সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/সন্ধির পরিণাম!

উইকিসংকলন থেকে

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ।

সন্ধির পরিণাম!

 সন্ধি সংস্থাপিত হইল; কিন্তু ইংরাজের মনের গোল মিটিল না। সিরাজদ্দৌলা মিত্রতাবন্ধন সুদৃঢ় করিবার জন্য ক্লাইব, ওয়াট্‌সন্ এবং ড্রেক সাহেবকে যথাযোগ্য “শিরোপা” পাঠাইয়া দিলেন। সকলেই শিরোপা গ্রহণ করিলেন, ওয়াট্‌সন্ তাহা প্রত্যাখান করিয়া বলিয়া পাঠাইলেন যে, “তিনি ইংলণ্ডেশ্বরের প্রজা; সিরাজদ্দৌলার নিকট শিরোপা লইয়া অধীনতা স্বীকার করিতে পারেন না।”[১]

 আলিনগরের সন্ধি-সুত্রে ইংরাজের অপমান হইল বলিয়া ইংরাজমাত্রেই, ক্লাইবের উপর খড়্গহস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন; যাঁহারা প্রাণরক্ষার জন্য সর্ব্বাগ্রে কলিকাতা ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছিলেন, সময় পাইয়া তাঁহারাই সর্ব্বোচ্চকণ্ঠে ক্লাইবকে ভীরু কাপুরুষ ইত্যাদি সুমিষ্ট সম্বোধনে পরিতৃপ্ত করিতে লাগিলেন! ইহা হইতেই ওয়াট্সন্ বুঝিয়াছিলেন যে, আলিনগরের সন্ধিপত্র বড় অধিকদিন সমাদরলাভ করিবে না; সুতরাং তিনি বোধ হয় “নিমক্হারামী” করিবেন না বলিয়াই শিরোপা গ্রহণ করিতে অসম্মত হইয়াছিলেন।

 উত্তরকালে মহাসভায় সাক্ষ্য দিবার সময়ে লর্ড ক্লাইব বলিয়াছিলেন;— “এই সময়ে তাঁহার সেনাবল দুই সহস্রমাত্র; ফরাসিরা নবাবের পক্ষভুক্ত হইলে সহজেই ইংরাজের সর্ব্বনাশ সংঘটিত হইত। বীরহৃদয়ের উত্তেজনায় জ্ঞানশূন্য হইলে, তিনিও সন্ধির প্রস্তাবে কর্ণপাত করিতেন না; কোম্পানী বাহাদুরের মুখের দিকে চাহিয়া বাণিজ্যরক্ষার জন্যই তাঁহাকে এরূপ (অপমানসূচক) সন্ধি-বন্ধনে সম্মত হইতে হইয়াছিল।”[২]

 যাহা হইবার তাহা হইয়া গিয়াছে; এখন কোনরূপে ফরাসিদিগকে চিরনির্ব্বাসিত করাই ইংরাজদিগের লক্ষ্য হইয়া উঠিল। এ বিষয়ে নবাবের অভিপ্রায় কি, তাহা জানিবার জন্য সকলে ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। সিরাজদ্দৌলা এই প্রস্তাবে একেবারে শিহরিয়া উঠিলেন! ইহাই কি শান্তিপিপাসার পরিচয়? এখনও এক সপ্তাহ অতীত হয় নাই, ইহার মধ্যেই আবার যুদ্ধ?[৩] তিনি নিতান্ত বিরক্ত হইয়া বলিয়া পাঠাইলেন যে, ইংরাজের ন্যায় ফরাসীরাও নবাবের পদাশ্রিত ফিরিঙ্গি বণিক, তিনি কিছুতেই আশ্রিতের সর্ব্বনাশসাধনের সহায়তা করিবেন না। ইংরাজেরা আর বাঙ্‌নিষ্পত্তি না করায়, সিরাজদ্দৌলা নিশ্চিন্তহৃদয়ে কলিকাতা হইতে প্রত্যাগমন করিলেন।

