সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/ইন্দ্রিয়-বিকার

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

ইন্দ্রিয়-বিকার।

 সিরাজদ্দৌলার সমাধি-মন্দির লক্ষ্য করিয়া একজন সুলেখক লিখিয়া গিয়াছেন যেঃ— “আলিবর্দ্দীর নিকটেই তাঁহার স্নেহপুত্তল সিরাজদ্দৌলা শায়িত। এই সিরাজদ্দৌলা, গর্ভস্থ সন্তান কিরূপে বাস করে তাহা দেখিবার জন্য গুর্ব্বিণীর উদর বিদীর্ণ করিত, রাজপ্রাসাদে বসিয়া মুমূর্ষুর অঙ্গবিক্ষোভ দেখিয়া আনন্দলাভের জন্য নৌকামধ্যে নরনারী আবদ্ধ করিয়া নিমজ্জিত করিবার আদেশ দিত;—কক্ষমধ্যে উপপত্নীগণকে ইষ্টকদ্বারা জীবিতাবস্থায় সমাধি নিবদ্ধ করিত;—মাতার পরপুরুষ সম্ভোগের প্রতিশোধ লইবার জন্য রমণীমাত্রেরই সতীত্বনাশ করিত;—তরবারী ও বর্ষাধারিণী তাতার, জর্জ্জিয়া ও হাবসীদেশের রমণীগণকে অন্তঃপুরের দ্বাররক্ষায় নিমুক্ত রাখিত;—মুর্শিদাবাদের প্রকাশ্য রাজপথে নরহত্যা করিত;—বহু রমণী সম্ভোগ করিয়া এবং নরহত্যায় পুণ্যলাভ করিয়া মহম্মদের মতের প্রধান দুইটী উপদেশ পালন করিয়া মোসলমান চরিত্রের আদর্শরূপে প্রতিভাত হইত![১] ইহাই যে এদেশের সাধারণ জনশ্রুতি হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই! এতদিনের পর এই জনশ্রুতির প্রত্যেক কথার সত্য মিথ্যা আলোচনা করিবার চেষ্টা করা বিড়ম্বনা মাত্র! তথাপি জনশ্রুতিকে সত্য বলিয়া গ্রহণ করিবার পূর্ব্বে দুই একটি কথার আলোচনা করা আবশ্যক।

 যে লেখক একজন গতজীব হতভাগ্য নরপতির সমাধি মন্দিরের জীর্ণ তোরণদ্বারে দাঁড়াইয়াও, তাঁহাকে এবং তাঁহার ধর্ম্ম প্রবর্ত্তক মহম্মদকে লক্ষ্য করিয়া, এত অধিক সরস পদ-লালিত্য বিকাশ করিতে ইতস্ততঃ করেন নাই, তিনি একজন বর্ত্তমান যুগের ইংরাজি-শিক্ষিত নব্য-বাঙ্গালী! সমসাময়িক ইংরাজ এবং বাঙ্গালী মিলিয়া যাঁহার সর্ব্বনাশ করিয়াছিল, পরবর্ত্তী ইংরাজ এবং বাঙ্গালীর নিকটেও তিনি সুবিচার লাভ করিতে পারেন নাই। বাঙ্গালী সিরাজদ্দৌলাকে কি জন্য সিংহাসনচ্যুত করিয়াছিল, এ পর্যন্ত তাহার বিচার হয় নাই; কিন্তু এ দেশে বাণিজ্য করিতে আসিয়া, রাজবিদ্রোহীদিগের সঙ্গে গুপ্তমন্ত্রণায় মিলিত হইয়া, ইংরাজগণ কি জন্য সিরাজদ্দৌলার সর্ব্বনাশের সহায়তা করিয়াছিলেন, ইংলণ্ডের লোকে তাহার বিচার করিয়াছিল। সেই বিচারে আত্মপক্ষসমর্থনের জন্য অভিযুক্ত ইংরাজগণ[২] সিরাজদ্দৌলার যে সকল অপবাদ রটনা করিয়াছিলেন, তাহাই এখন ইতিহাসে বাস্তব ঘটনা বলিয়া সমাদরে স্থানলাভ করিয়াছে।

