সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/ইংরাজ বণিকের লাঞ্ছনা

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।


ইংরাজ বণিকের লাঞ্ছনা।

 বাল্যকাল হইতেই সিরাজদ্দৌলা ইংরাজদিগকে দুচক্ষে দেখিতে পারিতেন না। তিনি মনের ভাব গোপন না করিয়া সময়ে সময়ে ইংরাজ-বিদ্বেষের কথা নবাব-দরবারে প্রকাশ করিতেও ইতস্ততঃ করিতেন না। কালে ইংরাজের হাতে সোণার বাঙ্গালা রাজ্য যে ক্রীড়ার পুতুলের মত উচ্চ মূল্যে বিক্রীত হইবে, তাহা যেন সূচনাতেই সিরাজদ্দৌলা বুঝিতে পারিয়াছিলেন; সেইজন্য ইংরাজদিগের বাণিজ্য বিস্তৃতি এবং পদোন্নতি দেখিয়া তিনি ঈর্ষ্যা-কষায়িত লোচনে তীব্র প্রতিবাদ করিতেন।

 সিরাজ বাল্যকাল হইতেই ইংরাজ-চরিত্র অধ্যয়ন করিবার অবসর পাইয়াছিলেন। সেকালে নবাব-দরবারে ইংরাজ প্রতিনিধির যাতায়াত ছিল। নগরোপকণ্ঠে বাণিজ্যালয় স্থাপন করিয়া কাশিমবাজারের ইংরাজগণও সর্ব্বদাই ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেন। ইহাদের কার্য্যকলাপ দেখিয়া সিরাজের ইংরাজ-বিদ্বেষ দূর হইল না; বরং ইহাদের প্রত্যেক কার্য্যের মধ্যেই গূঢ় অভিসন্ধি দেখিয়া সিরাজদ্দৌলা মনে মনে ইংরাজদিগকে ঘৃণা করিতে শিক্ষা করিলেন। বাল্যসংস্কার সহজে দূর হইবার নহে; বয়োবৃদ্ধিসহকারে সিরাজের সেই বাল্যসংস্কার ক্রমেই ঘনীভূত হইতে লাগিল।