 অগ্রদ্বীপে আসিয়া সিরাজদ্দৌলা সংবাদ পাইলেন যে, তাঁহার অনুপস্থিতির অবসর পাইয়া ইংরাজেরা আবার সিংহমূর্ত্তি ধারণ করিয়াছেন, এবং সঙ্গীনস্কন্ধে চন্দননগর লুণ্ঠন করিবার আয়োজন করিতেছেন। ওয়াট্‌স্‌ সাহেব তাঁহার সঙ্গেই মুরশিদাবাদে যাইতেছিলেন;—তিনি এ সকল কথা একেবারে অস্বীকার করিবার জন্য বিবিধ বিধানে আয়োজন করিতে লাগিলেন। তাঁহার অনুরোধে বণিকরাজ উমিচাঁদ আসিয়া সিরাজদ্দৌলার সমক্ষে ব্রাহ্মণের পাদস্পর্শ করিয়া শপথ করিলেন যে, “ইংরাজেরা কখনও সন্ধিভঙ্গ করিবে না, তাহাদের মত সত্যপ্রিয় জাতি ভূভারতে আর নাই, তাহাদের যে কথা সেই কাজ।”[৪] ঈশ্বরের নামে ধর্ম্মশপথের বলে সিরাজদ্দৌলা বশীভূত হইলেন। তথাপি তিনি ইংরাজদিগকে সাবধান করিবার জন্য ওয়াট্‌সন্‌কে লিখিয়া পাঠাইলেন:—

 “সমুদায় কলহ বিবাদ সমূলে ধ্বংস করিবার জন্যই বাণিজ্যাধিকার পুনঃ প্রদান করিয়া সন্ধিসংস্থাপন করিলাম। তুমিও হাতে স্বাক্ষর করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছ যে, এ দেশে আর যুদ্ধকলহ উপস্থিত করিবে না। কিন্তু আমার বোধ হইতেছে যে, তোমরা বুঝি হুগলীর নিকটস্থ ফরাসীকুঠি আক্রমণ করিয়া শীঘ্রই সমরানল প্রজ্বলিত করিবে। আমার রাজ্যে আবার কলহ সৃষ্টির আয়োজন করিতেছ কেন? ইহা ত সকল দেশেরই সুনীতিবিরুদ্ধ ব্যবহার। তৈমুরলঙ্গের সময় হইতে আজ পর্য্যন্ত ফিরিঙ্গিরা ত এদেশে পরস্পরের মধ্যে কোন দিনই যুদ্ধ কলহ উপস্থিত করিতে পারে নাই? তোমরা রণোন্মুখ হইয়া থাকিলে, আমি আর কি করি? বাদশাহের কর্ত্তব্যপালন ও সম্মানরক্ষার জন্য আমাকে অগত্যা সসৈন্যে ফরাসীপক্ষ অবলম্বন করিতে হইবে। এই ত সেদিন সন্ধি করিয়াছ,—ইহারই মধ্যে আবার যুদ্ধ? মহারাষ্ট্রীয়েরা বহুকাল শান্তিভঙ্গ করিয়াছিল; কিন্তু যেদিন সন্ধি করিল, সে দিন হইতে আর কখন প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করে নাই; ভবিষ্যতেও করিবে বলিয়া বোধ হয় না। ধর্ম্মশপথ পূর্ব্বক সন্ধিসংস্থাপন করতঃ জানিয়া শুনিয়া তদ্বিপরীতাচরণ করা বড়ই গুরুতর অপরাধ। তোমরা সন্ধি করিয়াছ, সন্ধিপালন করিতেই বাধ্য। সাবধান! যেন আমার অধিকারে যুদ্ধ কলহ উপস্থিত না হয়;—আমি যাহা যাহা প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হইবে।[৫]

