সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/কাশিমবাজার অবরোধ

উইকিসংকলন থেকে

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।


কাশিমবাজার অবরোধ।

 মুসলমানের পুরাতন রাজধানী মুর্শিদাবাদের সৌভাগ্য-কাহিনী কাল- ক্রমে জনশ্রুতিমাত্রে পর্য্যবসিত হইয়াছে। কিন্তু সিরাজদ্দৌলার সময়ে তাহার বড়ই গৌরবের অবস্থা ছিল। ভাগীরথীতীর-সমাশ্রিত সুরচিত, পুষ্পেদ্যান, এবং তন্মধ্যবর্তী উভয়-তটান্তমিলিত সুগঠিত অট্টালিকাশ্রেণী সেকালের মুসলমান রাজধানীকে গৰ্বোন্নত বৃটিশ রাজনগরী লণ্ডনের মতই সৌভাগ্যশালী করিয়া তুলিয়াছিল; বরং লণ্ডন অপেক্ষা মুর্শিদা- বাদের ধনগৌরব যে সমধিক স্মৃত্তিলাভ করিয়াছিল, সেকালের ইংরাজ রাজপুরুষেরাও তাহা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।[১]

 এই মোগল রাজধানীতে কোনরূপ রাজদুর্গ ছিল না; কয়েকটি নগর-তোরণ ভিন্ন পুরীরক্ষার জন্য প্রাচীর পর্যন্তও দেখিতে পাওয়া যাইত না। মোগলের প্রবল প্রতাপ চূর্ণ করিয়া কেহ যে সহসা বাহুবলে রাজধানী অধিকার করিতে সাহস পাইবে, এমন কথা স্বপ্নেও কল্পনায় স্থান পাইত না।

 রাজধানীর এইরূপ অরক্ষিত অবস্থার সন্ধান পাইয়া লুণ্ঠনলোলুপ মহারাষ্ট্রসেনা যখন সত্যসত্যই নগর আক্রমণ পূর্ব্বক জগৎশেঠের ভাণ্ডার পর্যন্ত লুঠিয়া লইয়া গেল, তখন কাহারো কাহারো কথঞ্চিৎ চেতনা হইয়াছিল। কিন্তু আলিবর্দ্দী সে দিকে লক্ষ্য না করিয়া, স্বস্ব ধনপ্রাণ- রক্ষার জন্য প্রজাসাধারণকে স্বাধীনতা প্রদান করিয়াই নিরস্ত হইয়া- ছিলেন; রাজধানীরক্ষার জন্য কোনরূপ আয়োজন আরব্ধ হয় নাই। আর কেহ কিছু করুক না করুক, সুচতুর বৃটিশ বণিক সেই সুযোগে কাশিমবাজারের বাণিজ্যাগারের চারি দিকে প্রাচীর গাঁথিয়া, কামান পাতিয়া,সিংহদ্বার সাজাইয়া, একটি ছোট খাট রকমের দুর্গরচনা করিয়া- ছিলেন। কালক্রমে তাহা ধূলিপরিণত হইয়াছে। কেবল স্থান-নির্দেশের জন্য কতকগুলি স্বচ্ছন্দবনজাত তীরতরু সগৌরবে আকাশে অঙ্গ বিস্তার করিয়া দৃঢ়পদে দণ্ডায়মান রহিয়াছে; ভাগীরথী-স্রোত সসম্রমে তাহার নিকট হইতে বহুদূরে প্রস্থান করিয়া,ধ্বংসাবশিষ্ট ইংরাজদুর্গের পরিত্যক্ত ভিত্তিভূমি আরও ভীষণতর করিয়া তুলিয়াছে।[২]

 এই ইংরাজ-দুর্গটি সমচতুষ্কোণ না হইলেও দেখিতে প্রায় চতুষ্কোণ বলিয়াই বোধ হইত। চারি দিকে দৃঢ়োন্নত দুর্গ প্রাচীর, প্রাচীর-সংলগ্ন চারিটি সুদৃঢ় বুরুজ, প্রত্যেক বুরুজে দশটি করিয়া কামান পাতা; নদীর দিকে প্রাচীরের উপর দিয়া সারি সারি বাইশটি কামান, এবং সিংহদ্বারের উভয় পার্শ্বে দুইটি বৃহদায়তন আগ্নেয়াস্ত্র নিরন্তর বদনব্যাদান করিয়া বৃটিশ-বণিকের সমর-কৌশলের পরিচয় প্রদান করিত।“সেলামীর তোপ” বলিয়া ইংরাজেরা আরো অনেকগুলি তোপ আনাইয়া দুর্গমধ্যে সাজাইয়া রাখিয়াছিলেন; যুদ্ধকলহ উপস্থিত হইলে, তাহাতেও গোল- বর্ষণ করিবার সুবিধা হইতে পারিত। এই সকল কারণে কাশিমবাজারের ইংরাজদুর্গ সহসা হস্তগত করিবার সম্ভাবনা ছিল না।[৩]

 এই ক্ষুদ্রকায় ইংরাজদুর্গে উইলিয়ম ওয়াটস, কলেট, ব্যাটসন, সাই- কস, এইচ ওয়াটস, চেম্বার্স, ওয়ারেণ হেষ্টিংস প্রভৃতি ইংরাজ কর্ম্ম- চারিগণ বাস করিয়া কোম্পানী বাহাদুরের বাণিজ্য ব্যবসায়ের ভিত্তি মূল রক্ষা করিতেন;—দুর্গরক্ষার জন্য লেফটেনাণ্ট ইলিয়টের অধীনে কতকগুলি গোলন্দাজ সেনা দুর্গমধ্যে পদচারণ করিয়া বেড়াইত।[৪]

