সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/ইংরাজ-বণিকের উদ্ধত-স্বভাব

উইকিসংকলন থেকে

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।

ইংরাজ-বণিকের উদ্ধত-স্বভাব।

 ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে[১] নবাব মন্‌সূরোল্ মোলক সিরাজদ্দৌলা-শাহকুলীখাঁ-মীরজা-মোহম্মদ-হায়বৎজঙ্গ বাহাদুর বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার মস্‌নদে আরোহণ করেন। শত্রুদলের মনের ভাব যাহাই থাকুক, কেহ আর প্রকাশ্যে বাধা দিতে সাহস পাইল না;—যে যেখানে ছিল, সকলেই যথাযোগ্য রাজভক্তি প্রদর্শন করিতে ত্রুটি করিল না। ইউরোপীয় বণিকেরাও কার্যতঃ সিরাজদ্দৌলাকেই নবাব বলিয়া স্বীকার করিয়া লইলেন, এবং যথাকালে স্বদেশে তৎসংবাদ প্রেরণ করিয়া পূর্ব্ববৎ বাণিজ্যব্যাপারে নিযুক্ত রহিলেন।

 সিরাজদ্দৌলা যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, কলিকাতার তখন বড়ই শোচনীয় অবস্থা। একে ইংরাজদিগের সংখ্যা, নিতান্ত অল্প, তাহাতে প্রায় প্রতি বৎসরেই সহস্রাধিক ইংরাজ অকালে কালকলে পতিত হইতেন;—অনেকেই কলিকাতার জলবায়ুর প্রকোপ সহ্য করিতে পারিতেন না। ইংরাজদিগের যত্নে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় সংস্থাপিত হইয়াছিল; তাহাতে প্রবেশ করিবার জন্য আগ্রহের অবধি ছিল না;—কিন্তু যাঁহারা প্রাণের দায়ে প্রবেশ করিতেন, তাহারা অনেকেই ফিরিয়া আসিবার অবসর পাইতেন না।[২]

 বর্ষাসমাগমে জ্বরবিকারের প্রবল প্রতাপে অনেকেই শয্যাগত হইতেন। যাঁহারা কোনরূপে ভালয় ভালয় বর্ষাকাল কাটাইয়া দিতে পারিতেন, তাহারা প্রতি বৎসরে ১৫ই অক্টোবরের শরৎকৌমুদী-বিধৌত প্রশান্ত নিশীথে প্রীতিভোজনে সম্মিলিত হইয়া পরস্পর পরম সমাদরে প্রগাঢ় হোলিঙ্গন করিয়া আনন্দোচ্ছাস উদ্বেলিত করিতেন।[৩]

 বর্গীর হাঙ্গামা নিবারণ করিবার জন্য ইংরাজ বাঙ্গালী মিলিত হইয়া নগরক্ষার্থ অগ্রপশ্চাৎ বিচার না করিয়া স্বহস্তে যে “মহারাষ্ট্র খাত” খনন করিয়াছিলেন, তাহার গর্ভোদগত পূতিগন্ধে নাগরিকদিগের নাসারন্ধ্র জ্বলিয়া উঠিত। পথ ঘাটের কিছুমাত্র পারিপাট্য ছিল না; যাহা ছিল, তাহাও কখন ধূলায়, কখন কাদায়, এবং নিরন্তর ন্যক্কারজনক বীভৎস দ্রব্যে পরিপূর্ণ হইয়া থাকিত। সেকালের লালদীঘিই সাধারণের নিকট “পার্ক” বলিয়া পরিচিত ছিল; কিন্তু তাহার পূতিগন্ধও বহুদূর পর্যন্ত পথিকদিগকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিত।[৪]

 এখন যেখানে শ্বেতাঙ্গ নর-শার্দূলগণ সৌধ-ধবল চৌরঙ্গী অঞ্চলে সশরীরে স্বর্গসুখ উপভোগ করেন, সেকালে সেখানে কেবল বনশালনিনাদ-মুখরিত শ্যামল বন-বিটপিরাজি বিরাজ করিত। ১৭৫১ খৃষ্টাব্দে ইষ্টক প্রস্তুতের জন্য তাহার কিয়দংশ নির্ম্মূল হইয়াছিল। কিন্তু তথাপি সে নিবিড় বন একেবারে উৎসাদিত হয় নাই;—নগরের মধ্যেও অনেক স্থানেই তরুগুল্মলতা স্বচ্ছন্দবনজাত স্বাভাবিক শোভা বিকাশ করিয়া সগৌরবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিস্তার করিত।[৫] লোকে কেবল বাণিজ্য লোভে অথবা বর্গীর ভয়েই এরূপ স্থানে বাস করিতে সম্মত হইত। কিন্তু আভ্যন্তরিক অবস্থা, যতই শশাচনীয় হউক, ভাগীরথী-তীর-সমাশ্রিত সুগঠিত অট্টালিকাসমুহের বাহাড়ম্বরে কলিকাতা বহুজনাকীর্ণ মহানগরী বলিয়াই প্রতিভাত হইত।