 হীরাঝিলের প্রমোদভবন নির্ম্মিত হইবার সময় হইতে সিরাজদ্দৌলা সেই স্থানে নিজ নামানুসারে “মন্‌সূরগঞ্জ”[১] নামে একটী গঞ্জ স্থাপন করিয়াছিলেন।[২] সেই গঞ্জের সমুদয় আয় তাঁহার করায়ত্ত ছিল; সুতরাং কিসে সেই গঞ্জের উন্নতি ও আয়বৃদ্ধি হইবে, তাহার জন্য সিরাজদ্দৌলা সর্ব্বদাই সাধ্যমত চেষ্টা করিতেন। দেশী বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি না হইলে গঞ্জের শ্রীবৃদ্ধি হইতে পারে না; ইংরাজদিগের প্রকাশ্য ও গুপ্ত বাণিজ্যে দেশীয় ব্যবসায়ীদিগের ক্ষতি হইয়া বিদেশীয়দিগের লাভের পথ যতই বিস্তৃত হইতে লাগিল, সিরাজদ্দৌলা বিদেশী বণিকদিগের উপর ততই অসন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। ফরাশী, দিনামার, ওলন্দাজ প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিকদিগের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিবার অধিকার ছিল না। সুতরাং তাহাদের প্রতিযোগিতায় দেশের লোকের বিশেষ ক্ষতি হইত না। কিন্তু ইংরাজগণ বিনাশুল্কে জলে স্থলে বাণিজ্য করিবার আদেশে বাদশাহের ফরমাণ পাইয়া নিঃসম্বল দেশীয় বণিকদের লাভের পথে কাঁটা দিয়াছে বলিয়া, ইংরাজদিগের উপরেই তাঁহার বিদ্বেষ বদ্ধমূল হইয়াছিল। বাদশাহের ফরমাণ পাইয়া কেবল যে ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানীই বিনাশুল্কে বাণিজ্য করিত—তাহা নহে। লাভের গন্ধ পাইয়া কোম্পানীর কর্ম্মচারীর আত্মীয় স্বজনেরাও এদেশে আসিয়া গোপনে গোপনে স্বাধীন বাণিজ্য করিতেন; এবং কোম্পানীর কর্ম্মচারীদিগের নিকট হইতে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করিবার পরোয়ান লইয়া তাঁহারাও দেশের লোকের অন্নগ্রাস কাড়িয়া খাইতেন। জন্ উড্ নামক এইরূপ একজন ইংরাজ বণিক কোম্পানীর নিকট বিনাশুল্কে বাণিজ্য করিবার পরোয়ানা চাহিয়া নিজ আবেদনপত্রে স্পষ্টই লিখিয়াছিলেন যে, স্বাধীন ইংরাজ বণিককেও কোম্পানীর ন্যায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করিবার জন্য পরোয়ানা না দিলে সর্ব্বনাশ হইবে![৩] বাদশাহের ফরমাণ অমান্য করিবার উপায় নাই, যতদিন ইংরাজ থাকিবে, ততদিন তাহারা বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিবে; সুতরাং ইংরাজদিগকে তাড়াইয়া দিতে না পারিলে দেশীয় বাণিজ্যের কখনই বৃদ্ধি হইবে না;—বোধ হয়, সেই জন্যই বালক সিরাজদ্দৌলা ইংরাজদিগকে তাড়াইয়া দিবার সুযোগ অনুসন্ধান করিতেন। সেনাপতি মুস্তফা খাঁ থাকিতে তিনি সিরাজের প্রস্তাব সমর্থন করিতেন; কিন্তু আলিবর্দ্দীর ভয়ে তিনিও ইংরাজ তাড়াইবার আয়োজন করিতে পারিতেন না। প্রস্তাব উঠিলেই আলিবর্দ্দী বলিতেন,—“মুস্তফা যুদ্ধব্যবসায়ী; যুদ্ধ বাধিলেই তাহার লাভ, তোমরা তাহার কথায় কর্ণপাত করিও না।”[৪]

 সিরাজের বিশ্বাস ছিল যে, সমস্ত “ফিরিঙ্গীস্থানে” দশ সহস্রের অধিক অধিবাসী নাই,[৫] এবং দেশে দেশে পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করাই তাহাদের একমাত্র জীবনোপায়। তাহাদের দেশে যে শিল্প আছে, বাণিজ্য আছে; রাজা আছে, রাজতন্ত্র আছে; সৈন্য আছে, সেনাপতি আছে; আবশ্যক হইলে সহস্র সহস্র বীরপুরুষ জীবন বিসর্জ্জন করিয়াও ইংলণ্ডের গৌরব-পতাকা রক্ষা করিবার জন্য অগ্রসর হইতে যে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ করিবে না, সিরাজদ্দৌলা বোধ হয় ততটা স্বীকার করিতেন না। আলিবর্দ্দী ইংরাজদিগের সহিত কলহ করিতে নিষেধ করিলে, সিরাজদ্দৌলা তাহার প্রকৃত কারণ বুঝিতে না পারিয়া বৃদ্ধ মাতামহকে ভীরু কাপুরুষ বলিয়া তিরস্কার করিতে ভীত হইতেন না। পরবর্ত্তী যুগে নেপোলিয়ান যাহাদিগকে “দোকানদারের জাতি’’ বলিয়া উপহাস করিয়া গিয়াছেন, তাহারা পূর্ব্ববর্ত্তী যুগে সিরাজদ্দৌলার চক্ষেও ততোধিক সম্মানের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হন নাই।