 একজন ইংরাজ ইতিহাসলেখক বলিয়া গিয়াছেন যে, সিরাজদ্দৌলা কাশিমবাজার অবরোধ করিতে না করিতেই ইংরাজেরা নির্ব্বিবাদে দুর্গত্যাগ করিয়া নবাবের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন।[৫] এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নহে। বিলাতের ‘বৃটিশ মিউজিয়মে’ কাশিমবাজার অবরোধের একখানি হস্তলিখিত ইতিহাস আছে, কেহ কেহ বলেন যে, তাহা ওয়ারেণ হেষ্টিংসের রচিত। মুর্শিদাবাদের ভূতপূর্ব্ব বিচারপতি বিভারিজ্ মহোদয় তাহার কিয়দংশ এ দেশে প্রকাশিত করিয়া[৬] অনেকের ভ্রম সংশোধন করিয়া দিয়াছেন। যাহারই রচিত হউক, সেগুলি যে ইংরাজলিখিত সমসাময়িক আত্মকাহিনী, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাহা শ্রেণীবদ্ধ ইতিহাস নহে, সুতরাং কোন বিশেষ মতসংস্থাপনের জন্য কিম্বা একজনের দোষে আর একজনেকে অপরাধী করিবার জন্য কোনরূপ প্রয়াস স্বীকার করিতে হয় নাই। ইংরাজ লেখনীর যদৃচ্ছোৎগত সাময়িক কাহিনী বলিয়া সেগুলি যথার্থই সমধিক সমাদরের সামগ্রী।

 কাশিমবাজারের ইংরাজ সওদাগরেরা সকলেই জানিতেন যে, তাঁহারা ঘসেটি বেগমের পক্ষপাতী বলিয়া, আজি হউক, কালি হউক, আর দশ দিন পরেই হউক, বৃদ্ধ নবাবের মানব লীলা অবসানপ্রাপ্ত হইলেই, সিরাজদ্দৌলার সহিত তাহাদিগের তুমুল সংঘর্ষের সূত্রপাত হইবে! সেই জন্য সময় থাকিতে তাঁহারা গোপনে গোপনে কাশিমবাজারের ইংরাজদুর্গে সাধ্যমত গুলি গোলা সংগ্রহ করিতে ত্রুটি করেন নাই। এইরূপে কাশিমবাজারে যে সকল যুদ্ধসরঞ্জাম পুঞ্জীভূত হইয়াছিল, তাহার কথা স্মরণ করিয়া উত্তরকালে কাপ্তান গ্রাণ্ট কতই আক্ষেপ করিয়া গিয়াছেন।[৭]

 ঘসেটি বেগমকে বশীভূত করিয়াই সিরাজদ্দৌলা নিশ্চিন্ত হইবার অবসর পাইলেন না। উত্তরে পূর্ণিয়াধিপতি শওকতজঙ্গ, এবং দক্ষিণে কলিকাতাবাসী উদ্ধত ইংরাজ তখনো প্রবল স্পর্ধায় তাঁহার রাজশক্তিকে উপহাস করিতে ছিলেন। সুতরাং সিরাজদ্দৌলা রাজধানীর ষড়যন্ত্র চূর্ণ করিবামাত্র, পূর্ণিয়ার ষড়যন্ত্র চূর্ণ করিবার জন্য সসৈন্যে রাজমহলের পথে পূর্ণিয়াভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। গমনকালে কলিকাতাবাসী উদ্ধত ইংরাজকে পুনরায় তর্জ্জন গর্জ্জন করিয়া লিখিয়া পাঠাইলেন যে, “ইংরাজ-গবর্ণর ড্রেক সাহেব পত্রপাঠ দুর্গপ্রাচীর চূর্ণ না করিলে সিরাজদ্দৌলা সশরীরে শুভাগমন করিয়া ড্রেক সাহেবকে ভাগীরথীগর্ভে নিক্ষেপ করিবেন।”[৮]

 যথাকালে এই পত্র ইংরেজ-দরবারের হস্তগত হইল। তাঁহারা এত দিন মহারাজ রাজবল্লভ এবং ঘসেটি বেগমের মুখের দিকে চাহিয়া, সিরাজদ্দৌলার প্রেরিত সন্ত্রান্ত রাজদূতদিগকে অপমান করিয়া নগর বহিষ্কৃত করিতে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ করেন নাই; রাজলিপি পাইয়াও তাহার প্রত্যুত্তর প্রদান করা আবশ্যক বলিয়া স্বীকার করেন নাই; কিন্তু এখন সেই সিরাজদ্দৌলা আবার তর্জ্জন গর্জ্জন করিয়া পত্র লিখিতেছেন দেখিয়া, সকলেই আতঙ্কযুক্ত হইলেন। এবার পত্রোত্তর প্রদত্ত হইল, কিন্তু তাহাতে প্রকৃত প্রস্তাবের কিছুমাত্র উত্তর প্রদত্ত হইল না।

 মহামতি ড্রেক লিখিয়া পাঠাইলেন যে, “সর্ব্বৈব মিথ্যা কথা। কে বলিল যে, ইংরাজেরা কলিকাতায় নগর-প্রাচীর রচনা করিতেছেন? ফরাসীদিগের সঙ্গে আবার যুদ্ধ বাধিবার সম্ভাবনা হইয়াছে, কেবল সেই আশঙ্কায় নদীতীরের কামান পাতিবার স্থানগুলি মেরামত করা হই তেছে।”[৯] ড্রেক সাহেবের এইরূপ প্রত্যুত্তরে ইংরাজ ইতিহাসলেখকও সন্তুষ্ট হইতে পারেন নাই। তিনিও লিখিয়া গিয়াছেন যে, সিরাজদ্দৌলা ইংরেজদিগের উপর যেরূপ খড়্গহস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন, তাহাতে এরূপ সময়ে এই প্রকার প্রত্যুত্তর প্রেরণ করা যুক্তিসঙ্গত হয় নাই।[১০]

