাটীই সর্ব্বাপেক্ষা পরম রমণীয় স্থান বলিয়া সুপরিচিত ছিল। সুতরাং তাঁহার দীপালোকবিভূষিত সুসজ্জিত পুষ্পোদ্যানেই সিরাজদ্দৌলার দরবার বসিল। চারিদিকে গর্ব্বোন্নতমস্তকে সশস্ত্র সেনাপতিগণ দণ্ডায়মান,—যথাযোগ্য রাজপরিচ্ছদে সুশোভিত হইয়া অমাত্যদল যথাস্থানে করজোড়ে উপবেশন করিয়াছেন,—মধ্যস্থলে সিংহাসন, তাহার উপর সুবিস্তৃত মসনদ, কনকদণ্ডের উপর বিবিধ রত্নরাজি-বিজড়িত বিচিত্র চন্দ্রাতপ,—সেই স্বর্ণসিংহাসন উজ্জ্বল করিয়া সিরাজদ্দৌলার যৌবনোন্নত সুকুমার দেহকান্তি সদ্যোজাত প্রফুল্ল চম্পকের ন্যায় ফুটিয়া উঠিয়াছে;—ইংরাজ-প্রতিনিধি ওয়ালস্ এবং স্ক্রাফ্‌টন্ দরবারে পদার্পণ করিয়া সিরাজদ্দৌলার সৌভাগ্যগর্ব্বের ফলিতজ্যোতিতে স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন![৬] এই রত্ন-সিংহাসন যাঁহার পাদপীঠ, এই সুশিক্ষিত দৃঢ়োন্নত বীরমণ্ডলী যাঁহার সেনানায়ক, এই বিবিধ বিদ্যাবিশারদ মন্ত্রিদল যাঁহার মন্ত্রণাসহায়, এই বিভবচ্ছটা যাঁহার রত্নমুকুট সমুজ্জ্বল করিয়া রাখিয়াছে,—সর্ব্বনাশ! ইংরাজবণিক কোন্ সাহসে তাঁহার সহিত শক্তিপরীক্ষা করিতে অগ্রসর হইয়াছেন? কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তাঁহাদিগের মনে হইল, এ সকল বুঝি ইন্দ্রজাল! এ সকল বুঝি কেবলমাত্র ইংরাজদিগকে ভয় দেখাইবার বাহ্যাড়ম্বর! তখন তাঁহারা সাহসে বুক বাঁধিয়া ধীরে ধীরে সিংহাসনের দিকে অগ্রসর হইয়া সসস্ত্রমে ‘কুর্ণিশ’ করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন।

 সিরাজদ্দৌলা তাঁহাদিগকে যথাযোগ্য সাদরসম্ভাষণে কুশল জিজ্ঞাসা করিয়া বুঝাইয়া দিলেন যে, সন্ধিসংস্থাপন করিবার জন্যই তিনি সশরীরে এতদূর অগ্রসর হইয়াছেন। ইংরাজেরা বলিলেন যে, তাঁহারাও সন্ধির জন্য লালায়িত হইয়াছেন; যুদ্ধকলহে তাঁহাদিগের বাণিজ্যবিস্তারে বিঘ্ন ঘটিতেছে। সিরাজদ্দৌলা তখন ইংরাজদিগকে সন্ধিপত্র নির্দ্ধারণ করিবার জন্য দেওয়ানের পটমণ্ডপে পাঠাইয়া দিয়া স্বয়ং বিশ্রামভবনে গমন করিলেন।

 ইংরাজদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল। তাঁহারা সহাস্যবদনে অভিবাদন করিয়া বিদায়গ্রহণ করিলেন। কিন্তু কুচক্রী-মন্ত্রিদলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল না। তাঁহারা সুকৌশলে সন্ধির প্রস্তাব চূর্ণ করিবার আয়োজন করিতে লাগিলেন।

 যে দুইজন ইংরাজ রাজপুরুষ প্রতিনিধি সাজিয়া, হাতিয়ার বাঁধিয়া, নবাব-দরবারে উপনীত হইয়াছিলেন, তাঁহারা কুঠিয়াল সিবিলিয়ান;—সিরাজদ্দৌলার নামে তাঁহাদের অন্তরাত্মা সহজেই কাঁপিয়া উঠিত। মন্ত্রিদল অনন্যোপায় হইয়া, এই ইংরাজযুগলের মনে সহসা ভয়ের সঞ্চার করিয়া কার্য্যোদ্ধারের আয়োজন করিলেন!