 মোগল সাম্রাজ্যের অধঃপতনসময়ে ভারতবর্ষের সকল প্রদেশেই অল্পাধিক পরিমাণে অরাজকতার সূত্রপাত হইয়াছিল। বাঙ্গলাদেশে আবার দীর্ঘস্থায়ী বর্গীর হাঙ্গামা উপস্থিত হইয়া সেই অরাজকতা শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিল। আলিবর্দ্দী সুযোগ পাইয়া বাদশাহকে কর প্রদান করিতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন; জমীদারগণও অবসর পাইয়া প্রকারান্তরে স্বাধীন হইয়া উঠিতেছিলেন;—সিরাজদ্দৌলা সেই অরাজকতার গতিরোধ করিয়া কঠোরহস্তে দুষ্টের দমন করিবার আয়োজন করিবেন এবং আবশ্যক হইলে পাষণ্ডদলনে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ করিবেন না; অঙ্কুরেই তাহার পরিচয় পাওয়া গিয়াছিল। সকলে মিলিয়া, সেই জন্য সময় থাকিতে সিরাজদ্দৌলার সর্ব্বনাশের আয়োজন করিতে ছিল! আত্মপক্ষসমর্থনের জন্য বখন যাহা প্রয়োজন হইয়াছে, কি ইংরাজ কি বাঙ্গালী,—কেহই তাহাতে পশ্চাৎপদ হন নাই। সুতরাং তাঁহাদের বর্ণনা সত্য বলিয়া গ্রহণ করিয়া ইতিহাস সিরাজদ্দৌলার জন্য লঘুপপে গুরুদণ্ডের ব্যবস্থা করিয়া আসিয়াছে।

 ইংরাজদিগের ইতিহাসে সিরাজদ্দৌলার অনেক কুকীর্ত্তির উল্লেখ আছে, আমরা যথাস্থানে তাহার আলোচনা করিব। বাঙ্গালীর নিকট সিরাজদ্দৌলা কেবল ইন্দ্রিয়পরায়ণ অর্থপিপাসু উচ্ছৃঙ্খল যুবক বলিয়াই পরিচিত;—এই পরিচয় কিয়দংশে অতিরঞ্জিত হইলেও, একেবারে মিথ্যা নহে। কিন্তু সত্য হইলেও যে যে কারণে সিরাজদ্দৌলার ইন্দ্রিয়বিকার এবং অর্থপিপাসা উপস্থিত হইয়াছিল, তাহার মূলানুসন্ধান করা আবশ্যক।

 মাতামহের অসঙ্গত স্নেহ-পরায়ণতায় সিরাজদ্দৌলার বাল্যজীবনে সুশিক্ষার বীজ পতিত হইতে পারে নাই। স্বার্থ-সাধনের জন্য অনেকেই সুযোগ পাইয়া অপরিণামদর্শী তরুণ যুবককে প্রলোভনের পথে টানিয়া আনিয়াছিল! সেকালের নবাবদিগের মধ্যে ইন্দ্রিয়বিলাস বিশেষ দোষাবহ ছিল না; সুতরাং সিরাজদ্দৌলার রাজাপুরে অগণিত সেবাদাসী দেখিয়া যাঁহারা অপবাদ রটনা করিয়াছেন, তাঁহারা সেকালের সমাজনীতি লইয়া সিরাজদ্দৌলার সমালোচনা করেন নাই।

 সেকালের রাজা বাদশাহেরা সমাজ-নিয়ম উল্লঙ্ঘন করিয়া যথেচ্ছভাবে জীবনযাপন করিতেন। তাঁহাদের সহিত অল্পলোকেই সামাজিক ব্যাপারে মিলিত হইবার অধিকার পাইত। অনেক সময়ে হয় ত লোকে তাঁহাদিগকে চর্ম্মচক্ষে দর্শন করিবারও অবসর পাইত না। গোপনে রাজান্তপুরে বা প্রমোদভবনে তাঁহারা যে সকল ধর্ম্মবিগহিত কার্যে লিপ্ত হইতেন, বাহিরের লোকে তাহার বিন্দু বিসর্গও জানিতে পারিত না। সুতরাং কল্পনা-লোলুপ জনসাধারণ অনেক সময়েই তিলে তাল করিয়া তুলিত।