 পত্র লিখিয়াই সিরাজদ্দৌলা নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন না, তিনি প্রজারক্ষার জন্য মহারাজ নন্দনকুমারের অধীনে হুগলীতে, অগ্রদ্বীপে এবং পলাসিতে সেনাসমাবেশ করিয়া রাজধানীতে শুভাগমন করিলেন।

 রাজধানীতে আসিয়া সংবাদ পাইলেন যে, ইংরাজের সসৈন্যে চন্দননগর আক্রমণ করাই স্থির করিয়াছেন! তখন ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া সিরাজদ্দৌলা পুনরায় ওয়াট্‌সন্কে লিখিলেন—

 “গত কল্য তোমাকে যে পত্র লিখিয়াছি, তাহা বোধ হয় হস্তগত হইয়াছে। সেই পত্র লিখিবার পরেই ফরাসীদিগের উকীলের নিকট অবগত হইলাম যে, তোমরা নাকি চারি পাঁচ খানি অতিরিক্ত যুদ্ধজাহাজ আনাইয়াছ, এবং আরও আনাইবার চেষ্টায় আছ। ইহাও শুনিলাম যে, তোমরা চন্দনগর ধ্বংস করিয়াই নিরস্ত হইবে না, বর্ষাশেষে সসৈন্য মুর্শিদাবাদ পর্য্যন্তও আগমন করিবে। ইহা কি বীরোচিত অথবা ভদ্রজনোচিত ব্যবহার? সন্ধিপালন করিবার ইচ্ছা থাকিলে, জাহাজ গুলি ফেরত {{smaller|পাঠাইয়া দিবে। এই ত সেদিন সন্ধি করিয়াছ! এত অল্পদিনের মধ্যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা কি ভদ্রনীতি? মহারাষ্ট্রীয়দিগের বাইবেল নাই;—কিন্তু তারা ত সন্ধি লঙ্ঘন করে না। বড়ই আশ্চর্যের কথা,—সহসা বিশ্বাস করিতেও ইতস্তত হয়,—বাইবেলের ধর্ম্মশিক্ষা করিয়া, পরমেশ্বর এবং যীশুখ্রীষ্টের দোহাই দিয়া সন্ধিসংস্থাপন করিয়াছ, অথচ কার্য্যকালে তাহা পালন করিতে পারিতেছ না!”[৬]

 এই পত্রখানি যেরূপ শ্লেষাত্মক, সেইরূপ সুতীব্র ভাষায় লিখিত। বোধ হয় পত্র পড়িয়া ইংরাজদিগেরও চক্ষুলজ্জা হইয়াছিল। তাঁহারা নবাবের অনুমতি না লইয়া বাহুবলে চন্দননগর্ আক্রমণ করিতে সম্মত হইলেন না। তখন ওয়াট সন অনন্যোপায় হইয়া নূতন এক ধূয়া ধরিয়া প্রত্যুত্তর লিখিতে বসিলেন:—

 “আপনার ১৯শে ফেব্রুয়ারীর পত্র অদ্য ২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখে হস্তগত হইল। পত্রপাঠে জানিতে পারিলাম যে, ফরাসীদিগের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করা আপনার অভিপ্রেত নহে। ইহাতে আপনি যে এতদূর অসন্তুষ্ট হইবেন, এ কথা জানিতে পারিলে আমরা আপনার রাজ্যের শান্তিভঙ্গ করিবার আয়োজন করিতাম না। ফরাসিরা সন্ধি সংস্থাপন করিলে আমরা আর যুদ্ধ করিতে চাহি না। কিন্তু তাহারা সন্ধি করিলেই ছাড়িব না, সুবাদারস্বরূপ আপনাকে তাহার জামিন থাকিতে হইবে। পৃথিবীতে আমাদের মত সত্যপরায়ণ লোক যে আর কোন দেশে নাই, তাহা বোধ হয় আপনার অজ্ঞাত নাই। আমি আপনাকে সত্যশপথ করিয়া বলিতেছি, আমরা কিছুতেই সত্যলঙ্ঘন করিব না। প্রভু যীশু খ্রীষ্ট এবং পরমেশ্বরকে সাক্ষী কৃরিয়া আবার বলিতেছি যে, আপনি যদি ফরাসীদের সঙ্গে সন্ধি করাইয়া দেন, তবে আর কিছুতেই আমরা সত্যভঙ্গ করিব না।”[৭]