 ইহারই নাম “ধান ভানিতে মহীপালের গীত।” ইংরাজেরা বাগবাজারের নিকট পেরিং নামক একটি নূতন দুর্গপ্রাকার রচনা করিয়াছিলেন, এবং কলিকাতার ইংরাজদুর্গে ইচ্ছানুরূপ সংস্কারকার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন, অথচ তাহার কোন কার্য্যের জন্যই সিরাজদ্দৌলার অনুমতির অপেক্ষা করেন নাই। সিরাজদ্দৌলা তাঁহাদিগকে পুরাতন দুর্গ চূর্ণ করিতে বলেন নাই, বাগবাজারের নিকট যে নূতন দুর্গ-প্রাকার রচিত হইয়াছিল, তাহাই চুর্ণ করিতে বলিয়াছিলেন। ড্রেক সাহেব তাহার সম্বন্ধে রাম গঙ্গা বিষ্ণু কোন কথাই দন্তস্ফুট করিলেন না।

 উদ্ধত ইংরাজের কুটিল কৌশল সিরাজদ্দৌলার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধূলি নিক্ষেপ করিতে পারিল না। তিনি যখন রাজমহল পর্য্যন্ত আসিয়া পৌঁছিয়াছেন, সেই সময়ে ড্রেক সাহেবের পত্রখানি তাঁহার হস্তগত হইল। পত্র পড়িয়া সিরাজদ্দৌলা একেবারে আগুন হইয়া উঠিলেন, পাত্রমিত্র আত্মীয় অন্তরঙ্গ,—যাহারা তাঁহার কাছে দাঁড়াইয়া ছিলেন, কেহই সাহস করিয়া বাঙ্নিষ্পত্তি করিতে পারিলেন না।[১১] সিরাজদ্দৌলা গর্জ্জন করিয়া উঠিলেন;—অভিমানিনী কালসাপিনী পদাহতা হইয়া যেমন সফেন হলাহলকণা বিকিরণ করিতে করিতে ঊর্দ্ধ-শিরে গর্জ্জন করিয়া উঠে, সেইরূপ তীব্র তেজে গর্জ্জন করিয়া উঠিলেন। সমুদয় হস্ত্যশ্ব রথ পদাতি আজ্ঞামাত্রে পটমণ্ডপ উঠাইয়া লইয়া আবার মুর্শিদাবাদ অভিমুখে মহাকলরবে ধাবিত হইল; সকলেই বুঝিল যে, এবার আর ইংরাজের নিস্তার নাই! এই মুহূর্ত্ত হইতে সিরাজদ্দৌলার ইতিহাস রুধির-কর্দ্দমে কলঙ্কিত হইবার সুত্রপাত হইল। রাজমহলের পটমণ্ডপে উদ্ধত ইংরাজের অসংযত লেখনী সিরাজদ্দৌলার অদৃষ্ট ক্ষেত্রে যে বিষবৃক্ষের বীজ বপন করিল, সিরাজদ্দৌলার পরবর্ত্তী জীবনকাহিনী কেবল সেই বিষবৃক্ষের ক্রমবিকাশের শোচনীয় ইতিহাস![১২]

 জগতের স্বাধীন নরপতিদিগের তুলনা লইয়া সিরাজদ্দৌলার এই রাজরোষের সমালোচনা করিতে হইলে কেহই তাঁহাকে ভর্ৎসনা করি বার অবসর পাইবেন না। সিরাজদ্দৌলা যেরূপ উত্ত্যক্ত হইয়া ইংরাজের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হইয়াছিলেন, তাহা অপেক্ষা কত তুচ্ছ কথা লইয়া গায়ে পড়িয়া ইংরাজ-রাজ এই জ্ঞানোজ্জল যুক্তিতর্ক-পরিচালিত ঊনবিংশ শতাব্দীতেও কত দেশে কত লোমহর্ষণ ভীষণ দাবানল প্রজ্বলিত করিতে বাধ্য হইতেছেন। রাজশক্তি চিরদিনই প্রভুশক্তি; শত্রু হউক আর মিত্র হউক, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রবল পরাক্রান্ত স্বাধীন নরপতি হউক, আর পদাশ্রিত দীনহীন দুর্ব্বল প্রজাই হউক, —যে কেহ সমুন্নত রাজশক্তির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিবে,তাহাকেই পদানত করিবার জন্য রাজরোষ উৎক্ষিপ্ত হইয়া উঠিবে। ইহাই সকল দেশের রাজধর্ম্ম। সিরাজদ্দৌলা সেই ধর্ম্মের মর্য্যাদারক্ষার্থ পদাশ্রিত ইংরাজ বণিকের ধৃষ্টতার সমুচিত প্রতিফল প্রদান জন্য তাঁহাদিগের কাশিমবাজারের ক্ষুদ্র দুর্গ অবরোধ করিবার আদেশ প্রদান করিলেন।

 কি কি ঘটনাপরম্পরায় নিতান্ত উৎপীড়িত হইয়া সিরাজদ্দৌলা কাশিমবাজার অবরোধ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, অনেকে অনেক কারণে তাহার মূলানুসন্ধান করা আবশ্যক বলিয়া বিবেচনা করেন নাই। সুতরাং তাঁহাদিগের ইতিহাসে ‘কাশিমবাজার অবরোধ’ ও যে সিরাজ দ্দৌলার কলঙ্কসংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছে, তাহাতে কিছুমাত্র বিস্ময়ের কারণ নাই। কিন্তু, সিরাজদ্দৌলা নিতান্ত উত্ত্যক্ত হইয়াও কিরূপ সুকৌশল পূর্ণ সহিষ্ণুতা প্রকাশপূর্ব্বক বিনা রক্তপাতে কাশিমবাজার হস্তগত করিয়াছিলেন, তাহার আলোচনা করিলেই সত্যনির্ণয় করিতে আর ক্লেশ স্বীকার করিতে হইবে না।

  ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দের ২৪শে মে সোমবার অপরাহ্ণে উমরবেগ জমাদার তিন সহস্র অশ্বারোহী লইয়া কাশিমবাজারে উপনীত হইয়া নীরবে শিবির-সন্নিবেশ করিলেন। নবাবের সিপাহী সেনা প্রায় মধ্যে মধ্যে এরূপভাবে কাশিমবাজারে শিবির-সন্নিবেশ করিত; সুতরাং সেদিন আর কেহ কোনরূপ কৌতুহল প্রকাশ করিলনা। রজনী প্রভাত হইতে না হইতে আরো দুই শত অশ্বারোহী এবং কতকগুলি বরকন্দাজ আসিয়া উমরবেগের শিবিরে মিলিত হইল; এবং সন্ধ্যার পূর্ব্বে দুইটি সুশিক্ষিত রণহস্তী হেলিতে দুলিতে কাশিমবাজারে শুভাগমন করিল। ইহাতেই ইংরাজদিগের প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল! তাঁহারা কিরূপভাবে নবাবের সন্ত্রান্ত রাজদূতকে কলিকাতা হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিয়াছিলেন, সে কথা কাহারও অপরিজ্ঞাত ছিল না; সুতরাং একে একে দুই একটি করিয়া, সুচতুর ইংরাজ-কুঠিয়াল ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন।[১৩] যাঁহারা দুর্গমধ্যে রহিলেন, তাঁহারা সকলেই মনে করিলেন যে, এতদিনে প্রায়শ্চিত্তকাল সমুপস্থিত হইয়াছে;—যেমন রজনীর অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া আসিবে, অমনি নবাবসেনা বলপূর্ব্বক দুর্গ প্রবেশ করিয়া ইংরাজদিগকে ধনেবংশে বিনাশ করিয়া তীব্র প্রতিহিংসা সাধন করিবে। তখন দুর্গমধ্যে কেবল ৩৫ জন গোরা আর ৩৫ জন কালা সিপাহী, আর জন কত লস্কর ভিন্ন অধিক সেনাবল ছিল না। তাহারাই অগত্যা তুরী ভেরী বাজাইয়া, শিরস্ত্রাণ বঁধিয়া, কোমরবন্ধ আঁটিয়া, তালে তালে পা ফেলিতে ফেলিতে, বন্দুকের উপর সঙ্গীন চড়াইয়া সগর্ব্বে সিংহদ্বার রোধ করিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু সিপাহীরা সেদিনও দুর্গ আক্রমণের কোনরূপ আয়োজন করিল না; বরং জমাদার উমরবেগ নখাগ্রগণনীয় ইংরাজ সেনাগণকে সগর্ব্বে পদচালনা করিতে দেখিয়া সূচনাতেই বলিয়া পাঠাইলেন যে, তিনি যুদ্ধ করিতে আসেন নাই। সে কথায় কেহ কর্ণপাত করিল না। ওয়াট্‌স্ সাহেব আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া অক্ষুন্ন অধ্যবসায়ে সমুদয় রজনী অন্নপান, সংগ্রহ করিতে লাগিলেন; অগণিত নবাবসেনা বাহুবলে দুর্গ আক্রমণ করিলে, তাঁহারাও যে বাহুবলে আত্মরক্ষা করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করিবেন না, তাহারই আভাস প্রদান করিতে লাগিলেন, এবং সেই উদ্দেশ্যে বড় বড় কামানে গুলি, গোলা, বারুদ বোঝাই করিয়া, আক্রমণ প্রতীক্ষায় সিংহদ্বার রোধ করিয়া সসৈন্যে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

 সোম, মঙ্গল, বুধ চলিয়া গিয়াছে। বৃহস্পতিবারও চলিয়া যায়। প্রাচীরের বাহিরে সিপাহী সেনা কাতারে কাতারে সমবেত হইতেছে, ইচ্ছা করিলে এখনি কাশিমবাজারের ক্ষুদ্র দুর্গ ধূমপুঞ্জে সমাচ্ছন্ন করিয়া মুহর্ত্তমধ্যে ভস্মাবশেষ করিতে পারে। অথচ একজন সিপাহীও বন্দুক উঠাইতেছে না কেন? ইংরাজগণ একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। অবশেষে এরূপ নিদারুণ উৎকণ্ঠা অসহ্য হইয়া উঠিল;—ব্যাপার কি, তাহা নির্ণয় করিবার জন্য সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া ডাক্তার ফোর্থকে উমরবেগের নিকট পাঠাইয়া দিলেন।

 ডাক্তার সাহেব যথাকালে দুর্গমধ্যে প্রত্যাগমন করিলে প্রকৃত তথ্য প্রকাশিত হইয়া পড়িল। সকলেই শুনিল যে, ওয়াট্‌স্‌ সাহেবকে নবাব দরবারে হাজির হইয়া একখানি মুচলিকা-নামা লিখিয়া দিতে হইবে; সহজে সম্মত না হইলে তাঁহাকে বলপূর্ব্বক ধরিয়া লইয়া যাইবে,—সেই জন্যই এত সৈন্যসামন্ত সম্মিলিত হইয়াছে। কৌতুহল নিবৃত্ত হইল বটে, কিন্তু উৎকণ্ঠা দূর হইল না। উমরবেগের কথার উপর নির্ভর করিয়া ওয়াট্‌স্ সাহেব আত্মসমর্পণ করিতে সাহস পাইলেন না। নবাবের অভিপ্রায় কি, তাহা জানিবার জন্য যথাবিহিত সম্মান পুরঃসর আবেদনপত্র প্রেরিত হইল। তাহাতে লিখিত হইল যে, নবাববাহাদুরের অভিপ্রায় অবগত হইতেই যাহা কিছু অপেক্ষা, তিনি যাহা বলিবেন, ইংরাজেরা তাহাতেই সম্মত হইবেন। যথাকালে কেবল এইমাত্র উত্তর আসিল;—“দুর্গ প্রাকার চুর্ণ করিয়া ফেল; তাহাই নবাবের একমাত্র অভিপ্রায়।”[১৪]

