বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ।

 প্রতাপাদিত্যের পূর্ব্বেই মহিষী ও বিভা উদয়াদিত্যের পলায়ন-সংবাদ অবগত হইয়াছিলেন। উভয়েই ভয়ে অভিভূত হইয়া ভাবিতেছিলেন যে, মহারাজ যখন জানিতে পারিবেন, তখন না জানি কি করিবেন। প্রতিদিন মহারাজ যখন এক একটি করিয়া সংবাদ পাইতেছিলেন, আশঙ্কায় উভয়ের প্রাণ ততই আকুল হইয়া উঠিতেছিল। এইরূপে সপ্তাহ গেল, অবশেষে মহারাজ বিশ্বাসযোগ্য যথার্থ সংবাদ পাইলেন। কিন্তু তিনি কিছুই করিলেন না। ক্রোধের আভাস মাত্র প্রকাশ করিলেন না। মহিষী আর সংশয়ে থাকিতে না পারিয়া একবার প্রতাপাদিত্যের কাছে গেলেন। কিন্তু অনেকক্ষণ উদয়াদিত্য সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিলেন না। মহারাজও সে বিষয়ে কোন কথা উত্থাপিত করিলেন না। অবশেষে আর থাকিতে না পারিয়া মহিষী বলিয়া উঠিলেন—“মহারাজ, আমার এক ভিক্ষা রাখ, এবার উদয়কে মাপ কর! বাছাকে আরো যদি কষ্ট দাও তবে আমি বিষ খাইয়া মরিব!”

 প্রতাপাদিত্য ঈষৎ বিরক্তিভাবে কহিলেন,—“আগে হইতে যে তুমি কাঁদিতে বসিলে! আমি ত কিছুই করি নাই!”

 পাছে প্রতাপাদিত্য আবার সহসা বাঁকিয়া দাড়ান, এই নিমিত্ত মহিষী ও-কথা আর দ্বিতীয় বার উত্থাপিত করিতে সাহস করিলেন না। ভীত মনে ধীরে ধীরে চলিয়া আসিলেন। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন গেল, মহারাজের কোন প্রকার ভাবান্তর লক্ষিত হইল না। তাহাই দেখিয়া মহিষী ও বিভা আশ্বস্ত হইলেন! মনে করিলেন, উদয়াদিত্য স্থানান্তরে যাওয়ায় মহারাজ মনে মনে বুঝি সন্তুষ্ট হইয়াছেন।

 এখন কিছু দিনের জন্য মহিষী একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন।