 ওয়াট্‌সনের প্রত্যুত্তর পাইয়া সিরাজদ্দৌলা বলিলেন,—তথাস্তু। তিনি কলহপ্রিয় চঞ্চল যুবক হইলে, এই উপলক্ষে ইংরাজকে বিলক্ষণ দশকথা শুনাইয়া দিতে পারিতেন; বলিতে পারিতেন, ফরাসির সঙ্গে তোমাদিগের সন্ধি হয় হউক, না হয় না হউক, তাহার সঙ্গে আমার সংস্রব কি? আমার অধিকারে আর কলহ বিবাদ করিবে না বলিয়া সেদিন যে সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিয়াছ, তাহার সহিত ফরাসিদিগের সম্বন্ধ কি? কিন্তু সিরাজদ্দৌলা এ সকল কূটতর্ক উপস্থিত না করিয়া অম্লান-বদনে লিখিয়া পাঠাইলেন:—

 “ফরাসিযুদ্ধ সংক্রান্ত পত্র পাইয়া তন্মর্ম্ম জ্ঞাত হইলাম। আমি ফরাসিদিগকে কলহবৃদ্ধির সহায়তা করিব না, সে জন্য নিশ্চিন্ত থাকিবা। বরং তাহারাই যদি গায়ে পড়িয়া বিবাদ বাধাইবার চেষ্টা করে, তবে সসৈন্যে বাধা প্রদান করিব। তোমরা চন্দননগর আক্রমণ করিবে শুনিয়া যাহা সঙ্গত বোধ হইয়াছিল, তাহাই লিখিয়া পাঠাইয়াছিলাম। আমি ফরাসিদিগকে উৎসাহ দিবার জন্য সেনাবল পাঠাই নাই; তোমরা কলহবিবাদ উপস্থিত করিলে আমারই প্রজাদিগের সর্ব্বনাশ হইবে, সুতরাং প্রজারক্ষার জন্যই (স্থানে স্থানে) সেনাসমাবেশ করিয়াছিলাম। আমার পত্র পাইয়া তোমরা যে চন্দননগর আক্রমণ করিবার সংকল্প ত্যাগ করিয়াছ, এ সংবাদে আমি যারপর নাই প্রীতিলাভ করিলাম। ফরাসিদিগকে সন্ধিসংস্থাপন করিবার জন্য পত্র লিখিলাম। সন্ধি হইলে, আমি একজন রাজ কর্ম্মচারী পাঠাইয়া দিব, এবং তোমাদের সন্ধিপত্র আমার দপ্তরে জারি করাইয়া রাখিব। মিত্রভাবে থাকিবার জন্যই সন্ধি করিয়াছি,—সে কথার কখনও অন্যথা হইবে না।

 “আর এক কথা। শুনিতেছি যে দিল্লীর ফৌজ আমার রাজ্য আক্রমণ করিতে আসিতেছে। তজ্জন্য বোধ হয় শীঘ্রই পাটনা অঞ্চলে গমন করিব। এ সময়ে তোমরা সেনাসাহায্য করিলে আমি লক্ষ টাকা পুরস্কার প্রদান করিব।”[৮]