 এই নবজাত মহানগরে ইংরাজের প্রবল প্রতাপ ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠালাভ করিতেছিল। তাঁহারা নবাবের রাজ্যে বাস করিয়াও নিজ শহর কলিকাতার মধ্যে স্বাধীনতা-প্রিয়তার পরিচয় দিতে ক্রটি করিতেন না। তাহাদের অনুমতিক্রমে পর্তুগীজ, আরমানী, মোগল এবং হিন্দু বণিকেরাও কলিকাতায় বাসস্থান নির্মাণ করিয়া বাণিজ্যব্যাপারে প্রভূত অর্থোপার্জন করিতেন।

 আরমানী বণিকদিগের মধ্যে খোজা বাজিদের নাম নানা কারণে বাঙ্গালার ইতিহাসে স্থানলাভ করিয়াছে। তিনি লবণের ব্যবসায়ে একাধিপত্য লাভ করিয়া পদগগৗরবে সকলের নিকটেই সম্মানাস্পদ হইয়া উঠিয়াছিলেন; এবং তজ্জন্য নবাব-দরবার হইতে “ফখরু-অল-তোজ্জার” অর্থাৎ ‘বণিকগৌরব” উপাধি লাভ করিয়া এ দেশে যথেষ্ট ক্ষমতাশালী হইয়াছিলেন।

 হিন্দু বণিকদিগের মধ্যে উমাচরণের নাম ‘উমিচাঁদ” বলিয়া ইংরাজলিখিত ইতিহাসমাত্রেই চিরপরিচিত হইয়া রহিয়াছে।[৬]ইংরাজেরা ইহাকে ধূর্ত্ততার প্রতিমূর্ত্তি বলিয়া লোকসমাজে প্রতিপন্ন করিবার জন্য। যথেষ্ট আয়াস স্বীকার করিয়া গিয়াছেন; এবং সুললিত-পদবিন্যাসনিপুণ লর্ড মেকলে আবার বর্ণনাটি সর্বাঙ্গসুন্দর করিবার জন্য তাহাকে ‘ধূর্ত্ত বাঙ্গালী” বলিয়া পরিচয় দিতেও ইতস্ততঃ করেন নাই। উমিচাঁদ বাঙ্গালী ছিলেন না। তিনি পশ্চিমাঞ্চলের হিন্দুবণিক, কেবল বাঙ্গালা বিহারে বাণিজ্য করিবার জন্যই বাঙ্গালা দেশে বাস করিতেন। উমিচাঁদকে ‘বণিক” বলিয়া পরিচয় দিলে, সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া হয় না। তাহার শত-সৌধ-বিভূষিত, বিচিত্র রাজপুরী, তাহার কুসুমধামসজ্জিত সুবিখ্যাত পুপোদ্যান, তাঁহার মণিমাণিক্যখচিত ব্রজভাণ্ডার, তাহার সশস্ত্র সৈনিক-বেষ্টিত সুগঠিত সিংহদ্বার দেখিয়া, অন্যের কথা দূরে, থাকুক, ইংরাজেরাও তাঁহাকে একজন রাজা বলিয়াই মনে করিতেন[৭]। শেঠদিগের মধ্যে যেমন জগৎশেঠ, বণিকদিগের মধ্যে সেইরূপ উমিচাঁদ নবাব-দরবারে সবিশেষ সুপরিচিত ও পদগৌরবান্বিত হইয়াছিলেন; ইংরাজবণিক বিপদে পড়িলে সর্ব্বদাই তাহার শরণাগত হইতেন; এবং অনেকবার তাহার অনুকম্পাবলেই যে লজ্জারক্ষা হইয়াছিল, এখনও তাহার কিছু কিছু পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।[৮]

 ইংরাজেরা উমিচাঁদের সহায়তা লাভ করিয়াই বাঙ্গালাদেশে বাণিজ্যবিস্তারের সুবিধা পাইয়াছিলেন। তাঁহার যোগে গ্রামে গ্রামে টাকা দাদন করিয়া ইংরাজেরা কার্পাস এবং পট্টবস্ত্র ক্রয় করিয়া প্রভূত অর্থোপার্জন করিতেন। এরূপ সুবিধা না পাইলে, অপরিচিতদেশে ইংরাজের আত্মশক্তি সহজে প্রতিষ্ঠালাভ করিবার অবসর পাইত কি না সন্দেহ। কিন্তু ইংরাজের সঙ্গে দেশের লোকের পরিচয় হইমাত্র বিধাতার বিড়ম্বনায় ইংরাজেরা উমিচাঁদকে উপেক্ষা করিতে আরম্ভ করিলেন। সিরাজদ্দৌলা যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন ইংরাজবণিক আর পূর্ব্ববৎ উমিচাঁদকে বিশ্বাস করিতেন না; উভয়ের মধ্যে যে মনোমালিন্যের সূত্রপাত হইয়াছিল, তাহা বিলক্ষণ ঘনীভূত হইয়া উঠিয়াছিল।