 সিরাজের নিকটে কেহ আলিবর্দ্দীর ন্যায় ধর্ম্মজীবন ও পুণ্যকার্যের প্রত্যাশা করিত না। ইন্দ্রিয়বিকার মুসলমান ভূপতিদিগের সাধারণ কলঙ্ক,—দুই এক জন সে কলঙ্কের হাত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া লোকসমাজে পূজনীয় হইয়াছেন বলিয়া, লোকে সকলের চরিত্রেই সেরূপ জিতেন্দ্রিয়তা দেখিবার আশা করিত না। সুতরাং অন্যান্য সদ্‌গুণ থাকিলে, লোকে নবাব এবং বাদশাহদিগের ইন্দ্রিয়বিকার লইয়া বিশেষ আন্দোলন করিত না! বরং কেহ কেহ স্বার্থসাধনের জন্য পাপপথের সহায়তা করিয়া ধনোপার্জ্জন করিতেও কুণ্ঠিত হইত না, এবং তাহার জন্য লোকসমাজে কেহই নিন্দাভাজন হইত না।

 সেকালের ইংরাজদিগের চরিত্রেও ইন্দ্রিয়বিকার কিয়ৎপরিমাণে পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল। পলাসির যুদ্ধাবসানে সিরাজদ্দৌলার শিবিরের অনেক বারবনিতাই পলায়ন করিবার অবসর পায় নাই। মীরজাফর তাহাদিগকে সমাদরে সম্মিলিত করিয়া লর্ড ক্লাইবের শিবিরে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।[৩] ইচ্ছা না থাকিলেও পদস্থ ব্যক্তিদিগকে দশ জনে মিলিয়া পাপের পথে টানিয়া আনে। সিরাজদ্দৌলাকেও সেই দশ জনে মিলিয়াই ইন্দ্রিয়বিকারের পাপপঙ্কে টানিয়া আনিতেছিল।

 রূপ ছিল, যৌবন ছিল, নবাবের প্রিয়পুত্তল বলিয়া সকলের নিকটেই সমাদর ছিল; তাহার পর লোকে যখন শুনিতে পাইল যে, সিরাজদ্দৌলাই বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার ভবিষ্যত নবাব, তখন দশজনে মিলিয়া বিবিধ উপায়ে তাঁহার উপর আধিপত্যবিস্তারের চেষ্টা করিতে লাগিল। সিরাজ যেরূপ উচ্ছৃঙ্খল-স্বভাব, স্বাধীনচেতা তেজস্বী যুবক, তাহাতে অন্য কোন উপায়ে তাঁহার উপর অধিপত্যবিস্তারের সম্ভাবনা ছিল না;—সুতরাং লোকে যৌবনসুলভ চাঞ্চল্যের সহায়তায় তাঁহার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করিতে আরম্ভ করিল।

 সিরাজ যৌবনোদ্গমের পূর্ব্বেই সঙ্গদোষে একটু একটু করিয়া সুরাপান করিতে শিখিয়াছিলেন। যখন যৌবন-জল-তরঙ্গে দেহমন তরঙ্গায়িত হইয়া উঠিল, তখন সঙ্গগুণে আনুষঙ্গিক পাপ-লিপ্সাও চরিতার্থ করিতে শিক্ষা করিলেন! ইহাতে সিরাজদ্দৌলার যত দোষ, তাঁহার প্রলোভনদাতা, উৎসাহদাতা সহকারীদিগের ততোধিক অপরাধ। এই দোষে যাঁহারা সমধিক লিপ্ত হইয়াছিলেন, তাঁহারা কে, কোন শ্রেণীর লোক, কি উদ্দেশ্যে সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে অনবরত ছায়ার ন্যায় পরিভ্রমণ করিতেন, ইতিহাস তাহার কোন সংবাদই লিখিয়া রাখে নাই। যাঁহারা প্রধান অপরাধী, তাঁহারা “বেকসুর খালাস” পাইয়াছেন, আর তাঁহাদের মোহজালে জড়িত হইয়া মোহান্ধ বালক একাকী সকলের কলঙ্ক বহন করিয়া লোকসমাজে শত গঞ্জনা সহ্য করিতেছে!