 ইংরাজেরা দরবার হইতে বাহির হইবামাত্র সুচতুর উমাচরণ আসিয়া ধীরে ধীরে তাঁহাদের কাণে কাণে নিতান্ত পরমাত্মীয়ের ন্যায় বলিতে লাগিলেন,—“দেখিতেছ কি? প্রাণ বাঁচাইতে চাহ ত এখনই পলায়ন কর। সন্ধির প্রস্তাবে নিশ্চিন্ত হইয়াছ? এ সন্ধি নহে;—ইহা কেবল কালহরণের কুটিল কৌশল। নবাবের সেনাদল আসিয়াছে, কিন্তু কামানগুলি এখনও পশ্চাতে পড়িয়া রহিয়াছে; সেইজন্য তোমাদিগকে সন্ধির কথা উঠাইয়া প্রতারিত করিতেছে। কামান আসিলে আর এক মুহূর্ত্তও বিলম্ব হইবে না। তোমরা কয়জন? সিরাজদ্দৌলার সেনাতরঙ্গের সম্মুখে কতক্ষণ দাঁড়াইতে পারিবে?” ইংরাজদ্বয়ের হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। কি সর্ব্বনাশ! এই সাদর-সম্ভাষণ, এই সন্ধির শান্তি-সূচনা, সকলই কেবল কালহরণের কুটিল কৌশল? এখন উপায় কি? মুখের ভাব দেখিয়া উমাচরণ বুঝিলেন যে,—ঔষধ ধরিয়াছে! তিনি অবসর পাইয়া বলিয়া উঠিলেন, “আর উপায় কি? দেওয়ানের পটমণ্ডপে গমন করিলেই বন্দী হইতে হইবে। এখনও সাবধান হও। মশাল নিভাইয়া দিয়া আঁধারে আঁধারে দুর্গমধ্যে পলায়ন কর।” যে কথা সেই কাজ;—ইংরাজেরা আর মুহুর্ত্তমাত্র বিলম্ব করিলেন না।[৭] কিন্তু কেহই ভাবিয়া দেখিলেন না যে, সিরাজদ্দৌলা কি কামান না লইয়া রিক্তহস্তে এতদূর অগ্রসর হইয়াছেন?

 সিরাজদ্দৌলা এই কুটিল চক্রান্তের বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিলেন না; কিন্তু সে রজনীতে ইংরাজ-শিবিরে একজনও ঘুমাইবার অবসর পাইল না। ক্লাইব তপ্তাঙ্গারের ন্যায় প্রদীপ্ত প্রতাপে ওয়াট সনের নিকট ছুটিয়া চলিলেন; তাঁহার নিকট হইতে ছয়শত জাহাজী গোরা চাহিয়া লইয়া আপন পদাতিক সেনার সহিত সম্মিলিত করিলেন; এবং রজনী তিন ঘটিকার সময়ে নিঃশব্দপদসঞ্চারে সসৈন্যে নবাব-শিবির আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইলেন। নবাবশিবির ৬০০০০ সিপাহী এবং ১৮০০০ অশ্বারোহী ৪০টি কামান লইয়া নিরুদ্বেগে নিদ্রাময়;—তাহারা জাগিয়া উঠিলে যে ইংরাজের কি সর্ব্বনাশ ঘটিবে, ক্লাইব তাহা চিন্তা করিবার অবসর পাইলেন না।

 একে নিশাকাল, তাহাতে নিদারুণ শীত। সকলেই নিঃশব্দ নিঝুম। সেই নৈশ নীরবতা আলোড়ন করিয়া ইংরাজের কামান গুলি ভীম কলরবে গর্জ্জন করিয়া উঠিল! গুড়ুম-গুড়ুম— গুম্; গুড়ুম—গুড়ুম-গুম, গুড়ুম-গুড়ুম-গুম্;—ইংরাজের কামান ঘন ঘন ডাকিতে লাগিল, গুড়ুম-গুড়ুম-গুম্। সহসা সুপ্তোত্থিত হইয়া সিপাহীসেনা কামান গর্জ্জনের কারণ বুঝিতে পারিল না! তাহারা তুমুল কোলাহলে নবাব-শিবির আকুল করিয়া তুলিল; এবং যে যেখানে ছিল, হাতিয়ার বাঁধিয়া, মশাল জ্বালাইয়া, কামানের নিকটে দাঁড়াইতে লাগিল। তখন নবাব-শিবিরের কামানগুলিও প্রচণ্ড বিক্রমে অনলবর্ষণ করিতে ক্রটি করিল না!