 সেকালে এ দেশের লোকের যেরূপ সরল প্রকৃতি ছিল, তাঁহাতে তাঁহারা ইংরাজদিগের অধ্যবসায়, অকুতোভয়তা এবং বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় পাইয়া নিঃসন্দেহে বিশ্বাসস্থাপন করিয়া ইংরাজের পক্ষপাতী হইয়া পড়িয়াছিলেন। তজ্জন্য ইংরাজের পথ কিছু সুগম হইয়া উঠিয়াছিল।

 সিরাজদ্দৌলা ইংরাজদিগকে চিনিয়াছিলেন। রাজকার্য্যে লিপ্ত হইয়া ইংরাজের কুটিল নীতির পরিচয় পাইয়া সিরাজদ্দৌলার ইংরাজবিদ্বেষ বদ্ধমূল হইয়া উঠিয়াছিল। ইংরাজেরা নবাবের অনুমতি না লইয়া দুর্গসংস্কারে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন; এবং পলায়িত কৃষ্ণবল্লভকে পরম সমাদরে কলিকাতায় আশ্রয়দান করিয়াছিলেন;— ইহাতে সিরাজদ্দৌলার ক্রোধাগ্নিতে ঘৃতাহুতি পতিত হইয়াছিল। তিনি সিংহাসনে পদার্পণ করিবামাত্র বৃদ্ধ মাতামহের অন্তিম উপদেশ[৯] স্মরণ করিয়া ইংরাজদিগকে শাসন করিবার জন্য তাহাদের কাশিমবাজারের “গোমস্তা” ওয়াট্‌স্ সাহেবকে ডাকিয়া পাঠাইলেন।

 ওয়াটস সাহেব উপনীত হইলে, সিরাজদ্দৌলা কোন কথা গোপন করিলেন না;—তাহাকে পরিষ্কার করিয়া বুঝাইয়া বলিলেন যে, “আমি তোমাদের ব্যবহারে মোটের উপর বড়ই অসন্তুষ্ট হইয়াছি। শুনিলাম যে, তোমরা নাকি আমার অনুমতির অপেক্ষা না করিয়াই কলিকাতার নিকটে দুর্গ নির্মাণ করিতেছ? আমি কিছুতেই এরূপ কার্যের প্রশ্রয় দিতে পারিব না। আমি তোমাদিগকে বণিক বলিয়াই জানি,— যদি বণিকের ন্যায় শান্তভাবে বাস করিতে চাও, আমি তোমাদিগকে সমাদরে আশ্রয়দান করিব। কিন্তু মনে রাখিও যে, আমিই এ দেশের নবাব;— যদি দুর্গ প্রাচীর চুর্ণ করিতে ত্রুটি হয়, তবে কিছুতেই আমাকে সস্তুষ্ট করিতে পারিবে না।”

 ওয়াটস সাহেব এ সকল কথার কোনই সদুত্তর দিতে পারিলেন না। ইংরাজ ইতিহাসলেখক অর্ম্মি সাহেব বলিয়া গিয়াছেন যে, “ওয়াট সাহেব সিরাজদ্দৌলার ইংরাজ-বিদ্বেষের পরিচয় পাইয়াও এ সকল কথা ইংরাজ-দরবারে জ্ঞাপন করেন নাই;—কেবল তাহাতেই ত উত্তরকালে এত অনর্থ উৎপন্ন হইয়াছিল।”[১০]কিন্তু ওয়াটস্ সাহেব যে এ সকল কথা যথাসময়ে কলিকাতায় লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন, তাহার বিশিষ্ট প্রমাণ অদ্যাপিও বর্ত্তমান রহিয়াছে॥[১১]  সিরাজদ্দৌলার অসন্তোষের প্রকৃত কারণ কি, তাহা ইংরাজদিগের মধ্যে কাহারও নিকট অপরিজ্ঞাত ছিল না। ইংরাজের দোষক্ষালনের জন্য ইতিহাসপৃষ্ঠায় যাহাই লিখিত হউক, পদাশ্রিত বণিক হইয়া নবাবের ইচ্ছা এবং আদেশের প্রতিকুলে দুর্গসংস্কারে হস্তক্ষেপ করিয়া ইংরাজেরা যে যথেষ্ট পরিমাণে উদ্ধত স্বভাবের পরিচয় দিয়াছিলেন, সে বিষয়ে কাহারও সন্দেহ হইতে পারে না। কলিকাতার ইংরাজ দরবার যে এই সামান্য কথাটি একেবারেই বুঝিতেন না, তাহা বলিতে গেলে সত্যের অপলাপ করা হয়। তাঁহারা জানিতেন, বুঝিতেন, এবং ইহাও বিশ্বাস করিতেন যে, সরলভাবে অনুমতি ভিক্ষা করিলে ইংরাজ-বিদ্বেষী সিরাজদ্দৌলা কস্মিকালেও ইংরাজদিগকে দুর্গসংস্কারের অনুমতি প্রদান করিবেন না। সুতরাং তাঁহার জানিয়া শুনিয়াই সিরাজদ্দৌলার মুখাপেক্ষা করিতে সম্মত হন নাই। ইহাতে ইতিহাসের বিচারে ইংরাজকেই অপরাধী হইতে হইবে।