 যাহারা সিরাজদ্দৌলাকে পাপমূর্ত্তিতে লোকসমাজে পরিচিত করিয়া স্বার্থসাধনের পথ সহজ করিয়া তুলিয়াছিল, তাহারা প্রাণপণে কলঙ্ক রটনা না করিলে লোকে অল্পদিনের মধ্যেই এ সকল কথা ভুলিয়া যাইত। সম্রাট আকবরের স্মৃতিমন্দিরের নিকটে ভারতবর্ষের সকল শ্রেণীর হিন্দু মুসলমান এখনও শ্রদ্ধা ভক্তি অর্পণ করিতেছে;—সেই প্রবীণ নরপতির লোহিত প্রস্তরখচিত সুগঠিত দুর্গপ্রাচীরের অভ্যন্তরে মর্ম্মররচিত হর্ম্মতলে কত জাতির, কত ধর্ম্মের, কত কুলকামিনী তাঁহার বিলাস-বাসনা চরিতার্থ করিতেন, ইতিহাসে তাহা অপরিচিত নাই। তেজস্বিনী অভিমানিনী রাজপুতরমণী যোধা বাইয়ের নাম বাঙ্গালীর নিকট অপরিজ্ঞাত নহে। কিন্তু তিনিও আকবরের পাটরাণী হইয়া সিংহাসনের অর্দ্ধাংশভাগিনী হইয়াছিলেন। আগ্রার রাজদুর্গের মধ্যে এখনও “নওয়োজার বাজারের” কক্ষগুলি ধুলি-পরিণত হয় নাই; সেখানে বর্ষে বর্ষে যত কুকীর্ত্তির অভিনয় হইত, তাহাও লোকসমাজে লুক্কায়িত ছিল না। জাহাঙ্গীর বাদসাহ কৌশলক্রমে সের আফগানকে হত্যা করাইয়া, তাঁহার আলেকসামান্যা পরমরূপবতী সহধর্ম্মিণী নুরজাহানকে সিংহাসনে বসাইয়া, তাঁহারই নামে মুদ্রা প্রচলিত করিয়া রাজ্যপালন করিতেন; লোকে পরমসমাদরে পরদার-নিরত সম্রাটের সম্মুখে জানু পাতিয়া উপ বেশন করিত। দেখিয়া শুনিয়া সহিয়া গিয়াছিল; সুতরাং বাদশাহ বা নবাবদিগের গুপ্ত চরিত্র লইয়া কেহ কোনরূপ আন্দোলন করিত না।

 আমরা সিরাজদ্দৌলার ইন্দ্রিয়বিকারের গুণানুবাদ করিতেছি না, তাঁহার পাপ-লিপ্সারও সমর্থন করিতেছি না;—আমরা কেবল সমসাময়িক ইতিহাস লইয়া তাহার আলোচনা করিতেছি। সেই ইতিহাসে যে সকল আনুষঙ্গিক প্রমাণ এখনো বর্ত্তমান আছে, তাহার দুই একটি আলোচনা করিলেই প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ হইয়া পড়িবে।

 মহারাজ মোহনকালের নাম অনেকের নিকটেই সুপরিচিত। বাঙ্গালী কবি[৪] তাঁহার বীরত্ব বর্ণনা করিতে গিয়া যে সকল কবিতা রচনা করিয়াছেন, তাহাও অনেকের নিকট সমাদর লাভ করিয়াছে। কিন্তু মোহনলাল হিন্দু হইয়াও কি উদ্দেশ্যে সিরাজদ্দৌলার সিংহাসন ও জীবন রক্ষার জন্য প্রাণবিসর্জ্জন করিয়াছিলেন, কবি তাহার মূলতত্ত্ব আলোচনা করেন নাই।

 মোহনলাল একজন সামান্য অবস্থার লোক। নবাব-সরকারে তাঁহার কোনই পদ-গৌরব ছিল না। সিরাজদ্দৌলা যখন যৌবনোন্মাদে মত্ত, সেই সময়ে যে সকল লোক দলে দলে তাঁহার পার্শ্বচর হইয়াছিলেন, মোহনলাল তাহাদিগেরই একজন। মোহনলালের একটি সর্বাঙ্গসুন্দরী ভগিনী ছিলেন। রূপে তিনি বঙ্গসুন্দরীদিগের মধ্যে সমধিক রূপবতী বলিয়া পরিচিত। যৌবনোদ্গমে সেই অতুল রূপরাশি ক্রমেই বিকশিত হইয়া উঠিতে লাগিল। এই রূপসী ক্ষীণাঙ্গীদিগের মধ্যেও ক্ষীণাঙ্গী রলিয়া পরিচিত ছিলেন। ইঁহার দেহভার ৩২ সেরের অধিক ছিল না;[৫]—এই অপরূপ রূপলাবণ্যের কথা সিরাজদ্দৌলার নিকট অধিক দিন লুক্কায়িত রহিল না। তখন সেই রূপরাশি সিরাজদ্দৌলার অন্তঃপুরে আসিয়া উপনীত হইল![৬]