 ইংরাজেরা শিষ্টাচারের অনুরোধে লিখিয়াছিলেন যে, নবাববাহাদুর যাহা চাহিবেন, তাঁহারা তাহাতেই সম্মত হইবেন। এক্ষণে নবাব যাহা চাহিলেন, ওয়াট্‌স্ সাহেব তাহাতে শিহরিয়া উঠিলেন। তিনি জানিতেন যে, ইংরাজ-দরবার প্রাণান্তেও এরূপ ত্যাগস্বীকার করিতে প্রস্তুত নহেন। বাস্তবিক কলিকাতার ইংরাজ-দরবার সিরাজদ্দৌলাকে ভাল করিয়া চিনিতে পারেন নাই। তাঁহারা কাশিমবাজার অবরোধের সংবাদ পাইয়া বুঝিয়াছিলেন যে, ইহা হয় ত কিছু উৎকোচ উপঢৌকন আদায় করিবার নূতন কৌশল। সুতরাং যেমন বুঝিয়াছিলেন, সেই রূপ ভাবেই নবাবের মনস্তুষ্টিসাধনের আয়োজন করিয়াছিলেন। সিরাজদ্দৌলা বালক হইলেও দেশের রাজা;—এখন হয় ত তাঁহাকে, আর মোমের পুতুলে কি কাচের খেলেনায় প্রতারিত করা সহজ হইবে না, এমন কথা ইংরাজের উর্ব্বরমস্তিষ্কে স্থানলাভ করিল না! তাঁহারা পাত্রমিত্রদিকে হস্তগত করিলেন, চিরাভ্যস্ত মহাস্ত্রপ্রয়োগে ইচ্ছানুরূপ সন্ধি-স্থাপনের আয়োজন করিলেন। কিন্তু ইংরাজের কষ্ট-সঞ্চিত অর্থে ভূতের বাপের শ্রাদ্ধই সার হইল;—সিরাজদ্দৌলা বিচলিত হইলেন না।

 ইংরাজের অনন্যোপায় হইয়া দেওয়ান রাজবল্লভকে[১৫] ধরিয়া পরামর্শ করিতে বসিলেন। দেওয়ানজী সিরাজদ্দৌলার আকার প্রকার দেখিয়া স্পষ্টই বুঝিয়াছিলেন যে, এবার আর মন্ত্রৌষধিতে কুলাইবে না; তিনি বলিলেন যে, ওয়াট্‌স্ সাহেব যদি হাতে রুমাল বাঁধিয়া হীনবেশে সিরাজদ্দৌলার নিকট উপস্থিত হইতে সাহস পান, তবে তিনি একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে পারেন।[১৬] ওয়াট্‌স্ সাহেব বিলক্ষণ ইতস্ততের মধ্যে পড়িলেন।

 জগৎশেঠ প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত পাত্রমিত্রদিগের সহায়তা লাভ করিয়াও ইংরাজ-বণিক সিরাজদ্দৌলার মনস্তুষ্টি করিতে পারিলেন না। তখন কলিকাতার ইংরাজ-দরবার নিতান্ত নিরুপায় হইয়া ওয়াট্‌স্‌কে সংবাদ পাঠাইলেন যে, আর কালবিলম্ব করিয়া কি হইবে; যাহাতে সিরাজদ্দৌলার মনস্তুষ্টি হয়, তাহাতেই সম্মত হইতে হইবে।[১৭] এই উপদেশ শিরোধার্য্য করিয়া ওয়াট্‌স্ সাহেব দেওয়ানজীর পরামর্শ মতেই নবাবদরবারের সম্মুখীন হইলেন।

 ওয়াট্‌স্‌ সাহেব নবাব-দরবারে উপনীত হইবামাত্র সিরাজদ্দৌলা ইংরাজদিগের উদ্ধত ব্যবহার লক্ষ্য করিয়া তাঁহাকে যৎপরোনাস্তি ভর্ৎসনা করিলেন; ওয়াট্‌স্‌ বাতাহতকদলীপত্রের ন্যায় থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন; কেহ কেহ ভাবিলেন যে, ইহার পর ত ওয়াট্‌স্‌ সাহেবকে ডালকুত্তার মুখে নিক্ষেপ করা হইবে। কিন্তু সিরাজদ্দৌলা ক্রোধান্ধ হইয়া আত্মকার্য্য বিস্মৃত হইলেন না। ওয়াট্‌স্‌কে স্বতন্ত্র পট-মণ্ডপে পাঠাইয়া দিয়া তাঁহাকে প্রস্তাবিত মুচলিকাপত্রে স্বাক্ষর করিবার জন্য আদেশ করা হইল। ওয়াট্‌স্‌ সাহেব আশু প্রাণদান পাইয়া ক্ষিপ্রহস্তে মুচলিক স্বাক্ষর করিয়া হাঁপ ছাড়িয়া পরিত্রাণলাভ করিলেন। “কলিকাতার নবপ্রতিষ্ঠিত পেরিং দুর্গপ্রাকার চূর্ণ করিতে হইবে; যে সকল বিশ্বাসঘাতক কর্ম্মচারী রাজদণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য কলিকাতায় পলায়ন করিয়া থাকে, তাহাদিগকে বাঁধিয়া আনিয়া দিতে হইবে; বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিবার জন্য ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানী যে বাদশাহী সনন্দ পাইয়াছেন, তাহার দোহাই দিয়া অন্য লোকেও বিনা শুল্কে বাণিজ্য চালাইয়া রাজকোষের যত ক্ষতি করিতেছে, তাহার পূরণ করিতে হইবে; এবং কলিকাতার জমীদার হল্ও‌য়েল সাহেবের প্রবল প্রতাপে, দেশীয় প্রজাবৃন্দ যে সকল নির্য্যাতন সহ্য করিতেছে, তাহা রহিত করিতে হইবে।”—এই মর্ম্মে মুচলিকাপত্র লিখিত ও স্বাক্ষরিত হইল।[১৮]