 আলিবর্দ্দী মহারাষ্ট্র-দমনে বিব্রত হইয়া ইংরাজদিগের অত্যাচারের কথা জানিয়া শুনিয়াও প্রতীকার করিবার চেষ্টা করিতেন না। বরং সিরাজদ্দৌলার ইংরাজ-বিদ্বেষের পরিচয় পাইয়া সময়ে সময়ে স্পষ্টই বলিতেন যে, “দুর্দ্দান্ত সিরাজ ইংরাজদিগের সঙ্গে শীঘ্রই কলহ বিবাদে লিপ্ত হইবে; এবং তাহা হইতেই কালে সিরাজের রাজ্য ইংরাজের করতলগত হইবে!” সিরাজদ্দৌলা কিন্তু সে কথায় কর্ণপাত করিতেন না। তাঁহার বিশ্বাস ছিল যে, সামান্য একটু তাড়া দিলেই বাণিজ্যের খাতাপত্র এবং মাল গুদাম ফেলিয়া ইংরাজ বণিক ভেড়ার পালের মত প্রাণ লইয়া পলায়ন করিবার পথ পাইবে না। সিরাজ একবার ইংরাজদিগকে তাড়াইয়া দিবার জন্য সত্য সত্যই নবাবের অনুমতি চাহিয়াছিলেন। নবাব প্রত্যুত্তরে কেবল এইমাত্র বলিলেন যে, “মহারাষ্ট্র সেনা স্থলপথে যে যুদ্ধানল জ্বালিয়া দিয়াছে, তাহাই নির্ব্বাণ করিতে পারি না, এ সময়ে ইংরাজের রণতরী যদি সমুদ্রে অগ্নিবর্ষণ করে, তাহা হইলে সে বাড়বানল কেমন করিয়া নির্ব্বাণ করিব?[৬]

 সেই সিরাজদ্দৌলা যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছেন শুনিয়া ইংরাজদিগের মধ্যে মহা আতঙ্ক উপস্থিত হইল। ইংরাজ তখনও কৃপাভিখারী বণিক মাত্র; নবাব-দরবারে তাঁহাদের পদগৌরব ছিল না। তাঁহারা কেবল অর্থগৌরবে আপনাদিগের বাণিজ্যাধিকার রক্ষা করিয়া আসিতেছিলেন। সেকালে উৎকোচের মহিমা বড়ই প্রবল ছিল। ইংরাজগণ সেই মন্ত্রৌষধির ব্যবস্থা করিয়া নবাবদিগকে ও নবাব-দরবারের পাত্রমিত্রদিগকে সর্ব্বদাই তুষ্ট করিয়া রাখিতেন। নবাবের মনস্তুষ্টি ও শুভদৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সময়ে সময়ে অনেক অপব্যয় করিতে হইত, এবং এত করিয়াও তাঁহারা নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেন না। হুগলীর ফৌজদার তাঁহাদিগের নিকট বৎসরে ২৭০০৲ টাকা পার্ব্বণি আদায় করিয়া লইতেন।[৭] ঢাকায় রাজবল্লভ তাঁহাদিগের কুঠী বন্ধ করিয়া, নৌকা আটক করিয়া, কুঠিয়ালদিগকে ফাটক দিয়া, খাদ্যদ্রব্য বন্ধ করিয়া, যথেচ্ছরূপে উৎকোচ আদায় করিয়া লইতেন।[৮] এই সকল কারণে ইংরাজগণ প্রাণের সঙ্গে মুসলমান-শাসন ভালবাসিতেন না, এবং মুসলমানগণও বণিকের জাতি বলিয়া ইংরাজদিগকে সেরূপ সম্মান দেখাইতেন না। মুসলমান সে সময়ে রাজা, ইংরাজ তাঁহাদের পদাশ্রিত, সামান্য প্রজা; উদরান্নের জন্য জন্মভূমি ছাড়িয়া, পিতামাতা ছাড়িয়া, সুখশান্তি ছাড়িয়া, অপরিচিত দেশে, অপরিচিত জাতির সঙ্গে, বাণিজ্য, ব্যবসায়ে মিলিত হইয়াছেন; সুতরাং মনের ভাব যাহাই থাকুক, বাহ্য ব্যবহারে মুসলমান নবাবকে ভক্তি শ্রদ্ধা জানাইতে ত্রুটি করিতেন না।