 সিরাজদ্দৌলা অরণ্যে রোদন করিলেন;—না ওয়াটস্ সাহেব, না কলিকাতার ইংরাজ-দরবার,—কেহই সে কথার সদুত্তর প্রদান করিলেন। সিরাজদ্দৌলা “উদ্ধত প্রকৃতির আশ্বস্ত যুবক” হইলে তৎক্ষণাৎ মহান্ অনর্থ উৎপন্ন হইতে বিলম্ব ঘটিত না। কিন্তু সিরাজদ্দৌলা মর্ম্মপীড়িত হইয়াও আত্ম-সংযম করিলেন। যে দুর্দ্দমনীয় হৃদয়রেগ সিরাজদ্দৌলাকে যৌবনে অশেষ পাপপঙ্কে টানিয়া লইতেছিল, সিংহাসনে আরোহণ করিবামাত্র সে হৃদয়বেগ অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল; নচেৎ ক্ষুদ্রজীবী ইংরাজ-গোমস্তা ওয়াটস সাহেবকে লাঞ্ছনা করিতে কতক্ষণ? সিরাজদ্দৌলা তাঁহাকে আর কোন কথাই বলিলেন না;—সাক্ষাৎভাবে ইংরাজ-দরবারের প্রত্যুত্তর পাইবার জন্য কলিকাতায় রাজদূত পাঠাইবার আয়োজন করিতে লাগিলেন।

 এই সময় হইতে সিরাজদ্দৌলা যেরূপ সতর্ক পাদবিক্ষেপে ধীরে ধীরে গন্তব্যপথে অগ্রসর হইতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, ইতিহাসে তার যথোপযুক্ত আলোচনা হয় নাই; সেই জন্য কেহ অজ্ঞতাবশতঃ, কেহ বা স্বার্থসাধনের জন্য তাহার অযথা কলঙ্ক রটনা করিয়া গিয়াছেন। ইংরাজেরা যে সহজে দুর্গ প্রাচীর চূর্ণ করিতে সম্মত হইবেন না, সে কথা কাহারও অবিদিত ছিল না। ভাল হউক আর মন্দ হউক, তাঁহারা যখন একবার মুসলমান নবাবের দুর্বলতার অবসর পাইয়া মুসলমান রাজ্যে দুর্গরচনা করিয়া লইয়াছেন, তখন সহসা যে তাঁহাদিগকে সাধারণ বণিকসমিতির ন্যায় পদানত করা সহজ হইবে না, সিরাজদ্দৌলাও তাহা বুঝিতেন;—সেইজন্য একজন সামান্য রাজদূত না পাঠাইয়া, সম্ভ্রান্ত সুকৌশলসম্পন্ন প্রতিভাশালী ব্যক্তিকে দৌত্যকার্য্যে নিয়োগ করিবার জন্য খোজা বাজিদের উপর এই দৌত্যকার্য্যের ভার সমর্পিত হইল; সিরাজদ্দৌলার আশা ছিল যে, হয় ত তাঁহার পরামর্শে ও সদুপদেশে ইংরাজের মতিভ্রম দূর হইবে, এবং বিনা রক্তপাতে ইংরাজের সহিত কলহবিবাদ নীরবে মীমাংসিত হইয়া যাইবে।

 খোজা বাজিদ চেষ্টার ত্রুটি করিলেন না। তিনি যথাসময়ে কলিকাতার ইংরাজ-দরবারে উপনীত হইয়া একে একে সকল কথা বুঝাইয়া বলিলেন;—কিন্তু সে কথায় কেহ কর্ণপাত করিল না। বরং হিতে বিপরীত হইল। ইংরাজের নবাবের পত্রের কোনরূপ প্রত্যুত্তর না দিয়া, সেই সন্ত্রান্ত রাজদূতকে অশেষ প্রকারে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করিয়া নগর-বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন! ইহা কাহারও স্বকপোল-কল্পিত নূতন কথা নহে। বিলাতের বৃটিশ মিউজিয়মে রক্ষিত হস্তলিখিত পুরাতন ইতিহাসে ইহা দেখিতে পাওয়া যায়।[১২]