 যখন নবাবের নিকট হইতে এই পত্রখানি কলিকাতায় উপনীত হইল, তখন ইংরাজমণ্ডলীতে হুলুস্থুল পড়িয়া গিয়াছে। ফরাসিরা সন্ধির জন্য কলিকাতায় প্রতিনিধি পাঠাইয়াছেন, সন্ধিপত্র লিখিত হইয়া গিয়াছে, কেবল গৃহকলহে ইংরাজবণিক তাহা স্বাক্ষর করিতে ইতস্ততঃ করিয়া কালক্ষয় করিতেছেন। ওয়াট্‌সন্ সাহেবই সকল গোলযোগের মূল হইয়া দাঁড়াইয়াছেন; সকলেই সম্মত, কেবল একাকী ওয়াট্‌সন্ অসম্মত হইয়া সকলের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করিয়া বেড়াইতেছেন। তাঁহার প্রধান তর্ক এই যে, “পঁদিচেরীর ফরাসিদরবার সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর না করিলে কদাচ সন্ধি করা কর্ত্তব্য নহে।” ক্লাইব দরবার বসাইয়া প্রাণপণে সন্ধির জন্য অনুরোধ জানাইতে লাগিলেন, এবং সকলেই তাহাতে সম্মতিদান করায় ওয়াট্‌সনের নিকট সন্ধিপত্র পাঠাইয়া দিলেন। ওয়াট্‌সন্ তাহা দুইবার ফিরাইয়া দিবার পর ক্লাইব স্বহস্তে এক সুদীর্ঘ মন্তব্য লিখিয়া বার বার তিনবার ওয়াট্‌সনের নিকট সন্ধিপত্র পাঠাইয়া দিলেন। ওয়াট্‌সন্ কিছুতেই বিচলিত হইলেন না;—সন্ধি হইল না। কাহার দোষে সন্ধি হইল না, ক্লাইব তাহা নিজেই মন্তব্য পত্রে লিখিয়া গিয়াছেন।

 “Do but reflect gentlemen, what will be the opinion of the world of these our late proceedings. Did we not, in consequence of a letter received from the Governor and Council of Chandernagor making offers of a neutrality within the Ganges, in a manner accede to it by desiring they would send deputies, and that we would gladly come into such a neutrality with them; and have we not since their arrival drawn out Articles that were satisfactory to both parties, and agreed that each Article should be reciprocally signed, scaled and sworn to? What will the Nabab think? After the promises made him on our side and after his consenting to guarantee this neutrality, he and all the world will certainly think that we are men of a trifling, insignificant disposition, or that we are men without principles. It is therefore incumbent on us to, exculpate ourselves by declaring the real truth, that we were entirely ignorant of Mr. Watson's intentions to refuse the neutrality in the manner proposed and settled by us, and that we always thought him of a contrary opinion to what his letter declares. I am persuaded these must be the sentiments of the gentlemen of the Committee, or they never would have gone such lengths as[৯] must expose them to the censure of all reasonable men."

 ওয়াট্‌সন্ ইহাতেও বিচলিত হইলেন না! তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, সিরাজদ্দৌলা দিল্লীর আক্রমণভয়ে অতিমাত্র ভীত হইয়া ইংরাজের নিকট সাহায্যভিক্ষা করিয়াছেন, সুতরাং এ সময়ে দায়ে পড়িয়াই—চন্দননগর লুণ্ঠনের অনুমতি দিতে হইবে। ওয়াট্‌সন্ হয়ত ভাবিয়াছিলেন যে, সিরাজদ্দৌলার আবার ধর্ম্মাধর্ম্ম কি? স্বার্থরক্ষার জন্য তাঁহাকে অবশ্যই ইংরাজের মনস্তুষ্টি করিতে হইবে। তিনি সেই জন্য নানারূপ গৌরচন্দ্রিকা করিয়া সিরাজদ্দৌলাকে যাহা লিখিয়া পাঠাইলেন তাহার মর্ম্মার্থ এইরূপ:—“চন্দননগরের ফরাসিদুর্গে অনেক সেনা রহিয়াছে, তাহাদিগকে পশ্চাতে রাখিয়া আমরা দূরদেশে যুদ্ধযাত্রা করিতে পারি না। আপনি অনুমতি করিলেই আমরা ফরাসিদিগকে নির্ম্মূল করিয়া সসৈন্যে আপনার সঙ্গে পাটনা অঞ্চলে গমন করিতে পারি।”[১০]

