আনন্দ-তুফান

উইকিসংকলন থেকে
আনন্দ-তুফান
(ভক্তের অন্তর-মণ্ডপে দুর্গোৎসব)

আনন্দময়ীর আবাহন, পূজা, বলিদান, আরতি, প্রণাম,
বিজয়া-দশমী-কৃত্য, বরণ ও বিসর্জ্জনাদি
অভিনব প্রথায়

মহাত্মা
প্রিয়নাথ চক্রবর্ত্তি-দ্বারা বিরচিত।



তৃতীয় প্রচার।



কে জানে ‘আনন্দ’ কোথা অনিত্য সংসারে?
নিত্যানন্দ লভিবারে আশা!


আশ্বিন ১৩২৪ বঙ্গাব্দ।
সর্ব্বস্বত্ব সুরক্ষিত।]
[মূল্য চারি আনা।

কলিকাতা
৯১৷২ মেছুয়াবাজার স্ট্রীট,
“নববিভাকর যন্ত্রে”
শ্রীকপিলচন্দ্র নিয়োগী দ্বারা
মুদ্রিত



প্রকাশক
শ্রীযোগীন্দনাথ চক্রবর্ত্তী।
৪ নং মহেন্দ্র বসুর লেন, শ্যামবাজার,
কলিকাতা।

আনন্দ-উপহার।

সোদরপ্রতিম অনুরাগভাজন

শ্রীযুক্ত দয়ালকৃষ্ণ শর্ম্ম-দেব-[১]
আত্মারাম সন্ধান-নিরতেষু—

 ভাই দয়ালচাঁদ! সংসার-সঙ্কট-প্রপীড়িত জীবেই ব্যাকুল হইয়া আনন্দের সন্ধান করে, এই বিশ্বাসের বশবর্ত্তী হইয়া, এবং তোমাকে উহার অনুরূপ দেখিয়া, অর্থাৎ ভব-যাতনায় ব্যথিত হইয়াছ অনুমিত হওয়ায়, দেবী দুর্গতিনাশিনীর চরণামৃতস্বরূপ, ইহার বড় আদরের সামগ্রী, এই পুস্তকাকার ‘আনন্দ তুফান' তোমার আদরণীয় নামে উৎসর্গীকৃত হইল। ইহাতে আনন্দবিধায়িনী অন্য কোন শক্তি আছে কি না, তাহা তোমার ন্যায় ব্যক্তির বিচারাধীন হইলেও, আনন্দময়ী দুর্গার নাম আছে বলিয়াই এ অভিমানীর এত সাহস। ইতি

ভাদ্র,
১৩০০ বঙ্গাব্দ।

তোমার-প্রীতি-বশীভূত

আনন্দ-তুফান-সম্বন্ধীয় অভিপ্রায়।

 আনন্দ-তুফান-সম্বন্ধে দেশীয় কতিপয় খ্যাতনামা সহৃদয় ব্যক্তির ও প্রসিদ্ধ সংবাদপত্রের অভিপ্রায় পাওয়া গিয়াছে। তদ্ব্যতীত, অনেকেরই এই ক্ষুদ্র পুস্তকখানি পাঠের প্রবৃত্তি বা আবশ্যক অদ্যাপি ঘটে নাই। বর্ত্তমান সময়ে গ্রন্থের উৎকর্ষ-প্রচার-জন্য বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গের প্রশংসাপত্র গ্রন্থসহ মুদ্রণ প্রথা প্রচলিত হওয়ায় সমালোচনা-পাঠ প্রিয়জনের বাসনা পূরণ ও পাঠকগণের চিত্তাকর্ষণ জন্য আনন্দ-তুফান-সম্বন্ধীয় অভিপ্রায়-পত্র-সমূহ হইতে মাত্র দুই খানি এস্থলে প্রকাশিত হইল।


স্বনামবিখ্যাত সুকবি শ্রীযুক্ত রাজকৃষ্ণ রায়

মহাশয়ের অভিপ্রায়-পত্র।

(কলিকাতা, ১৫ই ভাদ্র, ১২৯৩ বঙ্গাব্দ।)