 ইতিহাসলেখকদিগের স্বকপোলকল্পিত বা আত্মস্বার্থ বিজৃম্ভিত সরস পদলালিত্য অপেক্ষা এই সকল কাগজপত্র অধিকতর মূল্যবান। ইহাতে সিরাজ-চরিত্রের যে পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহার সহিত ইতিহাস বর্ণিত সিরাজদ্দৌলার আকাশ পাতাল প্রভেদ। ইংরাজেরা পদাশ্রিত বণিক হইয়াও নবাবের বিনানুমতিতে যে দুর্গপ্রাকার রচনা করিয়াছিলেন, কোন্ স্বাধীন নরপতি তাহা চূর্ণ করিবার জন্য আয়োজন না করিতেন? ইহাতে সিরাজদ্দৌলার প্রবল প্রতাপ ও শাসনদার্ঢ্যই প্রকাশিত হইয়াছে। ইংরাজেরা পলায়িত রাজকর্ম্মচারীদিগকে নির্ব্বিবাদে কলিকাতায় আশ্রয় দিবার অবসর পাইলে নবাবের রাজশক্তিকে আর কেহ মুহূর্ত্তের জন্যও সম্মান করিত না, আবশ্যক হইলেই কলিকাতায় পলায়ন করিত। শাসনসংরক্ষণের জন্য অবশ্যই তাহার গতিরোধ করা আবশ্যক। কোম্পানীর নামের দোহাই দিয়া ইংরাজগণ যাহাকে তাহাকে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিবার পরোয়ানা বিক্রয় করিয়া আত্মোদর পরিপূর্ণ করিতেন; তাহাতে দেশের লোকের স্বাধীন বাণিজ্য অবসন্ন হইত, রাজকোষ শুল্কগ্রহণে অযথা বঞ্চিত হইত। এরূপ স্বেচ্ছাচার নিবারণ না করিলে কোন্ নরপতি সিংহাসনের অধিকারী বলিয়া গর্ব্ব করিতে পারিতেন। হলওয়েলের অত্যাচারে কালা বাঙ্গালী জর্জ্জরিত হইতেছিল, তাহার গতিরোধ করিবার চেষ্টা না করিলে কোন্ নিরপেক্ষ ইতিহাসলেখক সিরাজদ্দৌলাকে আশীর্বাদ করিতে সম্মত হইতেন? এই মুচলিকপত্রে সিরাজদ্দৌলার যেরূপ চরিত্র প্রকাশিত রহিয়াছে, কয় জন সৌভাগ্যশালী স্বাধীন নরপতি বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার মসনদে উপবেশন করিয়া সেরূপ চরিত্রবল, সেরূপ শাসন কৌশল, সেরূপ প্রজাহিতৈষণার পরিচয় প্রদান করিয়াছেন? তথাপি সিরাজদ্দৌলা ইংরাজের ইতিহাসে ইহার জন্যও শতধিক্কারে সম্বোধিত হইয়াছেন। আর আমরা তাহাকেই স্বদেশের ইতিহাস বলিয়া পরম সমাদরে পুস্তকালয় সুসজ্জিত করিতেছি![১৯]

 ৪ঠা জুন মুচলিকা-পত্র স্বাক্ষরিত হইয়া কাশিমবাজারের ইংরাজ দুর্গ সিরাজদ্দৌলার হস্তে সমর্পিত হইল। লেফ্‌টেনাণ্ট ইলিয়ট সেই অভিমানে আত্মহত্যা করিলেন। ওয়াট্‌স্‌ এবং চেম্বার্স্ মুচলিকার সর্ত্ত-পালনের জন্য প্রতিভূস্বরূপ মুর্শিদাবাদে অবস্থান করিতে বাধ্য হইলেন।[২০] কাশিম বাজার আবার শান্তমূর্ত্তি ধারণ করিল। যেরূপ সুকৌশলে বিনা রক্তপাতে এই সকল রাজকার্য্য সুসম্পন্ন হইল, কি ইংরাজ কি বাঙ্গালী কেহই তাহার মর্ম্মাস্বাদ করিয়া সিরাজদ্দৌলার শাসনপ্রতিভার গুণানুবাদ করিলেন না; বরং অনেকেই কুটিলকটাক্ষে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন যে, দুর্গ হস্তগত হইল, মুচলিক স্বাক্ষরিত হইল, ইংরাজ অপদস্থ হইল, তথাপি ওয়াট্‌স্ এবং চেম্বার্স্‌কে কারারুদ্ধ অপরাধীর ন্যায় মুর্শিদাবাদে বসাইয়া রাখা হইল কেন?

 সিরাজদ্দৌলা দেখিয়াছিলেন যে,কলিকাতার ইংরাজ দরবারই ইংরাজদিগের হর্ত্তা কর্ত্তা বিধাতা; কাশিমবাজারের কুঠিয়ালগণ নগণ্য রাজকর্ম্মচারিমাত্র,—সর্ব্বাংশে কলিকাতার মুখাপেক্ষী। সুতরাং কাশিমবাজারের ইংরাজ গোমস্তা যেরূপভাবে মুচলিকাপত্র স্বাক্ষর করিলেন, কলিকাতার ইংরাজ-দরবার তাহা স্বীকার না করা পর্য্যন্ত নিশ্চিন্ত হইহইবার উপায় নাই। অগত্যা কলিকাতার ইংরাজ-দরবারকে শাসনকৌশলে বশীভূত করিবার জন্যই ওয়াট্‌স্‌ ও চেম্বার্স্‌কে মুর্শিদাবাদে অবরুদ্ধ করিয়া রাখা হইল। ওয়াট্‌স্‌ এবং চেম্বার্স্‌ একপক্ষ মুর্শিদাবাদে অবস্থান করিলেন; এই সুদীর্ঘ অবসর পাইয়াও কলিকাতার ইংরাজ দরবার মুচলিকা সম্বন্ধে মতামত প্রদান করিলেন না।[২১] এ দিকে বিবি ওয়াট্‌স্‌ বেগমমণ্ডলীতে যাতায়াত করিয়া করুণ ক্রন্দনে সকলকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিলেন। বিবি ওয়াট্‌সের সঙ্গে সিরাজদ্দৌলার মাতার সখিত্ব ছিল। সেই সুবাদে করুণাময়ী সিরাজ-জননী বন্দিদ্বয়ের মুক্তিদানের জন্য সর্ব্বদা অনুরোধ জানাইতে লাগিলেন। অবশেষে মাতৃআজ্ঞা প্রতিপালন করিবার জন্য নিতান্ত অনিচ্ছাক্রমে সিরাজদ্দৌলা ইংরাজদ্বয়কে আপাততঃ মুক্তিদান করিতে বাধ্য হইলেন।