 সিরাজদ্দৌল্লা গাত্রোথান করিলেন। প্রভাত হইলেও ভাল করিয়া দৃষ্টিসঞ্চালনের উপায় হইল না;—ঘন ঘনাকারে ধূমপুঞ্জ দিঙ্মণ্ডল আবরণ করিয়া ফেলিয়াছে, তাহার উপর কুজ্‌ঝটিকায় চারিদিক্‌ সমাচ্ছন্ন; নিকটে কি দূরে কোনদিকেই নয়নসঞ্চালনের সুবিধা নাই। কেবল থাকিয়া থাকিয়া উভয় পক্ষের কামানগুলি কড়্‌ কড়্‌ করিয়া উঠিতেছে; আর মধ্যে মধ্যে আহতের আর্ত্তনাদে চারিদিক আকুল করিয়া তুলিতেছে! সকলেই বুঝিল যে, লড়াই বাধিয়াছে;—কিন্তু সহসা লড়াই বাধিবার কারণ কি, সে কথা কেহই বুঝাইতে পারিল না।

 ৭টা বাজিয়া গেল। তথাপি সেই কুজ্‌ঝটিকা, তথাপি সেই ধূমপুঞ্জ, তথাপি সেই কামানগর্জ্জন। কে কোথায় ছিটাইয়া পড়িয়াছে;—শত্রু নিকটে কি দূরে, কিছুই বুঝা যাইতেছে না; কেবল শব্দ লক্ষ্য করিয়া মুসলমানেরা কামানে অগ্নিসংযোগ করিতেছে, আর প্রদীপ্ত লৌহপিণ্ডরাশি তীব্রতেজে ছুটিয়া বাহির হইতেছে। যখন দিবালোক প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিল, তখন সকলেই সবিস্ময়ে চাহিয়া দেখিলেন যে, ক্লাইবের সমর-পিপাসা শান্ত হইয়াছে, তাঁহার গর্ব্বোন্নত গোরাসৈন্য দূরপথে হেটমুণ্ডে দুর্গাভিমুখে পলায়ন করিতেছে; আর মুসলমান-অশ্বসেনা তাহাদের পশ্চাতে পশ্চাতে ঘোড়া ছুটাইয়া ধাবিত হইতেছে। ইংরাজদিগের দুইটি কামান মুসলমানেরা কাড়িয়া লইয়াছে; এখানে, ওখানে, সেখানে, চারিদিকে ইংরাজসেনার বীরমুণ্ড রুধিরকর্দমে ধরাবিলুণ্ঠিত হইতেছে।[৮]

 ইংরাজের সর্ব্বনাশ হইয়াছে! একে সামান্য সেনাবল লইয়া ক্লাইব এবং ওয়াট্‌সন বঙ্গদেশে শুভাগমন করিয়াছিলেন; তাহাতে ক্লাইবের অবিমৃষ্যকারিতায় একদিনেই ১২০ জন ইংরাজ ধরাশায়ী হইয়াছে, এবং শতাধিক সিপাহীসেনা কালকবলে নিপতিত হইয়াছে![৯] নবাব-শিবিরেও হাহাকার পড়িয়া গিয়াছে; কত হতভাগা আর নিদ্রাভঙ্গে উঠিয়া বসিবার অবসর পায় নাই; কত সিপাহী শত্রুমিত্রের যুগপৎ অনলবর্ষণে ভস্মীভূত হইয়া গিয়াছে!

 সহসা এই যুদ্ধকোলাহল উপস্থিত হইল কেন? সিরাজদ্দৌলা হার কারণানুসন্ধান করিতে বসিয়া মন্ত্রিদলের মন্ত্রণার বাহাদুরী বুঝিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। মীরজাফরের ব্যবহার দেখিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন যে, তিনিও সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত নহেন।[১০] এই সেনাপতি, এই প্রভুভক্ত মন্ত্রিদল লইয়া ইংরাজের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে সাহস হইল না; সিরাজদ্দৌলা নিরাপদ স্থানে সরিয়া গিয়া শিবিরসন্নিবেশ করিলেন, এবং তাড়াতাড়ি সন্ধিসংস্থাপনের জন্য ইংরাজদিগকে ডাকিয়া পাঠাইলেন।