 আমি বিশেষ মনোযোগের সহিত ‘আনন্দ-তুফান’ পাঠ করিলাম। আজ পর্য্যন্ত শারদীয়-দুর্গোৎসব-সম্বন্ধে যতগুলি সাময়িক পুস্তক আমি পড়িয়াছি, তন্মধ্যে এইখানিই দেখিলাম যথার্থ ভক্তির সহিত লিখিত হইয়াছে। বড় আনন্দের কথা যে, একজন সরল ভক্ত, সরল হৃদয়ে, সরল কথায়, পরমেশ্বরীকে ভক্তি-পুষ্পে পূজা করিয়াছেন। আজ কাল যে সকল কপট-ভক্তের বাটীতে ঘোর তামসিক ভাবে দুর্গোৎসব হইয়া থাকে, তাঁহাদের চক্ষের উপর এক এক খানি ‘আনন্দ-তুফান’ রক্ষা করা উচিত।

 ‘আনন্দ-তুফানের’ ছন্দ অনেকটা সেক্ষপীরের ধরণে লিখিত। যাঁহারা মহাকবি সেক্ষপীরের নাটকাবলী পাঠ করেন নাই, তাঁহাদের পক্ষে এই ছন্দ প্রথমতঃ কতকটা বাধো-বাধো ঠেকিবে, কিন্তু পদ-বিচ্ছেদ-চিহ্নগুলির উপর লক্ষ্য রাখিলে আর কোন গোলযোগ থাকিবে না।

 ‘আনন্দ-তুফানের’ অনেক স্থানে মনোহর কবিত্ব ও উচ্ছ্বসিত ভাব আছে। গ্রন্থকারের হৃদয়ের সহিত হৃদয় মিলাইয়া ইহা পাঠ করিলে বাস্তবিকই ভক্তির উদ্রেক হইবে।

 আমার নিতান্ত ইচ্ছা ও আশা আছে, ‘আনন্দ তুফান’ রচয়িতা অন্যান্য প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ হিন্দূৎসব সম্বন্ধে এইরূপ ভক্তিপূর্ণ গ্রন্থ লিখিয়া আমাদিগকে সন্তুষ্ট করিবেন। ইতি


ভক্তিভাজন পণ্ডিত শ্রীযুক্ত হরিশ্চন্দ্র কবিরত্ন

মহাশয়ের অভিপ্রায়-পত্র।

(কলিকাতা, ১৬ই ভাদ্র, ১৩০০ বঙ্গাব্দ।)

 দুর্গোৎসব বঙ্গদেশীয় হিন্দুদিগের একটা প্রধান পর্ব্ব। এ সময় বালক বালিকাগণ নববস্ত্র পরিধান করিয়া মহামায়ার মণ্ডপাঙ্গনে নাচিয়া বেড়ায়। যুবক যুবতীগণ নবীন বিলাসজনক বস্তুগুলি অঙ্গে ধারণ করিয়া প্রায় তদ্গতই থাকেন। এবং বৃদ্ধ বৃদ্ধাগণ জগদম্বার জগতে আবির্ভাব ভাবিয়া, স্বীয় সস্তুতিবর্গের কল্যাণকামনাতেই প্রায় নিরত। ফলতঃ সকলকেই “আমোদ-তুফানে” ভাসমান দেখা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এগুলি পার্থিব আমোদ, এ গ্রন্থোক্ত আধ্যাত্মিক ‘আনন্দ’ নহে। মানব নিরবচ্ছিন্ন অনিত্য সাংসারিক আমোদে মত্ত না থাকিয়া, অনির্ব্বচনীয় অসীম নিত্য “আনন্দ তুফানে” মগ্ন হম, ইহাই এ গ্রন্থের প্রতিপাদ্য। আমরা হৃদয়ের সহিত এ গ্রন্থের অভিপ্রায় সম্পূর্ণ অনুমোদন করি। ইতি


তৃতীয়বারের নিবেদন।

 আদ্যা শক্তি আনন্দময়ীর ইচ্ছায় চতুর্ব্বিংশ বর্ষ পরে আনন্দ-তুফানের তৃতীয়-প্রচার-সময় সমুপস্থিত। কিন্তু একার্য্য সুসম্পন্ন করিবার প্রকৃত পাত্র যিনি এবং এ বিষয়ে আন্তরিক উৎসাহ-দাতা যাঁহারা, সেই বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ আজ কোথায়?