 বাঙ্গালীর নিকট আলিবর্দ্দী নিতান্ত নিরীহস্বভাব, প্রজাহিতৈষী, ধর্ম্মশীল নরপতি বলিয়া পরিচিত ছিলেন;[৯] কিন্তু কলিকাতার ইংরাজদিগের নিকটে তাঁহার সেরূপ প্রশংসা ছিল না। ১৭৪৯ খৃষ্টাব্দে ৯ই জানুয়ারী তারিখে ইংরাজদিগের কলিকাতাস্থ প্রধান কর্ম্মচারী বারওয়েল্ সাহেব নবাব-দরবার হইতে নিম্নলিখিত এক খানি পত্র পান;— “হুগলীর সৈয়দ, মোগল, আরমানী প্রভৃতি বণিকগণ অভিযোগ করিয়াছেন যে, তোমরা নাকি তাঁহাদের বহু লক্ষ টাকার পণ্যদ্রব্যপূর্ণ কয়েকখানি জাহাজ লুট করিয়া লইয়াছ। আণ্টনি নামক একজন মহাজন বহুলক্ষ টাকার পণ্যদ্রব্যের সঙ্গে আমার জন্য কতকগুলি মূল্যবান উপঢৌকন দ্রব্য আনয়ন করিতেছিলেন; শুনিলাম যে, সে জাহাজখানিও তোমরা লুটিয়া লইয়াছ। এই সকল মহাজনগণ রাজ্যের কল্যাণসাধন করিতেছেন, আমি তাঁহাদের অভিযোগ আর উপেক্ষা করিতে পারি না। আমি তোমাদিগকে বাণিজ্য করিতেই অধিকার দিয়াছি, দস্যুতা করিতে ক্ষমতা প্রদান করি নাই। এই রাজাদেশ পাইবামাত্র তোমরা যদি সহজে এই সকল ক্ষতিপূরণ না কর, তবে আমি বিশেষ কঠিন দণ্ডাজ্ঞা প্রদান করিব।”[১০]

 পত্র পাইয়া কলিকাতার ইংরাজগণ অনেক গুপ্ত মন্ত্রণা করিয়া প্রতিবাদপত্র পাঠাইলেন, অপরাধ অস্বীকার করিলেন; এবং অভিযোগকারী মহাজনদিগকে ধরপাকড় করিয়া মুক্তিপত্র লেখাইয়া লইবার জন্য নানারূপ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। কালবিলম্ব দেখিয়া নবাব ইংরাজবাণিজ্য বন্ধ করিয়া দিলেন; ইংরাজগণ অনন্যোপায় হইয়া জগৎশেঠের শরণাপন্ন হইলেন। ইহাতে সিরাজদ্দৌলা বড় আনন্দলাভ করিলেন। এতদিনের পর ইংরাজ তাড়াইবার সুযোগ উপস্থিত দেখিরা মাতামহকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন। কিন্তু জগৎশেঠের কৃপায় ইংরাজ বণিক সে যাত্রা রক্ষা পাইলেন; অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া ১২ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড দিয়া বাণিজ্যাধিকার ফিরিয়া পাইলেন।[১১]

 সিরাজদ্দৌলা যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াই রাজ্যপরিদর্শনে বাহির হইলেন। সে কালের ইংরাজদিগের সেরূপ সৈন্যবল ছিল না; অনুরোধ উপরোধে কার্যোদ্ধার না হইলে, তোষামোদ ও উৎকোচের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইত; বিলাতের কর্ত্তৃপক্ষগণও তাহারই সমর্থন করিতেন। নবাব-সরকারে কাহারও পদোন্নতি হইলে, তাঁহার শুভদৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নজর দিতে হইবে বলিয়া ইংরাজের মুখ শুকাইয়া উঠিত। সুতরাং সিরাজদ্দৌলার রাজ্যপরিদর্শনের সংবাদে ইংরাজের বড়ই আশঙ্কা উপস্থিত হইল।