 সিরাজদ্দৌলা বিষম বিপদে পতিত হইলেন। এদিকে বাদশাহী সিপাহী সদর্পে অগ্রসর হইতেছে, ওদিকে ইংরাজসিংহ সগর্ব্বে ফরাসিদলনের আয়োজন করিতেছেন;—সিরাজদ্দৌলা কোন্ দিক রক্ষা করিবেন? তিনি যদি পদাশ্রিত ফরাসিবণিকের সর্ব্বনাশ করিয়া ইংরাজের সাহায্য ক্রয় করিতে সম্মত হইতেন, তাহা হইলে হয় ত উভয়কুলই রক্ষা হইতে পারিত, এবং ইতিহাসলেখকেরাও বোধ হয় দুই হাত তুলিয়া সিরাদ্দৌলার জয়ধ্বনিতে দিঙ্মণ্ডল পরিপূর্ণ করিতেন! কিন্তু সিরাজদ্দৌলা তাহা পারিলেন না; পদাশ্রিত ফরাসিবণিকের সর্ব্বনাশ করিয়া ইংরাজের নিকট সেনাভিক্ষা করা সিরাজদ্দৌলার মনঃপূত হইল না। তিনি ওয়াটসনের প্রস্তাবের প্রত্যুত্তর দিয়া বাহুবলে আত্মরক্ষার জন্য সেনাসংগ্রহে নিযুক্ত হইলেন। ইহাতেই সিরাজদ্দৌলার সর্ব্বনাশের সূত্রপাত হইল।

  1. পলাশীর যুদ্ধাবসানে মীরজাফর যখন ‘পিরোপা’ পাঠাইয়া দেন, তখন কিন্তু কর্তব্যনিষ্ঠ ওয়াট্‌সন্ সাহেবের কোনরূপ ইতস্ততের পরিচয় পাওয়া যায়, নাই; বরং তিনি স্বহস্তে মীরজাফরকে লিখিয়া গিয়াছেনঃ—Mirza jaffier Beg, whom you have done me the honor to depute to me, has delivered me your letter, and other marks of friendship, with which you have been pleased to favor me.-Ive's journal
  2. Clive's Evidence.
  3. The Nabob detested the idea—Orme, vol. ii. 136.
  4. Orme, vol. II. 137.
  5. মূলপত্র কোথায় তাহার সন্ধান পাওয়া যায় না; ইংরাজেরা এই সকল পত্রের যে ইংরাজি অনুবাদ করাইয়াছিলেন, তাহা Ive's Journal নামক পুরাতন গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট আছে। সিরাজচরিত্র অধ্যয়ন করিতে হইলে এই পত্রগুলি আদ্যন্ত অধ্যয়ন করা আবশ্যক।
  6. Ive's Journal.}}
  7. Ive's Journal.
  8. Ive's Journal.অনেকে এই পত্রখানির অনেকরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ইংরাজেরা বলেন যে, সিরাজদ্দৌলা পাঠানসেনার আক্রমণভয়ে জীবন্মৃত হইয়াই ইংরাজের নিকট সেনাবল ভিক্ষা করিয়াছিলেন। কিন্তু সিরাজচরিত্র বিচার করিয়া আমাদিগের এইরূপ ধারণা হইয়াছে যে, ইংরাজদিগকে সেনাহীন করাই তাঁহার প্রধান উদ্দেশ্য। তিনি পাটনায় প্রস্থান করিলে ইংরাজ হয় ত সসৈন্যে চন্দননগর আক্রমণ করিবেন, বোধ হয় সেই আশঙ্কা নিবারণের জন্যই এরূপ প্রস্তাব করিয়াছিলেন।
  9. Select Committee Proceeding, 4 March 1757.
  10. Ive's Journal.