 অন্তর-মণ্ডপে জগন্মাতার মানস-পূজার প্রতিচ্ছবি এই “আনন্দ-তুফান” যাঁহার, সচ্চিদানন্দময়ীর সুসন্তান—তদ্গতপ্রাণ, সেই সাধু-শান্ত-জন-সমাদরণীয়, আমাদের পরম-পথ-প্রদর্শক—পরমারাধ্য গ্রন্থকর্ত্তা মহোদয়, বিগত ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ২৯শে আশ্বিন স্বীয় সাধনোচিত গতি—শ্রীভগবতীর শ্রীপদাশ্রয় লাভ করিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত তদীয় অন্তরঙ্গগণের মধ্যে, তাঁহার তিরোভাবের পূর্ব্বে আত্মারাম-নিরত মন্মথনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও সহৃদয় শ্যামলাল মল্লিক, এবং তিরোভাবের পর—নিত্যানন্দলোলুপ দয়ালকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরসিক শশিভূষণ কৃতিরত্ন, উদারচেতা রায় বিপিনবিহারী মিত্র ও শ্রীকৃষ্ণ-সেবক ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি পূজ্যপাদ মহাশয়গণও স্ব স্ব সাধনোচিতধামে প্রস্থান করিয়াছেন।

 কূলপাংশুল পুত্রের দ্বারা পূর্ব্বপুরুষ-প্রতিষ্ঠিত কূল-দেবতার সেবা সুসম্ভব না হইলেও উপযুক্ত বংশধর ও অভিভাবক অভাবে—পিতৃবিয়োগান্তে যেমন সে ভার তাহারই উপর অর্পিত হয়, এ ক্ষেত্রেও তদ্রূপ উল্লিখিত যোগ্য-পাত্রগণের অভাবে এই অযোগ্য—অপাত্রের উপর “আনন্দ-তুফান” প্রচারের ভার অর্পিত হইয়াছে। ফলতঃ এরূপ অবস্থায় সর্ব্বসিদ্ধিদায়িনী শ্রীভগবতীর করুণা ব্যতীত আর গত্যন্তর নাই বুঝিয়া, কর্ম্মারম্ভেই তাঁহার শরণাগত হই এবং তদীয় শ্রীপাদপদ্মে প্রণতিপূর্ব্বক নিবেদন করি—মঙ্গলময়ী মা! আরব্ধ এই কার্য্যের প্রতি প্রসন্ন-দৃষ্টি বর্ষণ কর—তব প্রিয়-পুত্রের বড় আদরের “আনন্দ-তুফান” পুনঃ প্রচার পূর্ব্বক তাহার আনন্দবর্দ্ধনকর।

 বলা বাহুল্য, মা মুখ তুলিয়া চাহিয়াছেন। তাঁহারই অনুকম্পায় আনন্দ-তুফানের তৃতীয়-প্রচারকার্য্য এতদিনে সম্পন্ন হইল। তদীয় ব্যবস্থানুসারে এবার আর গ্রন্থের ভাষাগত কোন পরিবর্ত্তন সাধিত হয় নাই; কেবল পাঠের সুবিধার জন্য রচনার পংক্তি গুলি প্রকারান্তরে সন্নিবিষ্ট এবং গ্রন্থ খানির অবয়বগত সৌন্দর্য্যবর্দ্ধন জন্য উহা ক্রাউন-য়্যাণ্টিক্‌ কাগজে মুদ্রিত ও কথঞ্চিৎ অলঙ্কৃত হইয়াছে মাত্র। ফলে, মায়ের প্রেরণা-সঞ্জাত এই উদ্যম—উদ্দেশ্য সাধনে কতটুকু সমর্থ হইল, মাতৃভক্ত পাঠকগণই তাহার বিচারকর্ত্তা। এক্ষণে আনন্দময়ীর ইচ্ছায় “আনন্দ-তুফানের” সমাদর ও পাঠক সংখ্যা উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হইলেই স্বর্গীয় গ্রন্থকার মহাশয়ের সদুদ্দেশ্য সফল ও উহার তৃতীয় প্রচার সার্থক হয়।