 যে সিরাজদ্দৌলা আবাল্য ইংরাজদলনে কৃতসংকল্প, তিনিই যে আবার সন্ধির জন্য সরলভাবে লালায়িত হইয়াছেন, ইংরাজেরা সে কথায় সহসা বিশ্বাসস্থাপন করিতে পারিলেন না। ক্লাইব রণভীত হইয়া সন্ধির জন্য ব্যাকুল; কিন্তু ওয়াট্‌সন্‌ তাঁহাকে সাবধান করিবার জন্য পত্র লিখিয়া পাঠাইলেন।[১১]

 ক্লাইব কিন্তু ওয়াট্‌সনের পরামর্শে কর্ণপাত করিলেন না। মন্ত্রিদলের কুমন্ত্রণার সন্ধান পাইয়া সিরাজদ্দৌলা সন্ধির জন্য এতদূর ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন যে, ক্লাইব যাহা চাহিলেন, তিনি তাহাতেই সম্মত হইয়া, ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ৭ই ফেব্রুয়ারী সন্ধিপত্র সুস্থির করিয়া ফেলিলেন। ইংরাজদিগের অনুরোধ রক্ষার জন্য মীরজাফর এবং রায় দুর্লভকেও এই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিতে হইল। ইতিহাসে ইহারই নাম, ‘আলিনগরের সন্ধিপত্র’।

 এই সন্ধিসূত্রে ইংরাজবণিক বাদশাহী ফরমাণের লিখিত সমুদায় বাণিজ্যধিকার পুনঃপ্রাপ্ত হইলেন। কলিকাতার দুর্গ সংস্কারের অনুমতি প্রদত্ত হইল; কলিকাতায় টাকশাল বসাইয়া বাদশাহের নামে সিক্কা টাকা মুদ্রিত করিবার অধিকার প্রদত্ত হইল; এবং কলিকাতা লুণ্ঠন সময়ে ইংরাজদিগের যাহা কিছু ক্ষতি হইয়া থাকে, সিরাজদ্দৌলা তাহাও পূরণ করিবার জন্য সম্মতিদান করিলেন।

  1. Mustafa's Mutakherin, I. 759.
  2. Thornton's History of the British Empire, vol. I, 208.
  3. The English were now very desirous to make their peace with that formidable ruler; but the capture of Hoogly, undertaken solely with a view to plunder, had so augmented his rage that he was not in a frame of mind to receive from them any proposition.—Mill, vol. II. 157.
  4. According to Orme (vol. II. 129) it was Clive who proposed negotiations.—Clive himself represented the overture as coming from the Subadhar —Thornton's History of the British Empire, vol. 1. 209.
  5. Colonel Clive marched with the greatest part of his troops, and six field pieces; as they approached, the enemy fired upon them from nine pieces of cannon, and several bodies of their cavalry drew up on each side of the garden, of which the attack appeared so hazardous, that Clive restrained the action to a connonade, which continued only an hour that the troops might regain the camp before dark.—Orme, ii. 130.
  6. February 4, 1757. at seven in the evening, the Subah gave them audience in Omichund's garden, where he affected to appear in great state, attended by the best-looking men amongst his officers, hoping to intimidate them by so warlike an assembly.—Scrafton's Reflections,
  7. Orme, ii, 131.
  8. অর্ম্মিলিখিত ইতিহাসে এই নিশারণের আমূল বৃত্তান্ত প্রদত্ত হইয়াছে। পরাজিত ইংরাজ সেনা ইহার জন্য কর্ণেল ক্লাইবকে কিরূপ ভর্ৎসনা করিয়াছিল, তাহাও লিখিত হইয়াছে।
  9. Two Captains of the Company's troops. Pye, and Bridges and Mr. Belcher, the Secretary of Col. Clive, were killed. Orme, ii. 134.
  10. (Serajadowla) discovered some appearance of disaffection in some of his principal officers, particularly in Meer Jaffier, whose conduct in this affair had been very mysterious.—Scrafton's Reflections.
  11. “I am fully convinced that the Nabob's letter was only to amuse us in order to cover his retreat, and gain time till he is reinforced, which may be attended with very fatal consequences. For my own part, I was of opinion that attacking his rear when he was marching off, and forcing him to abandon his cannon, was a most necessary piece of service to bring him to an accommodation; for till he is well thrashed, don't, sir, flatter yourself he will be inclined for peace. Let us, therefore, not be overreached by his politics, but make use of our arms, which will be much more prevalent than any treaties or negotiations.”