 ইতিপূর্ব্বেই মহিষী বিভাকে বলিয়াছেন ও বাড়িতে রাষ্ট্র করিয়া দিয়াছেন যে বিভাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইতে অনুরোধ করিয়া রামচন্দ্র রায় এক পত্র লিখিয়াছেন। বিভার মনে আর আহ্লাদ ধরে না। রামমোহনকে বিদায় করিয়া অবধি বিভার মনে আর এক মুহূর্ত্তের জন্য শস্তি ছিল না। যখনি সে অবসর পাইত, তখনি ভাবিত “তিনি কি মনে করিতেছেন? তিনি কি আমার অবস্থা ঠিক বুঝিতে পারিয়াছেন? হয় ত তিনি রাগ করিয়াছেন! তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলে তিনি আমাকে কি মাপ করিবেন না? হা জগদীশ্বর, বুঝাইয়া বলিব কবে? কবে আবার দেখা হইবে?” উল্‌টিয়া পাল্‌টিয়া বিভা ক্রমাগত এই কথাই ভাবিত। দবিানিশি তাহার মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা চাপিয়াছিল। মহিষীর কথা শুনিয়া বিভার কি অপরিসীম আনন্দ হইল, তাহার মন হইতে কি ভয়ানক একটা গুরুভার তৎক্ষণাৎ দূর হইয়া গেল। লজ্জাসরম দূর করিয়া হাসিয়া কাঁদিয়া সে তাহার মায়ের বুকে মুখ লুকাইয়া কতক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার মা কাঁদিতে লাগিলেন। বিভা যখন মনে করিল তাহার স্বামী তাহাকে ভুল বুঝেন নাই, তাহার মনের কথা ঠিক বুঝিয়াছেন—তখন তাহার চক্ষে সমস্ত জগৎ নন্দনকানন হইয়া উঠিল। তাহার স্বামীর হৃদয়কে কি প্রশস্ত বলিয়াই মনে হইল। তাহার স্বামীর ভালবাসার উপর কতখানি বিশ্বাস, কতখানি আস্থা জন্মিল! সে মনে করিল, তাহার স্বামীর ভালবাসা এ জগতে তাহার অটল আশ্রয়। সে যে এক বলিষ্ঠ মহাপুরুষের বিশাল স্কন্ধে তাহার ক্ষুদ্র সুকুমার লতাটির মত বাহু জড়াইয়া নির্ভয়ে অসীম বিশ্বাসে নির্ভর করিয়া রহিয়াছে, সে নির্ভর হইতে কিছুতেই সে বিচ্ছিন্ন হইবে না। বিভা প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। তাহার প্রাণ মেঘযুক্ত শরতের আকাশের মত প্রসারিত, নির্ম্মল হইয়া গেল। সে এখন তাহার ভাই সমরাদিত্যের সঙ্গে ছেলেমানুষের মত কত কি খেলা করে। ছোট স্নেহের মেয়েটির মত তাহার মায়ের কাছে কত কি আবদার করে, তাহার মায়ের গৃহকার্য্যে সাহায্য করে। আগে যে তাহার একটি বাক্যহীন, নিস্তব্ধ, বিষণ্ণ ছায়ার মত ভাব ছিল, তাহা ঘুচিয়া গেছে—এখন তাহার প্রফুল্ল হৃদয়খানি পরিস্ফুট প্রভাতের ন্যায় তাহার সর্ব্বাঙ্গে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে। আগেকার মত সে সঙ্কোচ, সে লজ্জা, সে বিষাদ, সে অভিমান, সেই নীরব ভাব আর নাই। সে এখন আনন্দভরে বিশ্বস্ত ভাবে মায়ের সহিত এত কথা বলে যে আগে হইলে বলিতে লজ্জা করিত, ইচ্ছাই হইত না। মেয়ের এই আনন্দ দেখিয়া মায়ের অসীম স্নেহ উথলিয়া উঠিল। মনের ভিতরে ভিতরে একটা ভাবনা জাগিতেছে বটে—কিন্তু বিভার নিকট আভাসেও সে ভাবনা কখন প্রকাশ করেন নাই। মা হইয়া আবার কোন্ প্রাণে বিভার সেই বিমল প্রশান্ত হাসিটুকু একতিল মলিন করিবেন! এই জন্য মেয়েটি প্রতিদিন চোখের সামনে হাসিয়া খেলিয়া বেড়ায়, মা হাস্য-মুখে অপরিতৃপ্ত নয়নে তাহাই দেখেন।

 মহিষীর মনের ভিতর নাকি একটা ভয়, একটা সন্দেহ বর্ত্তমান ছিল, তারই জন্য আজ কাল করিয়া এ পর্য্যন্ত বিভাকে আর প্রাণ ধরিয়া শ্বশুরালয়ে পাঠাতে পারিতেছেন না। দুই এক সপ্তাহ চলিয়া গেল, উদয়াদিত্যের বিষয়ে সকলেই এক প্রকার নিশ্চিন্ত হইয়াছেন। কেবল, বিভার সম্বন্ধে যে কি করিবেন, মহিষী এখনো তাহার একটা স্থির করিতে পারিতেছেন না। এমন আরো কিছু দিন গেল। যতই বিলম্ব হইতেছে। —ততই বিভার অধীরতা বাড়িতেছে। বিভা মনে করিতেছে—যতই বিলম্ব হইতেছে, ততই সে যেন তাহার স্বামীর নিকট অপরাধী হইতেছে। তিনি যখন ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন—তখন আর কিসের জন্য বিলম্ব করা! একবার তিনি মার্জ্জনা করিয়াছেন, আবার—। কয়েক দিন বিভা আর কিছু বলিল না—অবশেষে একদিন আর থাকিতে পারিল না; মায়ের কাছে গিয়া মায়ের গলা ধরিয়া, মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বিভা কহিল, “মা।” ঐ কথাতেই তাহার মা সমস্ত বুঝিতে পারিলেন, বিভাকে বুকে টানিয়া লইয়া কহিলেন, “কি বাছা!” বিভা কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অবশেষে কহিল, “মা, তুই আমাকে কবে পাঠাইবি মা!” বলিতে বলিতে বিভার মুখ কান লাল হইয়া উঠিল। মা ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন —“কোথায় পাঠাইব বিভু!” বিভা মিনতির স্বরে কহিল—“বল না মা।” মহিষী কহিলেন, “আর কিছু দিন সবুর কর বাছা। শীঘ্রই পাঠাইব।” বলিতে বলিতে তাঁহার চক্ষে জল আসিল।