 পরিশেষে কৃতজ্ঞহৃদয়ে স্বীকার করা যাইতেছে যে, ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছায় পূজ্যপাদ গ্রন্থকর্ত্তা মহাশয়ের প্রিয়পাত্রগণের মধ্যে নিউ ইণ্ডিয়ান্‌ স্কুলের সুযোগ্য শিক্ষক শান্তি-পিপাসু শ্রীযুক্ত কৃষ্ণধন দাস মহাশয় এবং সুচরিত শ্রীযুক্ত বিপিনবিহারী নিয়োগী, উদারচিত্ত শ্রীযুক্ত অনাথনাথ মুখোপাধ্যায়, মুক্তিপ্রার্থী শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বিশ্বাস প্রভৃতি পূজ্য ও আদরণীয় ব্যক্তিবর্গ আন্তরিক উৎসাহ প্রদান-দ্বারা এবং নববিভাকর যন্ত্রের সুযোগ্য কার্য্য-পরিচালক কর্ত্তব্যনিষ্ঠ শ্রীযুক্ত নিরাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় মুদ্রণপারিপাট্য-বিষয়ে বিশেষ যত্ন লইয়া, “আনন্দ তুফান” প্রচার কার্য্যে যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছেন।

শ্যামবাজার।
আশ্বিন, ১৩২৪ বঙ্গাব্দ।

কৃপাপ্রার্থী
প্রণত—সিদ্ধেশ্বর দাস।


প্রথমবারের নিবেদন।

 অধুনা আনন্দময়ীয় শরৎকালীন আগমন-সময়ে আনন্দলাভের নিমিত্ত বঙ্গসমাজে রাশি রাশি রঙ্গরসাত্মক পুস্তক পুস্তিকা প্রকাশিত ও সুলভ মূল্যে বিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু ঐ সকল পুস্তক দ্বারা কেহই প্রকৃত আনন্দের আস্বাদ পাইয়া থাকেন কি না, তাহা বলিবার শক্তি নাই। আনন্দময়ীর আগমন (শারদীয় দুর্গোৎসব) আর্য্যজাতির একান্ত অভিলষণীয়; অতএব এ সময় যদি প্রকৃত-আনন্দ-উদ্দীপক কোন রস পাওয়া যায়, তবে তাহা আনন্দাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির আদরণীয় হইবার সম্ভাবনা। এই ভরসায়, নশ্বর লৌকিকরঙ্গ-রসাত্মক-বিষয় পরিহারপূর্ব্বক, সঙ্কীর্ণ চিন্তা দ্বারা অন্তর্জগতের যতদূর সন্ধান পাওয়া সম্ভব, তদনুসারে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া আন্তরিক উপচারে আনন্দময়ীর পূজোপাসনার অভিপ্রায়ে এই ‘আনন্দ-তুফান’ রচিত হইল। ইহা দ্বারা কেহ কিছু ‘আনন্দ’ পাইবেন কি না, তাহা ক্রিয়াশীল পরীক্ষকের পরীক্ষার, এবং আদ্যা শক্তি আনন্দময়ীর ইচ্ছার উপরেই সম্পূর্ণ নির্ভর করিতেছে। তবে ইহা যদি আর্য্য-নাম ও মনুষ্য-শরীর ধারী ব্যক্তির অন্ততঃ একবার পাঠযোগ্য হয়, তাহা হইলেও কামনার আংশিক পূরণ হইবে।