 সিরাজদ্দৌলা ইহাতেও ধৈর্য্যচ্যুত হইলেন না। তিনি কেবল ইংরাজের উদ্ধত স্বভাবের পরিচয় পাইয়া এইমাত্র বুঝিয়া রাখিলেন যে, শীঘ্রই হউক, আর বিলম্বেই হউক, ইংরাজের উৎকট রোগের উৎকট চিকিৎসা প্রয়োগ করিতে হইবে। কিন্তু সহসা সেরূপ ব্যবস্থা না করিয়া পুনরায় দূত পাঠাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 সিরাজদ্দৌলার অধীনে রাজা রামরাম সিংহ চরাধিপতির উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন। বর্গীর হাঙ্গামার অবসান সময়ে রামরাম সিংহ মেদিনী- পুরের ফৌজদার-পদে নিযুক্ত থাকিয়া যেরূপ প্রভুভক্তির পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, তাহারই পুরারস্বরূপ নবাব আলিবর্দী তাঁহাকে চরাধি- পতি নিযুক্ত করিয়াছিলেন। নবাব আলিবর্দ্দী এবং সিরাজদ্দৌলা উভ- য়েই রামরাম সিংহকে সবিশেষ শ্রদ্ধা করিতেন, এবং বিশ্বাসী রাজকর্ম্ম- চারী বলিয়া অনেক বিষয়ে তাঁহার পরামর্শ গ্রহণ করিতেন। সিরাজ- দ্দৌলা রাজা রামরাম সিংহের উপরে কলিকাতায় দূত পাঠাইবার ভার। পণ করিলেন। খোজা বাজিদের অপমানের কথা চারি দিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়িয়াছিল;—যাহারা খোজা বাজিদের ন্যায় সম্রান্ত রাজদূতকে এমন অপমান করিয়া তাড়াইয়া দিতে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ করিল না, তাহারা যে অন্য কাহাকেও সম্মান প্রদর্শন করিবে, তাহার কিছুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। হয় ত পূর্ব্বে কোনরূপ আভাস পাইলে রাজদূতকে কলিকাতায় পদার্পণ করিতেও বাধা প্রদান করিতে পারে; সুচতুর চরাধিপতি রামরাম সিংহ তজ্জন্য এক নুতন কৌশল অবলম্বন করিলেন। তাহার ভ্রাতাকে[১৩] দৌত্যকার্যে নিযুক্ত করিয়া তাঁহাকে ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে একখানি ডিঙ্গী নৌকায় কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলেন। রাজদূতকে কেহ চিনিতে পারিল না, তিনি নিরাপদে উমিচাঁদের গৃহে আশ্রয়লাভ করিলেন, এবং বণিকরাজের সঙ্গে ইংরাজ-দরবারে উপস্থিত হইয়া আত্মপ্রকাশ করিলেন। কিন্তু তাঁহার ভাগ্যেও লাঞ্ছনার একশেষ হইল!

 এই সকল পুরাকাহিনী পাঠ করিতে করিতে স্বতঃই জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হয়,— ইংরাজেরা এত দূর উদ্ধত হইয়া উঠিয়াছিলেন কেন? অথবা এ সকল নিতান্ত অলীক জনাপবাদ বলিলে ক্ষতি কি? যাহারা পদাশ্রিত বিদেশীয় বণিক, তাঁহাদের এত স্পর্দ্ধা, এত সাহস, এত বাহুবল? বাস্তবিক পূর্ব্বাপর সমস্ত ঘটনার আলোচনা না করিলে, এ সকল কথা নিতান্ত জনাপবাদ বলিয়া পরিত্যাগ করিতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু ইহা জনাপবাদ নহে;—ইহার নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করিলে কাহারও আর বিস্ময়ের কারণ থাকিবে না।

 সিরাজদ্দৌলা যদিও নিরুদ্বেগে সিংহাসনে পদার্পণ করিয়াছিলেন, তথাপি অনেকেই বিশ্বাস করিত যে, রাজবল্লভ জীবিত থাকিতে সিরাজদ্দৌলার নিস্তার নাই;—যেমন করিয়া হউক, সিরাজদ্দৌলাকে শীঘ্রই সিংহাসনচ্যুত করিয়া ঘসেটি বেগমের নামে মহারাজ রাজবল্লভই বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যায় নবাবী করিতে আরম্ভ করিবেন। আলিবর্দ্দী জীবিত থাকিতেই ইংরাজেরা ইহার কিছু কিছু আভাস পাইয়াছিলেন; এবং কোনরূপে রাজবল্লভকে হস্তগত রাখিবার জন্য তাঁহার পূর্ব্বকৃত সমুদায় অত্যাচার বিস্মৃত হইয়া, ইংরাজেরা তাঁহার পলায়িত পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে কলিকাতায় আশ্রয়দান করিয়াছিলেন। ওয়াট্‌স্‌ সাহেব প্রায় প্রত্যহই লিখিতে লাগিলেন যে, “সিরাজদ্দৌলা সিংহাসনে আরোহণ করিলে কি হইবে? এখনও ঘসেটি বেগমের আশা নির্ম্মূল হয় নাই।” সুতরাং ইংরাজেরা রাজবল্লভকে হাতছাড়া করিয়া সিরাজদ্দৌলার পক্ষাবলম্বন করিতে সাহস পাইলেন না।