 সিরাজদ্দৌলা হুগলীতে পদার্পণ করিবামাত্র অভ্যর্থনার সমারোহে চারিদিকে হৈ হৈ পড়িয়া গেল। ফরাশী এবং দিনামারগণ অগ্রসুচী হইয়া হুগলীতে আসিয়া সিরাজকে অভ্যর্থনা করিলেন। মহারাজ নন্দকুমার এবং খোজা বাজিদ তখন হুগলীর সর্ব্বেসর্ব্বা। তাঁহাদের অনুকম্পায় ফরাশী এবং দিনামার সিরাজদ্দৌলার শুভদৃষ্টি লাভ করিয়া ধন্য হইলেন। ইংরাজদিগকে অনুপস্থিত দেখিয়া হুগলীর ফৌজদার তাঁহাদিগকেও তলপ দিলেন। ইংরাজদিগের সভাপতি বহুবিধ উপঢৌকন লইয়া সসম্ভ্রমে সিরাজের সম্মুখে জানু পাতিয়া উপবেশন করিলেন। এই উপলক্ষে ইংরাজদিগের ১৫৫৬০ টাকা ব্যয় হইয়া গেল। যে বাবত যত টাকা ব্যয় হইল, ইংরাজগণ তাহার হিসাব যত্নপূর্ব্বক লিখিয়া রাখিয়াছেন। তাহা হইতে সে কালের আচার ব্যবহারের কিয়ৎপরিমাণে পরিচয় পাওয়া যায়।[১২] সিরাজদ্দৌলা সন্তুষ্ট হইলেন কি না জানিবার উপায় নাই; কিন্তু ইংরাজদিগের বিশ্বাস হইল যে, তিনি ইংরাজদের উপর বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছেন। ইহাতে কৃতার্থম্মন্য হইয়া কলিকাতার ইংরাজগণ ১৭৫২ খৃষ্টাব্দে ১৮ই সেপ্টেম্বর তারিখের পত্রে বিলাতে সেই শুভসংবাদ জ্ঞাপন করিলেন।[১৩]

 ইংরাজদিগের এই পত্র পড়িয়া মনে হয় যে, সিরাজদ্দৌলার মতিগতি পরিবর্তনের জন্য উৎকোচ উপঢৌকন দিয়াও তাঁহারা একেবারে নিশ্চিন্ত হইতে সাহস পান নাই। কেবল দিন কতকের জন্য কথঞ্চিৎ নিরাপদ হইলেন বলিয়াই এত আনন্দোচ্ছাস!

 এইবার রাজ্য-পরিদর্শন উপলক্ষে সিরাজদ্দৌলা নানা স্থানে পরিভ্রমণ করিয়া যেমন অনেক উপঢৌকন প্রাপ্ত হইলেন, সেইরূপ অনেক স্থানেই তাঁহার এবং তাঁহার পারিষদবর্গের অত্যাচারে লোকের নিকট তাঁহার প্রবল প্রতাপ প্রকাশিত হইয়া পড়িল। মহারাষ্ট্রদমনে নিরন্তর শিবিরে শিবিরে পরিভ্রমণ করিয়া আলিবর্দ্দীর স্বাস্থ্যভঙ্গ হইয়াছিল, সুতরাং এই সময় হইতেই সিরাজদ্দৌলা যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া অনেক পরিমাণে রাজকার্যে লিপ্ত হইতে আরম্ভ করিয়াছিলেন।