 এস্থলে পাঠকবর্গকে বিনীতভাবে জানান যাইতেছে যে, এই ‘আনন্দ-তুফানের’ অধিকাংশই অমিত্রাক্ষর ছন্দে সম্বদ্ধ হইয়াছে। কিন্তু ইহা লোকান্তরিত শ্রীযুক্ত মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাশয়ের অনুকরণে প্রত্যেক পংক্তি চতুর্দ্দশ অক্ষরে সংযত হয় নাই। কারণ, সুমধুর অমিত্রাক্ষর ছন্দকে নিয়মিত চতুর্দ্দশ অক্ষর দ্বারা গ্রথিত করিতে হইলে, উহাকে ‘মুক্তিল’ (মুক্তা বর্ষণ করিল) ‘হ্রেষিল’ (হ্রেষোরব করিল) প্রভৃতি কঠোর ও দুর্ব্বোধ্য নামধাতু সকল প্রয়োগ দ্বারা কটু করিতে হয় বিবেচনায়, এই পুস্তিকায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের অক্ষরের বিশেষ কোন নিয়ম নির্দ্ধারিত করা হয় নাই। কিন্তু তাহা না হইলেও (অর্থাৎ ইহা বঙ্গভাষাতে আধুনিক প্রথায় সঙ্ঘটিত হইলেও) এই পুস্তিকার বিরাম-চিহ্ন সকল এরূপে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে যে, তদ্বারা রসগ্রাহী পাঠকমাত্রেরই ইহা পাঠ ও হৃদয়ঙ্গম করণ-বিষয়ে অসুবিধা না হইবারই সম্ভাবনা।

 অবশেষে কৃতজ্ঞহৃদয়ে সাধারণকে জানান যাইতেছে যে, স্বনাম বিখ্যাত সুকবি শ্রীযুক্ত রাজকৃষ্ণ রায় মহাশয় দয়া করিয়া এই ক্ষুদ্র পুস্তিকার আদ্যোপান্ত পরিদর্শন ও সংশোধন দ্বারা লেখকের সহায়তা করিয়াছেন; এবং আহ্লাদসহকারে জ্ঞাপিত হইতেছে যে, করুণহৃদয় শ্রীযুক্ত শ্যামলাল মল্লিক, ও আনন্দাকাঙ্ক্ষী সুহৃৎ সোদরপ্রতিম শ্রীযুক্ত মন্মথনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, এই ‘আনন্দ তুফান’ প্রচার-নিমিত্ত লেখককে আন্তরিকভাবে উৎসাহিত করিয়াছেন; কিন্তু উঁহাদের আশা সফল হইল কি না তাহা মা আনন্দময়ীই জানেন। ইতি

জন্মভূমি গোকর্ণী ভৈরব-নিবাস
মগরাহাট পোষ্ট, ২৪ পরগণা।

আনন্দভিখারী আত্মবিস্মৃত
প্রিয়নাথ।

দ্বিতীয়বারের নিবেদন।


 ভগবতী বিশ্বরূপিণী আনন্দময়ীর কৃপায় এবং তন্নামপ্রিয় পাঠকবর্গের সহৃদয়তায়, প্রায় সাত বৎসরের পর এই দীনের বড় আদরের ‘আনন্দ-তুফান’ আবার মুদ্রিত ও জনসমাজে প্রচারিত হইল। প্রথম বার, এই ভিক্ষুকের অন্নদাতা কলিকাতা যোড়াসাঁকো-নিবাসী শ্রদ্ধাভাজন শ্রীযুক্ত শ্যামলাল মল্লিক মহাশয় আনন্দ-তুফান-পাঠে প্রসন্ন হইয়া ইহা মুদ্রণার্থ অর্থ দ্বারা সাহায্য করিয়াছিলেন, এবং ইহার সংসার বাসের অদ্বিতীয় প্রিয়সুহৃৎ ভগবন্নামবিহ্বল শ্রীমন্‌-মন্মথনাথের প্রেমাশ্রুর-সম্মিলিত উৎসাহ দ্বারা, ইহা প্রকাশিত হইয়াছিল। এবার উৎসাহব্যতীত শ্রীযুক্ত শ্যামলাল মহাশয়ের অন্য সাহায্য আবশ্যক হয় নাই; এবং প্রিয় মন্মথনাথ পার্থিব-পরিজন-মধ্যে বাস করিলেও পৃথিবীর প্রায় সকল চিন্তার অতীত, এমন কি, ইঙ্গিত-বিরহিত মৌনভাবে অবস্থিত থাকায় তাঁহাকে ইহা প্রদর্শনের সুযোগ ও সামর্থ্য হয় নাই।