 মহারাজ মানসিংহ মুসলমানকে ভগিনীদান করিয়া মোগলের বিজয়পতাকা দেশ বিদেশে বহন করিয়াছিলেন। তাঁহার অগণিত সন্তানবৃন্দ, কেহ অশ্বারোহী, কেহ পদাতিকদলের সেনানায়ক হইয়া উচ্চ-রাজপদ উপভোগ করিয়াছিলেন;—একদিনের জন্যও বলদর্পিত মানসিংহের ক্ষত্রিয়-শোণিত অপমানচিন্তায় উত্তপ্ত হইয়া উঠে নাই। একবার এই ভগিনীদান লক্ষ্য করিয়া রাণা প্রতাপ ব্যঙ্গ করিয়াছিলেন, তাহাতে লজ্জা বা ঘৃণা বোধ হওয়া দূরে থাকুক, সেই অপরাধের সমুচিত দণ্ডবিধানের জন্য সম্রাটকে উত্তেজিত করিয়া, রাজপুত-গৌরবরবি মহারাণা প্রতাপ সিংহকে শত যুদ্ধে পরাজিত, মর্ম্মপীড়িত, গৃহতাড়িত, বন-নির্ব্বাসিত করিয়াও মানসিংহের মনঃক্ষোভ দূর হয় নাই। ইহার একমাত্র কারণ এই যে, মানসিংহ জানিয়া শুনিয়াই মোগলকে ভগিনীদান করিয়াছিলেন।

 মোহনলালের ইতিহাসও সেইরূপ। তিনি সামান্য পদবী হইতে সিরাজদ্দৌলার প্রধান মন্ত্রিপদে আরোহণ করিয়াছিলেন, নগণ্য সৈনিক হইয়াও উত্তরকালে “মহারাজ” উপাধি লাভ করিয়াছিলেন, তাঁহার পুত্র পূর্ণিয়ার নবাব হইয়াছিলেন; এবং যখন দেশের সমুদয় রাজা জমিদার মিলিয়া সিরাজদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করিতে অগ্রসর, তখন মোহনলাল একাকী অসাধারণ বীরপ্রতাপে সিরাজের সিংহাসন রক্ষার জন্য জীবন বিসর্জ্জন করিয়াছিলেন। মোহনলালের ন্যায় বীরপুরুষ কি স্বেচ্ছায় ভগিনীদান না করিলে এতাধিক উৎসাহের সঙ্গে আমরণ সিরাজদ্দৌলার কল্যাণসাধন করিতে সম্মত হইতেন?[৭]

 মোহনলালের ন্যায় আরও কতলোকে এইরূপে সিরাজদ্দৌলার উপর আধিপত্যবিস্তারের চেষ্টা করিয়াছিলেন, ইতিহাসে তাহার পরিচয় পাইবার উপায় নাই। তবে রাজ্যপরিদর্শন উপলক্ষে সিরাজদ্দৌলা নানা স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র, স্থানীয় সম্ভ্রান্ত জমিদার এবং ফৌজদারগণ যে তাঁহার মনস্তুষ্টি ও শুভদৃষ্টিলাভের প্রত্যাশায় গায়ে পড়িয়া অনেক সুন্দরী ললনার সর্ব্বনাশ সাধন করিতেন, তাহা একেবারে অস্বীকার করিবার উপায় নাই।

 ছলে, বলে, কৌশলে এবং অর্থ-বিনিময়ে অনেক কুলকামিনী সিরাজের অঙ্কশায়িনী হইয়াছিলেন; কিন্তু সিরাজদ্দৌলা তাঁহাদিগকে নিশাবসানে বিগত-সৌরভ কুসুমস্তবকের ন্যায় আবর্জ্জনারাশির সঙ্গে রাজপথে ফেলিয়া দিতেন না। সকলেই যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে তাঁহার রাজান্তঃপুরে স্থানলাভ করিয়াছিলেন, এবং এইজন্যই তাঁহার অন্তঃপুরে সতর্ক প্রহরী সশস্ত্রশরীরে নিশিদিন দ্বাররক্ষায় নিযুক্ত থাকিত। সিরাজদ্দৌলার অধঃপতনের পর তাঁহার অন্তঃপুরে যে বহুশত রমণী প্রহরিবেষ্টিত হইয়া বাস করিতেছিলেন, তাঁহাদিগের সংখ্যা গণনা করিয়া ইংরাজ ইতিহাস-লেখকেরা শিহরিয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহারা কাহার রমণী, কি সূত্রে রাজান্তঃপুরে স্থানলাভ করিয়াছিলেন, কেহ তাহার তত্ত্বানুসন্ধান করেন নাই। কালক্রমে সেই সকল রমণীগণ যখন ইংরাজের কৃপায় বৃত্তি লাভ করেন, তখন প্রকৃত অবস্থা কঞ্চিৎ প্রকাশ হইয়াছিল, এবং তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশই যে সরফরাজ খাঁর বেগমমণ্ডলী, তাহা ইংরাজ-রাজের কাগজপত্রে উল্লিখিত হইয়াছিল। কিন্তু ইতিহাস-লেখকেরা আর ভ্রমসংশোধন করা প্রয়োজন বোধ করেন নাই।