 ইংরাজ এখন ভারতবর্ষের রাজা—যাহা করেন, তাহাই শোভা পায়। যে দেশের প্রজাশক্তিকে পদদলিত করিয়া মোগল পাঠান মুসলসান ভূপতিরা বহুশতাব্দী ধরিয়া বাহুবলে রাজ্যশাসন করিয়াছেন, সে দেশের লোকের পক্ষে অল্প বিস্তর অত্যাচার অবিচার নীরবে সহ্য করা অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল; সুতরাং রাজা একটু সামান্য উৎপীড়ন করিলেও তাহারা সহসা হৃদয়-বেদনা প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিত না। কিন্তু সেকালের ইংরাজ, বণিক হইয়াও, নিরীহ লোকের উপর উৎপীড়ন। করিবার সুযোগ পাইলে ছাড়িতেন না এদেশে পদার্পণ করিয়াই “কালা আদ্‌মি” বলিয়া ইংরাজ যে নাসিকা-কুঞ্চন করিয়াছিলেন, আজ পর্যন্ত তাহা দূর হয় নাই! সুতরাং “কালা আদ্‌মি”দিগের বড়ই কষ্ট হইতে লাগিল। সেই কালা আদ্‌মির স্বার্থরক্ষার জন্য সিরাজদ্দৌলা অগ্রসর হইলেন। তিনি চৌকিতে চৌকিতে ইংরাজদের নৌকা আটক করিয়া তাহা সত্য সত্য কোম্পানীর নৌকা কি অন্য কোন অর্থলোলুপ ইংরাজ বণিকের নৌকা, তাহার অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়া দিলেন। সে অনুসন্ধানে যখন প্রকাশ পাইল যে, কোম্পানীর দোহাই দিয়া ইংরাজ মাত্রেই বিনাশুল্কে বাণিজ্য করিয়া আসিতেছেন, তখন যেগুলি সত্য সত্যই কোম্পানীর নৌকা, তাহার উপরেও সন্দেহ জন্মিতে লাগিল। অগত্যা কোম্পানীর লোকেরাও কথঞ্চিৎ উৎকোচ না দিয়া পরিত্রাণ পাইতে পারিলেন না।[১৪] এই সূত্রে কোম্পানীর কলিকাতাস্থ দরবারে অভিযোগ উপস্থিত হইতে লাগিল। “কালা আদ্‌মির” স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করিয়া সিরাজদ্দৌলা শ্বেতকায় বিদেশীয় বণিকের চক্ষুশূল হইয়া উঠিলেন; ইহার জন্যও ইতিহাস-লেখকদিগের হাতে তাঁহাকে কত না লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইয়াছে।

 রাজকার্য্য পরিদর্শন উপলক্ষে ইংরাজদিগের বাণিজ্য-কৌশল এবং ছল প্রতারণা ধরিতে পারিলেই সিরাজদ্দৌলা তাঁহাদের লাঞ্ছনার একশেষ করিতে আরম্ভ করিলেন। মেরিনামক একখানি জাহাজ এইরূপে বড়ই বিড়ম্বিত হয়। হলওয়েল সাহেব তাহাতে মর্ম্মপীড়িত হইয়া ইংরাজদরবারে অভিযোগ করেন,—মেরি যে কোম্পানীর জাহাজ না হইয়াও বিনাশুল্কে বাণিজ্য করিবার পরোয়ানা লইয়াছিল,এবং এইরূপে বিনাশুল্কে ইংরাজ মাত্রকেই বাণিজ্য করিয়া অর্থোপার্জ্জনের অবসর না দিলে তাহাদের দুর্দ্দশার সীমা থাকিবে না, ইহাই হলওয়েলের অভিযোগ।[১৫] সুতরাং ইংরাজমাত্রেই সিরাজদ্দৌলার শত্রু হইয়া উঠিতে লাগিলেন।