 সে যাহা হউক, এবার আনন্দ-তুফানের কোন কোন সামান্য অংশ পরিবর্জ্জন এবং অনেকস্থলে ভাবের স্ফূর্ত্তি সঙ্কল্পে যথাশক্তি পরিবর্দ্ধন সঙ্ঘটিত হইয়াছে। তদ্দ্দ্বারা কিরূপ ফল হইয়াছে, হৃদয়বান পাঠকবর্গই তাহার নিরপেক্ষ বিচার-কর্ত্তা।

 অবশেষে কৃতজ্ঞহৃদয়ে স্বীকার করা যাইতেছে যে, আমাদের সংসার-সুহৃৎ পরমার্থপ্রিয় শ্রীযুক্ত হরিপ্রসন্ন দাস, শ্রীযুক্ত রায় নীরদকৃষ্ণ দত্ত, শ্রীযুক্ত রায় বিপিনবিহারী মিত্র এবং অনুজপ্রতিম শ্রীমান্‌ সিদ্ধেশ্বর দাস ও শ্রীমান্‌ শচীন্দ্রকুমার বসু প্রভৃতি ব্যক্তিগণ এই আনন্দ-তুফানের নব-কলেবর দর্শন জন্য আন্তরিকভাবে উৎসাহিত করিয়াছেন। এবং কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের সহকারী সংস্কৃতাধ্যাপক আমাদের ভক্তিভাজন পণ্ডিত শ্রীযুক্ত হরিশ্চন্দ্র কবিরত্ন মহাশয়, এবং প্রসিদ্ধ-গিরিশ-বিদ্যারত্ন-যন্ত্রের উপযুক্ত মুদ্রাকর (প্রিণ্টর) আমাদের শুভানুধ্যায়ী শ্রীযুক্ত শশিভূষণ ভট্টাচার্য্য (কৃতিরত্ন) মহাশয়, দয়া ও যত্ন করিয়া এই পুস্তক মুদ্রাঙ্কনকালে পরিদর্শন বা ত্রুটিশোধনপূর্ব্বক বিশেষ উপকার করিয়াছেন।

 এখন শেষ বক্তব্য এই যে, সত্যানুরাগী আনন্দপ্রিয় ব্যক্তিগণ কর্ত্তৃক পূর্ব্ববৎ এবারেও আনন্দ-তুফান পঠিত হইলেই উল্লিখিত সদাশয় ব্যক্তিবর্গের উৎসাহ ও শ্রম সার্থক হইবে এবং এ দীনও সর্ব্বাঙ্গীন সিদ্ধকাম হইতে পারিবে। ইতি

শ্যামবাজার মিত্র-দেবালয়,
কলিকাতা।

ভিখারী—প্রিয়নাথ।


সূচনা।
মহোৎসবে প্রাণের অবকাশ।

 যিনি পরিশ্রম করিয়া থাকেন, বিশ্রামে যে কেমন মুখ, তাহা তিনিই জানেন। পরিশ্রম-রত্নটীর একটী বিশেষ আশ্চর্য্য গুণ এই যে, ইহাকে যে কোন কার্য্যে নিযুক্ত করা যাউক না কেন, তাহা অনায়াসেই সুসম্পন্ন হয়। এই ‘পরিশ্রম’ আবার আধ্যাত্মিক ও লৌকিক ভেদে দুইপ্রকার। ইতিমধ্যে যিনি ‘নিজের’ কার্য্য করেন, তিনিই আধ্যাত্মিক-পরিশ্রমশীল বা জ্ঞানানন্দ-সাধক; আর যিনি পরের কার্য্য করেন, তিনিই লৌকিক পরিশ্রমশীল বা মোহ-বিমুগ্ধ॥

 এস্থলে কে ‘আপন’ আর কে ‘পর’, যদিও তাহার মীমাংসা করা অভিপ্রেত নহে, তথাপি এইপর্য্যন্ত জানিলেই হইবে যে, যাঁহাদিগকে লৌকিক সম্বন্ধে, বা স্থূল দৃষ্টিতে, আমরা আমাদের সহিত সম্মিলিত দেখি, তাঁহারাই আমাদের ‘আপন’;—আর যাঁঁহাদিগকে আমরা এই স্থূল-সম্বন্ধ হইতে বিচ্ছিন্ন দেখি, তাঁহারাই আমাদের ‘পর’।