 সিরাজদ্দৌলার সমসাময়িক ইংরাজ এবং মুসলমান ইতিহাসলেখকগণ তাঁহার জীবনকালে যে সকল ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাহার মধ্যে তাহার অনেক কুকীর্ত্তির উল্লেখ আছে; কিন্তু গুর্ব্বিণীর গর্ভবিদারণ, নৌকা সহিত ভগীরথীগর্ভে নরনারী-নিমজ্জন প্রভৃতি অদ্ভুত অত্যাচারের কোনই উল্লেখ নাই! বলা বাহুল্য যে, ইহার অধিকাংশই “রচা কথা”![৮]

  1. Travels of a Hindu.
  2. Holwell's India Tracts.
    Evidence of Mr. Cook, in the first Report of the Committee of House of Commons 1772.
    Scrafton's Reflections,
  3. “Many of Suraj-a-Dowla's women taken in the camp had been offered to Clive by Meerjaffier immediately after the battle of Plassey."—Travels of a Hindu.
  4. নবীনচন্দ্র সেন।
  5. “The translator of the Sayer tells us that the Indian idea of a beautiful woman is that her skin be of a golden colour, and so transparent, that when she eats pan, the red fluid can be seen passing down her throat, and that she weigh only twenty-two sirs (44. lbs.) Stewart's 64 is perhaps, a mistake for 44."—H, Beveridge. C. S.
  6. শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এই ভগিনীদান কাহিনী বিশ্বাস করেন না। মুতক্ষরীণের অনুবাদক হাজি মুস্তাফা নামধারী ফরাসী পণ্ডিত টীকাচ্ছলে এই কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, তাহা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের মতে ‘অমূলক”, কারণ মোসলমান রচিত ইতিহাসে ইহার উল্লেখ নাই।
  7. “নবাবী আমলে হিন্দু কর্ম্মচারী” নামক “সাহিত্যে” প্রকাশিত একটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধে (জ্যৈষ্ঠ ১৩০৫) বন্ধুবর শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিয়াছেন, যে, “ইংরাজ মহাত্মারা বীর-প্রবর মোহনলালের যে অপবাদ রটাইবার চেষ্টা করিয়াছেন—তাহার সমালোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন।” আমরা ইহাকে “অপবাদ” বলিয়া গ্রহণ করিতে প্রস্তুত নহি। মহারাজ মানসিংহ এবং মোহনলাল উভয়েই সমাদরের পাত্র;—মোগলকে ভগিনীদান করিয়াছিলেন বলিয়া বীরত্ব-গৌরব অবসন্ন হইতে পারে না। বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় স্বকৃত বাঙ্গালার ইতিহাসে (১৩০৮) বলিয়াছেন—“মোহনলালের এই অত্যধিক উন্নতিই সিরাজের অধঃপতনের বীজ বপন করিয়া রাখিল।” কিন্তু সে উন্নতির মূল কি তাহা প্রদর্শিত না হওয়ায় মুস্তাফা বর্ণিত ভগিনীদান কাহিনী কেবল মুখের কথায় উড়াইয়া দিতে সাহস হয় না।
  8. আধুনিক বাঙ্গালী লেখকবর্গের মধ্যে নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাস লেখক বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় সিরাজের চরিত্রহীনতার নিদর্শন যেখানে যাহা পাইয়াহেন সযত্নে সঙ্কলিত করিয়া দিয়াছেন। অবশেষে তিনিও লিখিয়াছেন—ইহাতে গুর্ব্বিণীর গর্ভবিদারণ, জলে জনপূর্ণ পোত নিমজ্জন, সৎকুলজাতআ পতিব্রতা কুলবনিতদিগের সতীত্বাপহরণ আদি যাবতীয় উৎকট নিষ্ঠুর ব্যাপার তাঁহার নিত্যকর্ম্মের মধ্যে পরিগণিত ছিল—ইত্যাদি নির্দ্দেশ করিবার কোন কারণ নাই।”