 উত্তরকালে যখন রাজবল্লভের সমুদয় আশা ভরসা একেবারে নির্ম্মূল হইয়া গেল, এবং সিরাজদ্দৌলাই সগৌরবে রাজ্যশাসন করিতে আরম্ভ করিবেন, তখন ইংরাজ ইতিহাসলেখকদিগের গলদঘর্ম্ম উপস্থিত হইল। তাঁহারা আদ্যোপান্ত সকল কথা গোপন করিয়া কেবল এইমাত্র লিখিয়া রাখিলেন যে, “একজন রাজদূত আসিয়াছিল, তাহা সত্য কথা। কিন্তু নবাব সিরাজদ্দৌলাই যে সেই রাজদূত পাঠাইয়াছিলেন, তাহা আমরা কেমন করিয়া বুঝিব? রাজদূত সামান্য ফেরিওয়ালার ন্যায় ছদ্মবেশে নগর প্রবেশ কৱিয়া আমাদের পরমশত্রু “উমিচাঁদের” বাটীতে প্রবেশ করিয়াছিল কেন? উমিচাঁদের সঙ্গে আমাদের কলহ বিবাদ,—আমরা ভাবিয়াছিলাম যে, উমিচাঁদ আদর বাড়াইবার জন্য এই কৌশলজাল বিস্তার করিয়াছেন। সেই জন্যই ত আমরা রাজদূতকে উপেক্ষা করিয়াছিলাম। নচেৎ, আমরা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝিতাম যে, স্বয়ং সিরাজদ্দৌলা রাজদূত পাঠাইয়া দিয়াছেন,—সর্ব্বনাশ! আমরা কি বাতুল যে, তাঁহাকে এমন করিয়া অপমান করিব?[১৪]

 পরবর্ত্তী ইতিহাসলেখকেরা যাহাই বলুন, একজন সমসাময়িক ইতিহাসলেখক কিন্তু একেবারে সকল কথা অস্বীকার করিতে পারেন নাই। তিনি বলেন যে, “রাজা রামরাম সিংহের ভ্রাতা যেদিন কলিকাতায় উপনীত হন, সেদিন গবর্ণর ড্রেক সাহেব রাজধানীতে ছিলেন না;—সহর-কোতোয়াল হলওয়েল সাহেবের সঙ্গেই রাজদূতের প্রথম সন্দর্শন ঘটে। তৎপরদিন ড্রেক সাহেব শুভাগমন করিলে মন্ত্রিসভার অধিবেশন হইল। যাঁহারা উপস্থিত ছিলেন, সকলেই বলিলেন যে, এ কেবল উমিচাঁদের কুটিল কৌশল। কারণ, কাশিমবাজার হইতে সংবাদ আসিয়াছিল যে, ঘসেটি বেগমের আশা ভরসা নির্ম্মূল হয় নাই। এরূপ অবস্থায় রাজদূত যে পত্র আনয়ন করিয়াছিলেন, তাহা সকলেরই চক্ষে সন্দেহাত্মক বোধ হইতে লাগিল। কেহই তাহার উত্তর দেওয়া আবশ্যক মনে করিলেন না। রাজদূতকে বিদায় দিবার আদেশ হইলে, অশিক্ষিত ভৃত্যবর্গ একে আর করিয়া তুলিল;—তাহারা রাজদূতকে সবিশেষ অপমান করিয়া তাড়াইয়া দিল।”[১৫] ইহাতে পাছে সিরাজদ্দৌলা অসন্তুষ্ট হন, তজ্জন্য সাবধান হইবার উপদেশ দিয়া তাড়া- তাড়ি ওয়াট্‌স সাহেবকে পত্র লেখা হইল।

 সকল কথা একত্র সমালোচনা করিতে গেলে কাহারও সহিত কাহারও ঐক্য হয় না। যদি উমাচরণের কুটিল-কৌশল বলিয়াই ধারণা হইয়াছিল, তবে আবার ওয়াট্‌স সাহেবকে সাবধান হইবার জন্য পত্র লেখা হইল কেন? ঘসেটি বেগমের সিংহাসনলাভের আশা নির্ম্মূল হইয়াছে কি না, সে কথারই বা বিচার করিবার প্রয়োজন হইল কেন? দেখিয়া শুনিয়া মনে হয় যে, ইংরাজেরা উত্তরকালে দোষক্ষালনের জন্য যে সকল কুটিল কৈফিয়তের অবতারণা করিয়া গিয়াছেন, কার্যকালে তাহার প্রতি কেহই আস্থা স্থাপন করেন নাই;—রাজবল্লভকে ও হাতছাড়া করা হইবে না, সিরাজদ্দৌলাকেও উত্তেজিত করা হইবে না, — বোধ হয়, ইহাই তাঁহাদিগের মূলমন্ত্র হইয়া উঠিয়াছিল।