 একজন সমসাময়িক ইংরাজ-লেখক এই মুচলিকানামার সমালোচনা করিয়া লিখিয়া গিয়াছেন যে, “ফরাসীদিগের সঙ্গে বিবাদ বিসম্বাদের সম্ভাবনা থাকিতে মুচলিকপত্রের প্রথম সর্ত্ত পালন করা অসম্ভব; বাণিজ্যরক্ষা করিতে হইলে, মধ্যে মধ্যে পদাশ্রিত ইংরাজদিগকে আশ্রয়দান করা আবশ্যক হইয়া থাকে, সুতরাং দ্বিতীয় সর্ত্ত পালন করাও তথৈবচ। আর তৃতীয় সর্ত্ত পালন করিতে হইলেই যে অর্থদণ্ড প্রদান করিতে হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই; কারণ বিনা শুক্লে বাণিজ্য করিতে হইলেই কিঞ্চিৎ গোলযোগ ঘটিয়া থাকে।[২২]

 ইংরাজেরা যে মুচলিকা পালন করিবেন না, সে কথা অল্পদিনের মধ্যেই সিরাজদ্দৌলার কর্ণগোচর হইল। তিনি ইংরাজের কুটিল কৌশলের পরিচয় পাইয়া জ্বলিয়া উঠিলেন। ইঁহারাই না বলিয়াছিলেন যে, নবাবের অভিপ্রায় কি, তাহাই অবগত হইতে যাহা কিছু অপেক্ষা? ইঁহারাই না মুচলিকা পালন করিবেন বলিয়া বিবি ওয়াট্‌সের নয়নকজ্জলে ইংরাজ বন্দীর মুক্তিপত্র লিখাইয়া লইয়াছিলেন? সিরাজদ্দৌলা অনেক সহ্য করিয়াছেন; আর সহ্য করিতে পারিলেন না;—ইহাই তাঁহার সর্ব্বপ্রধান অপরাধ! তাঁহার রোষকষায়িত নয়নযুগল হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। মাতামহের অন্তিম উপদেশ স্মৃতিপটে অনল-অক্ষরে জ্বলিয়া উঠিল।[২৩] সুতরাং সিরাজদ্দৌলা আর আলস্যে কালক্ষয় না করিয়া, কলিকাতায় দূত পাঠাইয়া দিয়া স্বয়ং সসৈন্যে যুদ্ধযাত্রার অয়োজন করিতে লাগিলেন।

 সিরাজদ্দৌলা পদে পদে অপমানিত হইয়া যেরূপ উত্যক্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন, তাহা স্মরণ করিলে, কলিকাতা আক্রমণের জন্য তাঁহাকে ভর্ৎসনা করা যায় না। কিন্তু কলিকাতা আক্রমণই তাঁহার কাল হইল। তিনি যদি ইংরাজ-শক্তির সহিত সংঘর্ষ উপস্থিত না করিতেন, তাহা হইলে তাঁহার ইতিহাস কিরূপ আকার ধারণ করিত, তাহা কেহ বলিতে পারে না। নানাদিক হইতে নানা বিরুদ্ধ-শক্তি যেরূপভাবে কেন্দ্রীভূত হইয়া আসিতেছিল,ইংরাজদিগের উদ্ধত ব্যবহার তাহারই বাক্যস্ফূর্ত্তিমাত্র, সুতরাং বাহুবলে আত্মরক্ষা করিয়া রাজশক্তি সংস্থাপনের চেষ্টা না করিলেও যে সিরাজ-জীবন দীর্ঘস্থায়ী হইতে পারিত, তাহারই বা নিশ্চয়তা কি?

 সিরাজদ্দৌলা যে নিতান্ত নিরুপায় হইয়াই বাহুবলের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন, ইংরাজেরা সে কথা স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহেন। তাঁহারা আদ্যোপান্ত সকল কথা আলোচনা না করিয়াই লিখিয়া গিয়াছেন যে, “কাশিমবাজার হস্তগত করিয়া, ইংরেজদিগের কাকুতি মিনতি শ্রবণ করিয়া, নবাবের বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, ইংরাজ তাঁহার ভয়ে এতই জড়সড় হইয়াছেন যে, এ সময়ে বাহুবলে কলিকাতা আক্রমণ করিতে পারিলে সহজেই কার্য্যসিদ্ধি হইবে; ইংরাজদিগকে পরাজয় করিয়া যথেষ্ট অর্থ-লুণ্ঠনের সুবিধা হইবে; কেবল সেই জন্যই সিরাজদ্দৌলা কলিকাতা আক্রমণ করিতে ধাবিত হইয়াছিলেন।[২৪]