 ক্রমে এই সকল কথা বিলাতের কর্ত্তৃপক্ষীয়দিগের কর্ণগোচর হইল। তাঁহারা পূর্ব্বরীতির অনুসরণে নবাবের তুষ্টিসম্পাদনের জন্য আরও কিছু অর্থব্যয় করিয়া কলহ বিবাদ নিবারণ করিবার পরামর্শ দিতে লাগিলেন।

 কলিকাতার ইংরাজগণ অগত্যা আরও কিছু উপহার উপঢৌকন লইয়া সিরাজদ্দৌলার নিকট হাজির হইলেন। কিন্তু তাহাতেও উভয়ের মনোমালিন্য দূর হইল না। কেবল প্রকাশ্য উৎপীড়ন কিছু দিনের জন্য রহিত হইল মাত্র। ইংরাজ দরবার তদুপলক্ষে সিরাজকে ঘোটক উপঢৌকন দিবার মন্তব্য অবধারণ করিলেন।[১৬]

  1. সিরাজদ্দৌলার নাম—“নবাব মন্‌সূরোল-মোল্‌ক্-সিরাজদ্দৌলা শাহকুলী খাঁ মিরজা মোহম্মদ হায়বৎজঙ্গ বাহাদুর।”
  2. Grant's Analysis of Finances of Bengal.
  3. It will reduce a free merchant to the condition of a farmer or indeed of a meanest black fellow."—Long's Selections.
  4. Stewart's History of Bengal.
  5. Orme, Vol. ll—সিরাজদ্দৌলার সময়ে এ দেশের লোকে ইউরোপকে “ফিরিঙ্গীস্থান” বলিত; কিন্তু “ফিরিঙ্গীস্থানের জনসংখ্যা সম্বন্ধে তাহারা যে এতদুর অজ্ঞ ছিল, সেরূপ কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। সিরাজদ্দৌলার অজ্ঞতা অপবাদের একমাত্র প্রমাণ ইংরাজ-লিখিত ইতিহাস।
  6. Stewart's History of Bengal.
  7. Long's Selections.
  8. Rajballav becoming Nawab of Dacca peremptorily demanded the usual visit from the three nations, the French compounded it for 4300 Rupees, the English did the same rather than have the trade stopped.—Despatch to the Court, March 1, 1754.
  9. “He was perhaps the only prince in the East whom none of his subjects wished to assasinate.” Orme's Indostan, Vol. ii.
  10. Long's Selections from the Records of the Government of India, Vol. I. অর্থদণ্ডের পরিমাণ ১২ লক্ষই মুদ্রিত আছে, কিন্তু শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন উহা ভ্রম মাত্র, এক লক্ষ বিশ হাজার হইবে।
  11. The English got off after paying the Nawab through the Siets 1200000 Rupees.—Long's Selections.
  12. ৩৫ খান মোহর
    নগদ টাকা
    মোমের বাতি
    ঘড়ি
    ২ জোড়া আরসি
    ২ খণ্ড শ্বেত মর্ম্মর
    ১ পিস্তল

    ৫৭৭৲
    ৫৫০০৲
    ১১০০৲
    ৮৮০৲
    ৫৫০৲
    ২২০৲
    ১১০৲

    ১ হীরার আংটি
    ২৬ খান মোহর আলিবর্দ্দীর বেগমের নরজ বাবত
    ফকির বিদায়
    হুগলির সেখগণ
    হুগলির ফৌজদারের নজর ইত্যাদি।

    ১৪৩৬৲

    ৪২৯৲
    ১৮৪৲
    ৭৫৬৲
    ৭৭০৲




  13. ইংরাজী পত্র পরিশিষ্টে মুদ্রিত হইল।
  14. Native cloth-merchants complain of the detention of their goods by the exorbitant exactions of the chowkey that what used formerly to come down in ten days was now twenty days on its way."-Long's Selections.
  15. পরিশিষ্ট ইংরাজী অভিযোগপত্র দ্রষ্টব্য।
  16. পরিশিষ্ট মন্তব্যলিপি দ্রষ্টব্য।