 সিরাজদ্দৌলার নিকট এই অযাচিত অপমানের সংবাদ উপস্থিত হইবামাত্র, ইংরাজ প্রতিনিধি ওয়াটস্ সাহেব একজন উকীল লইয়া দরবারে উপনীত হইলেন, এবং উকীলের মুখ দিয়া পূর্ব্বশিক্ষিত সুললিত কৈফিয়ৎ আবৃত্তি করাইয়া সসম্রমে আসনগ্রহণ করিলেন। ইংরাজেরা যে সিরাজদ্দৌলাকে দুর্দ্দান্ত নরপিশাচ বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, সেই-উদ্ধত যুবক বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার প্রবল প্রতাপান্বিত মোগল রাজসিংহাসনে বসিয়া পদাশ্রিত বণিক সমিতির এইরূপ উদ্ধত ব্যবহারের পরিচয় পাইয়াও কোনরূপ হৃদয়বিকার প্রকাশ করিলেন না। তিনি বুঝিলেন যে, কেবল গৃহকলহের ছিদ্রানুসন্ধান পাইয়াই ইংরাজ বণিক উদ্ধত স্বভাবের পরিচয় প্রদান করিতে ইতস্ততঃ করিতেছেন না। সুতরাং সর্ব্বাগ্রে ঘসেটি বেগমের চক্রান্ত চূর্ণ করিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 ঘসেটি বেগম বিধবা। সিরাজদ্দৌলা ভিন্ন তাঁহার আর কেহ পরমা- ত্মীয় নাই। সুতরাং বৈধব্যদশায় একাকিনী মতিঝিলের রাজ প্রাসাদে স্বাধীনভাবে বিচরণ না করিয়া রাজান্তঃপুরে সিরাজদ্দৌলার মাতা ও আলিবর্দ্দীর মহিষীর সহিত একত্র বাস করিবার জন্য সিরাজদ্দৌলা বিনীত-ভাবে আত্ম-নিবেদন করিলেন। রাজবল্লভের স্বার্থসিদ্ধির সহজ পথ চিররুদ্ধ হইতেছে বলিয়া তিনি তুরী ভেরী বাজাইয়া মতিঝিলের সিংহদ্বারে সেনাসমাবেশ করিতে আরম্ভ করিলেন। সিরাজদ্দৌলা ইহাতে উত্ত্যক্ত না হইয়া তাহাকে রাজসদনে আহ্বান করিলেন, এবং তাঁহার সকল প্রকার কুচরিত্রের কথা অবগত থাকিয়াও তাঁহার পদগৌরব অক্ষুন্ন রাখিয়া বিরক্তপাতে মতিঝিল অধিকার করিয়া পিতৃব্যরমণীকে রাজাপুরে আনয়ন করিলেন। যেরূপ সুকৌশলে বিনা রক্তপাতে এই প্রধুমিত বিবাদবহ্নি নির্ব্বাণলাভ করিল, তাহার জন্য ইতিহাস একবারও সিরাজদ্দৌলাকে সাধুবাদ প্রদান করে নাই;—বরং প্রকৃত কাহিনী গোপন করিয়া লিখিয়া রাখিয়াছে যে, “সিরাজদ্দৌলার কথা আর অধিক কি বলিব; তিনি সিংহাসনে পদার্পণ করিবামাত্র আপন পিতৃব্যরমণীর সর্ব্বস্ব লুণ্ঠন করিয়াছিলেন।[১৬]