 সে যাহা হউক, যাঁহারা এইপ্রকার পরের কার্য্য করিয়া থাকেন, তাঁহারা যদি সেই কার্য্য হইতে কখনও অবকাশ পান, তবে তাঁহাদের আর আহ্লাদের সীমা থাকে না। কারণ, তাহা হইলে তাঁহারা তখন তাঁহাদের ‘নিজের’ কার্য্য করিতে সময় পান। আর যাঁহাদের নিজের কোনরূপ কার্য্য না থাকে, তাঁহারা স্বেচ্ছামত আমোদ প্রমোদ করিয়া থাকেন;—এ কথা হয় ত সকলেই স্বীকার করিবেন।

 ইহা যদি স্বীকার্য্য হয়, তবে এই স্থানে বিবেচনা করিয়া দেখা উচিত যে, আমরা ‘নিজে’ কে? তাহা হইলে চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রকেই স্বীকার করিতে হইবে যে, আমরা (সৃষ্ট জীবমাত্রই) সত্যস্বরূপ, অনন্তশক্তি, অদ্বিতীয় ঈশ্বরের শক্তি-সঞ্জাত পদার্থ; বা (প্রকারান্তরে) স্বয়ং ঈশ্বর। অর্থাৎ সকলেই ‘এক’ বা সকলেই ‘আপনার’। তাহা হইলে আবার আমাদের এই জানিতে ইচ্ছা হয় যে,—তবে আমাদিগকে ‘আপন’ ও ‘পর’ পৃথক্‌ বোধ করায় কে?” চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই ইহার উত্তরে বলিবেন, ‘মায়া’[২]

 এখন আমাদিগকে অবশ্য ইহাও স্বীকার করিতে হইবে যে, আমরা এই ভব-কারাগারে আগমনপূর্ব্বক এই আত্ম-পর-পার্থক্যসাধিকা মায়ার বশবর্ত্তী হইয়া, প্রায় সমস্তই ‘পরের’ কার্য্য করিতেছি। এ অবস্থায় যদি আমরা এই ‘পরের’ কার্য্য হইতে কখনও একবার ‘অবকাশ’ পাই, তাহা হইলে ‘নিজের’ (নিজ আত্মার) উন্নতি-সাধক কার্য্য করাই আমাদের অবশ্য কর্ত্তব্য। আর ইতিমধ্যে যদি কেহ আপনার ‘নিজের কার্য্য’ সম্পূর্ণ করিয়া থাকেন, তবে তিনি স্বচ্ছন্দে আনন্দ উপভোগ ও বিতরণ করিয়া কালাতিপাত করিতে পারে।

 ভাই বঙ্গদেশবাসি! আমরা প্রায় সকলেই দুর্গতিনাশিনী, আনন্দময়ী দুর্গার এই শারদীয় মহাপুজোপলক্ষে এ সময় কিছু কালের জন্য পরের কার্য্য বা দাসত্ব হইতে ‘অবকাশ’ পাইয়াছি, অতএব এখন আমাদের আপন আপন কার্য্য-সাধনে সর্ব্বান্তঃকরণে সচেষ্ট হইলে হয় না? কিন্তু, এই সময় এই কথাটী বিশেষ-রূপে স্মরণ রাখা উচিত;—যদি ‘নিজের’ কোন কার্য্য করিবার আন্তরিক ইচ্ছা থাকে, তাহা হইলে সর্ব্বাগ্রে আমাদের ‘আপনাকে’ (নিজ নিজ প্রাণ বা আত্মাকে) আপনার লৌকিক কার্য্য (মায়াবশে যে নিরর্থক কার্য্যকে ‘আপনার কার্য্য’ বলিয়া বোধ হয়, সেই কার্য্য) হইতে অবকাশ দিয়া স্বাধীন করিয়া লইতে হইবে। কারণ, প্রাণকে অবকাশ দিতে না পারিলে আমরা নিজের কার্য্য কখনই সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইব না।