  1. The city of Muxudabad is as extensive, populous, and rich as the city of London, with this difference, that there are indivi- duals in the first possessing infinitely greater property thamizny in. the last city. Evidence of. Lord Clive before the Committee of the House of Cornmons-1772.
  2. There is a rough plan of the Fort in Tieffenthaler, 1. 453. plate_XXXl. শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন ‘স্বচ্ছন্দ বনজাত তীর তরু উদামতরুর বিক্রমে নিরাকৃত হইয়াছে। কিন্তু এই সকল পুরাতন বৃক্ষ সেদিন পর্য্যন্তও বর্তমান ছিল।’
  3. Captain Grant.
  4. Hastings' MSS. Vol. 29.209.
  5. He forthwith presented himself at the gate of the English factory at Cassimbazar, which immediately surrendered, without an effort being made to defend it.—Thornton's History of Britisi: Empire vol. I. 187.
  6. Calcutta Review.}}
  7. We may justly impute all our misfortunes to the loss of that place, (Cassimbazr) as it not only supplied our enemies with artillary and ammunition of all kinds, but flushed them with hopes of __l_ing as easy a conquest of our chief settlement.—Captain Grant.
  8. That unless upon receipt of that order, he (Mr. Drake) did not immediately begin and pull down those fortifications, he “would come down himself and throw him in the river.—Hastings Mss. vol., 29209.
  9. That the Nabab had been misinformed by those who had represented to him that the English were building a wall round the town, that they had dug no ditch since the invasion of the Marattas, at which time such a work was executed at the request of the Indian inhabitants, and with the knowledge and approbation of Aliverdy; that in the late war between England and France, the french had attacked and taken the town of Madras, contrary the neutrality, which it was expected would have been preserved in the Mogal's dominions; and that there being at present great appearance of another war between the two nations, the English were under apprehensions that the French would act in the same manner in Bengal;—to prevent which, they were repairing their line of guns on the bank of the river. —Ome, ii.-55-56}}
  10. I bid
  11. Stewart's History of Bengal.}}
  12. নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাসে লিখিত হইয়াছে;— ইহাতে ইংরাজগণের উপর আক্রোশ বৃদ্ধির কোন ন্যায়সঙ্গত কারণ দেখা যায় না।”(২১৬ পৃষ্ঠা।) আবার ২১২ পৃষ্ঠায় লিখিত হইয়াছে—“প্রেরিত দূতের অবমাননা ও দুর্গনির্ম্মাণব্যাপারে ইংরেজ অধ্যক্ষের প্রত্যুত্তর, সিরাজদ্দৌলার ক্রোধসঞ্চারের পক্ষে যথেষ্ট কারণ সন্দেহ নাই।”
  13. Hastings escaped at about the same time, and the Cassimbazar tradition, which is probably a true one, is that he owed his safety to his Dewan Kanta Babu, who concealed him in a room— H. Beverige, c.s. বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের মতে হেষ্টিংস এই সময়ে আড়ঙ্গে ছিলেন।
  14. Hastings'. MSS. vol. 29209
  15. “মহারাজা রাজবল্লভ, দুর্ল্লভরামের জ্যেষ্ঠপুত্র। সিরাজের রাজত্বকালেই পিতৃ-সাহায্যে ইনি খালসা রাঁই রায়ান অর্থাৎ দেওয়ানী পদে নিযুক্ত হন বলিয়া কথিত আছে। পিতাপুত্র উভয়েই ক্লাইবের যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিলেন। ক্লাইবও তজ্জন্ন বিশেষ কৃতজ্ঞ ছিলেন।”—সাহিত্য, ষষ্ঠ বর্ষ, ৬৯৭।}}
  16. Hastings' MSS. vol. 29209
  17. The Presidency were now very eager to appease the Subadar, they offered to submit to any condition which he pleased to impose. —Mill's History of British India Vol. III. 147.
  18. The purport of the Muchalka was nearly as follows:—
     To destroy the redoubt etc. newly built at Perrins near Calcutta; to deliver up any of his subjects that should fly to us for protection (to evade justice) on his demanding such subject; to give an account of the dastaks for several years past, and to pay a sum of money that should be agreed an, for the bad use made of them, to the great prejudice of his revenues, and lastly to put a stop to the Zemindar's (Holwell's) extensive power, to the great prejudice of his subjects.—Hastings' MSS. vol. 29209 ইহার শেষোক্ত সর্ত্তটি কিন্তু অন্য কোন ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায় না।
  19. এতদিনের পর বাঙ্গালী লিখিত নবাবী আমলের যে সুবৃহৎ ইতিহাস সঙ্কলিত হইয়াছে, তাহাতে এই সিদ্ধান্ত স্বীকৃত হয় নাই। সিরাজ অন্যের পরামর্শ গ্রহণের পাত্র ছিলেন না, তা পুনঃ পুনঃ লিখিয়াও, বিনা রক্তপাতে কাশিমবাজার অবরোধ সম্বন্ধে সিরাজকে তাঁহার অবশ্যপ্রাপ্য প্রশংসা প্রদত্ত হয় নাই!}}
  20. Hasting's MSS, vol. 29209.
  21. বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন, “কলিকাতা হইতে উত্তর আসিবার সময় দেওয়া হয় নাই।”
  22. Scrafton's Reflections.}}
  23. They who, we see are every day using all their policy and their power, against what they themselves say is the Law of the Most High are only to be restrained by force.
     An Enquirer into our National Conduct.
  24. The Subadar had a whish for a triumph, which he thought might be easily obtained; and he was greedy of riches, with which, in the imagination of the natives, Calcutta was filled.— Mill's History of British India, vol. iii. 147. মহম্মদ রেজাখাঁর দেওয়ানী আমলে সঙ্কলিত মজঃফর নামার উপর নির্ভর করিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও এই মত অবলম্বন করিছেন! নবাবী আমলের বাঙ্গালীর ইতিহাসে (২১৩ পৃষ্ঠায়) লিখিত হইয়াছে —“ইহাতে ইংরাজগণের উপর আক্রোশবৃদ্ধির ন্যায়সঙ্গত কোন কারণ দেখা যায় না।* * *সমস্ত বিচার করিয়া দেখিলে গোলাম হোসেনের মতেই বলিতে হয়, সিরাজের মস্তিষ্ক অহমিকার ধূমেই পূর্ণ ছিল।” ২৩৫ পৃষ্ঠায় এইমত পরিত্যাগ করিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় লিখিয়াছেন,—“ভবিষ্যতে ঐতিহাসিকগণ যাহাই বলুন, একথা অবশ্য স্বীকার্য্য যে, ইংরাজকর্ম্মচারিগণের হঠকারিতায় ক্রমাগত উত্যক্ত হইয়াই সিরাজদ্দৌলা ইংরেজ উৎখাতে বদ্ধ পরিকর হন; তরে কলিকাতা পর্য্যন্ত গিয়া ইংরেজ পীড়ন কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত হইয়া পড়িয়াছিল।” নবাবী আমলে বাঙ্গালার ইতিহাসের সর্ব্বত্র মত সামঞ্জস্য রক্ষিত হয় নাই।