  1. Stewart's History of Bengal.
  2. There was an Hospital in Calcutta, which many entered but few came out of to give an account of their treatment.— Hamilton
  3. Revd. Long.
  4. Complaints were made in 1755 that owing to the washing of people and horses in the great tank, it is so offensive at times, there is no passing to the Southward or Northward.-Ravd. Long:
  5. In 1762 an order was issued, to clear the town of jungle.com —Retd. Long.
  6. উমিচাঁদ বিকৃত নাম। পুরাতনগ্রন্থে আমিরাচাঁদ ও আমিসচাঁদ নাম এবং হস্টারের এ উমাচরণ নাম দেখা গিয়াছে। নবাবী আমলের বালার ইতিহাসে অমিচার নাম পরিগৃহীত হইয়াছে। এরূপ ক্ষেত্রে সহ প্রচলিত উমিচাঁদ নাম বিকৃত হলেও গ্রহণ করা ভাল।
  7. The extent of his habitation, divided into various departments, the number of his servants continually employed in various occupa. tions, and a retinue of armed men in constant pay, resembled more the estate of a prince, than the condition of a merchant. -Orme, vol. II. 5o.
  8. He had acquired so much influence with the Bengal Government that the Presidency, in times of difficulty, used to employ his mediation with the Nabab.-Orme. vol. II. 50.
  9. His last advice to his grandson was to deprive the English of military power.-Holwell's Tracts.
  10. It was unfortunate, Mr. Watts had neglected to inform the precedence of the complaints which Shiraj-Daula had made.-Orme, vol. I. 55.
  11. Sometime before Kasimbazar was attacked, Mr. Watts acquainted the Governor and Council that he was told from the Durbar, by order of the Nabab, that he had great reason to be dissatisfied with the late conduct of the English in general. Besides he had heard they were building new fortifications near Calcutta without ever applying to him or consulting him about it, which he by no means approved of; for he looked upon us only as a set of merchants, and therefore if we chose to reside in his dominions under that denomination we were extremely welcome, but as prince of the country he forthwith insisted on the demolition of all those new buildings we had made-Hastings’ MSS. in the British Museum, vol. 29.209.
  12. Hasting's MSS. vol. 29.209. “The Nabab at the same time sent to the President and Council, Fuckeer Tougar, with a mes- sage much to the same purport, which as they did not intend to cemply with, looking upon 'it as a most unprecedented demand, treated the messenger with a great deal of ignoming and turned him out of their bounds without any answer at all.”
  13. শ্রীযুক্ত বিহারীলাল সরকার “জন্মভূমিতে” লিখিয়াছেন যে, স্বয়ং রামরাম সিংহই এই দৌত্য-কার্য্যে গমন করিয়াছিলেন। আমরা কিন্তু কোনস্থানে তাহার নিদর্শন পাইলাম না।
  14. ইংরাজদিগের উকীল তৎকালে এইরূপ মৰ্মেই নবাব-দয়ারে ‘কৈফিয়ৎ প্রদান করিয়াছিলেন। সেই উকীলের ওকালতি এখন ইতিহাসেও খালাত করিয়াছে।
  15. The Governor returning the next day-summoned a Council of which the majority being prepossessed against Omichand, con- cluded that the messenger was an engine prepared by himself to alarm them, and restore his own importance; and as the last ad- rices received from Kashimbasar described the event between Shirajudoula and the widow of Nowagis to be dubious, the Council resolved that both the messenger and his letter were too suspicious to be received, and the servants, who were ordered to bid hiſ departeluined him out of the Factory and off the shore with in- molence and derision; but letters were despatched to Mr. Watts instructing him to guard against any evil consequences from this proceeding. Orme, Vol. II. 54.
  16. এই ঘটনা যে ইংরাজদিগের কৈফিয়ৎ পাইবার পরে সংঘটিত হয়, ইংরাজ লেখকেরা তাহা প্রকারান্তরে স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাসেও তাহা স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু ব্যঙ্গচ্ছলে ইহাও লিখিয়াছেন,—“তথাপি পরমাত্মীয় ভগ্নীপুত্র মাতৃস্বসাকে অন্তঃপুরে আনাইবার অধিকারী, ইত্যাদি কথায় সিরাজের সমস্ত অত্যাচার সমর্থন করিতে যাওয়া বিড়ম্বনা মাত্র।” কৌতুকের বিষয় এই যে, ধনরত্ন সহ মাতৃস্বসাকে রাজান্তঃপুরে আনয়ন করা ভিন্ন আর কোন অত্যাচার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও লিপিবদ্ধ করেন নাই। রাজবল্লভের সহিত সন্ধিসুত্রে বিনা রক্তপাতে যে এই ঘটনা সংঘটিত হয়, তাহারও উল্লেখ করা প্রয়োজন বলিয়া বিবেচিত হয় নাই। উপরন্তু বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় লিখিয়াছেন যে, এরূপ বিনা রক্তপাতে উদ্দেশ্য সাধনের বাহাদুরী প্রবীণ মন্ত্রিদলের—সিরাজদ্দৌলার নহে। সেই কথার সমর্থন জন্য বলিয়াছেন যে, এই ঘটনার পরে প্রবীণ মন্ত্রিদল পদচ্যুত হন। কিন্তু এরূপ অনুমাণের ভিত্তি কোথায়, তাহা প্রদর্শিত হয় নাই। সিরাজ কাহারও কথায় কর্ণপাত করিতেন না, ঔদ্ধত্যবশতঃ যাহা মনে করিতেন, তাহাই করিতেন—ইহা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় একাধিকবার বর্ণনা করিয়া মুতক্ষরীণ হইতে প্রমাণ উদ্ধৃত করিয়াছেন। তাহা সত্য হইলে, মতিঝিল অধিকারের বাহাদুরী সিরাজেরই প্রাপ্য হইয়া পড়ে। তদ্বারা বন্দ্যোপাধ্যায়-বর্ণিত সিরাজচিত্র খণ্ডিত হইয়া যায় বলিয়াই কি এস্থলে প্রবীণ মন্ত্রিদলের উপদেশের অবতারণা করা হয় নাই?