 অতএব ভাই সকল! সাবধান, যেন ‘নিজের কার্য্য’ ভুলিয়া কেবল বৃথা হাসিয়া খেলিয়াই এই অমূল্য, দুর্লভ ও অস্থায়ী অবকাশের সময় কাটিয়া না যায়! আর যাঁহার নিজের কার্য্য সমস্তই সম্পন্ন বা পূর্ণ হইয়া আছে, তিনিও সাবধান, যেন এই নিত্যানন্দময়ী দুর্গাকে পাইয়াও ‘আনন্দ’-লাভে বঞ্চিত না হন। আর ভাই মাদৃশ মানব শরীর-সম্পন্ন জীব! তুমিও সাবধান, নয়নরঞ্জিনী প্রতিমা-রূপিণী আনন্দময়ীকে মৌখিক মন্ত্র দ্বারা আবাহন করিয়া,—লৌকিক উপচার দ্বারা পূজা করিয়া,—ছাগ মেষাদি বলিদান করিয়া,—ইত্যাদি যে কোন প্রকারেই নিজ আত্মোন্নতি-সাধক কার্য্য করিতে চেষ্টা কর না কেন, ইহা নিশ্চয় জানিও যে, যতদিন না অবকাশপ্রাপ্ত প্রাণের দ্বারা ‘আবাহন’ করিয়া,—“আর বিসর্জ্জন করিব না” এই ‘সঙ্কল্প’ করিয়া, শেষে প্রাণকেই ‘পূজার উপচার’ সাজাইয়া, এবং প্রাণের শক্রগণকে (রিপুগণকে) বলিদান করিয়া, সেই প্রাণেশ্বর নিত্যানন্দময়ী সকলদুর্গতিনাশিনী দুর্গার ‘প্রকৃত পূজা’ বা ‘অর্চ্চনা’ করিতে শিখিবে, ততদিন ‘নিজের কার্য্য’ করণে এমন কি, ‘মনুষ্য’-নাম গ্রহণেও অণুমাত্র সমর্থ হইবে না;—আনন্দময়ীর কৃপায় ‘আনন্দ’ লাভ ত অনেক দূরের কথা।

 মোহ-বিমোহিত আত্মবিস্মৃত এই নরাধম, যদিও সচ্চিদানন্দময়ী প্রাণেশ্বরী দুর্গার প্রায় কোন তত্ত্বই জানে না, এবং যাঁহারা সেই প্রাণারামবিধায়িনী বিশ্বপ্রসবিনী আনন্দময়ীর শ্রীচরণারবিন্দমকরন্দপানে আনন্দ-বিগলিত হইতে পারিয়াছেন, তাঁহাদিগকেও ইহার কোন কথা বলিবার নাই; তথাপি যাঁহারা ‘পরের কার্য্য’ হইতে অবকাশ পাইলেই ‘নিজের কার্য্য’ করিতে ভালবাসেন, দেবী দুর্গতিনাশিনী আনন্দময়ীর কৃপায় যদি তাঁহাদের ‘নিজের কার্য্য’ সিদ্ধি-বিধায়ক একটা কথাও এই ক্ষুদ্র পুস্তিকায় প্রকাশ পাইয়া থাকে তাহাও এ দীনের পক্ষে পরম শ্লাঘার বিষয়, এবং তাহা হইলেই ইহার শ্রেষ্ঠ মানব-শরীর-ধারণ সার্থক হইবে। ইতি।

শ্যামবাজার মিত্র-দেবালয়,কলিকাতা
ভাদ্র, ১৩০০ বঙ্গাব্দ।

আনন্দ-ভিখারী আত্মবিস্মৃত
প্রিয়নাথ।

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।

  1. অধুনা ইনি লোকান্তরিত হইয়াছেন।
  2. ‘মায়া’ আমাদিগের আত্ম-পর ভেদ-জ্ঞান জন্মাইয়া দেয় কেন, তদ্বিবরণ “জীবন-পরীক্ষা” নামক গ্রন্থে সামর্থ্যানুরূপ প্রকাশিত হইয়াছে।