ঝাঁশির রাণী/যুদ্ধে রাণীর মৃত্যু

উইকিসংকলন থেকে

যুদ্ধে রাণীর মৃত্যু।

২৩ মার্চ হইতে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ১১ দিবস, ইংরাজেরা, ঝাঁশি ঘেরাও করিয়া, ঝাঁশিসৈন্যের সহিত দিবারাত্র ঘোরতর যুদ্ধ করিয়াছিল; তথাপি রাণীঠাকুরাণীর অপরিসীম সাহস ও দৃঢ়নিশ্চয়তা প্রযুক্ত তাহারা বিশেষ কিছু করিয়া উঠিতে পারে নাই। শুধু তাহা নহে, ইংরাজদিগের যুদ্ধসামগ্রী নিঃশেষিত হওয়ায় তাহারা অত্যন্ত দুৰ্বল হইয়া পড়িয়াছিল। ঠিক এই সময়ে দৈব তাহাদিগের অনুকূল হইলেন। তাত্যাটোপের সৈন্য, ইংরাজের সহিত যুদ্ধে পরাভূত হইয়া, সমস্ত যুদ্ধসামগ্রী রণক্ষেত্রে ফেলিয়া পলায়ন করায়, সেই সমস্ত যুদ্ধসামগ্রী অনায়াসে ইংরাজের হস্তগত হইল। এইক্ষণে সরূ-হিউ-রোজ, ঝাশি অবরোধ করিয়া নিশ্চিন্তভাবে বসিয়া না থাকিয়া, একেবারে হল্লা করিয়া কেলার মধ্যে প্রবেশ করিবার সঙ্কল্প করি এবং এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার জন্য গুপ্তভাবে উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। সমস্ত সৈন্যকে বিভক্ত করিয়া, এক এক কাজে নিযুক্ত করিলেন। প্রথম বিভাগের সৈন্য বপ্র-প্রাকারে সিঁড়ি লাগাইয়া কেল্লার মধ্যে প্রবেশ করিবে। দ্বিতীয় বিভাগ, তলবার ও সঙ্গীন লইয়া শত্রুর সহিত সম্মুখযুদ্ধ করিয়া সহরের কোন এক দ্বারের মধ্য দিয়া সহরে প্রবেশ করিবে, এইরূপ যুক্তি স্থির হইল এবং এই যুক্তি অনুসারে, প্রভাতকালে, সমস্ত ইংরাজসৈন্য কেল্লার অভিমুখে চাল আরম্ভ করিল। বরে মুখ্য দরজার দিকে ইংরাজসৈন্য আসিতেছে দেখিবামাত্র তত্রস্থ প্রহরীরা ভয়-সূচক শিঙ্গা ও রণবাদ্য বাজাইয়া ঝুঁশির সমস্ত সৈন্যকে এই বার্তা ইঙ্গিতের দ্বারা অবগত করাইল ও তখনই প্রস্তুত হইয়া স্বস্ব কর্তব্যে নিযুক্ত হইল।

 তাত্যাটোপের পরাভববার্তা শুনিয়া রাণীঠাকুরাণী একটু হতাশ হইয়া পড়িয়াছিলেন। প্রবল ইংরাজ-সৈন্যের সহিত আর পারিয়া উঠিবেন না,লেন। এইরূপ তাঁর মনে হইতেছিল। তাহার সৈন্যমধ্যেও এই কারণে, উদাসভাব স্পষ্টরূপে লক্ষিত হইতেছিল। এইরূপ অবস্থা দেখিয়া রাণীঠাকুরাণী তাহার সারদিগকে ডাকাইয়া একত্র করিলেন এবং আবেশময় বাক্যে তাহাদিগকে এইরূপ বলিলেন—“আজ পর্যন্ত ঝুঁশি, ইংরাজের সহিত যে লড়িয়াছে সে পেশোয়ার বলের উপর নির্ভর করিয়া লড়ে নাই এবং কখনও তাহার সাহায্য আমাদের আবশ্যক হয় নাই। আজ পর্যন্ত তোমরা যেরূপ আপন স্বাভিমান, আপন সাহস, আপন ধৈর্য্য, আপন শৌর্য্য পূর্ণরূপে প্রকাশ করিয়া আপন খ্যাতি চারিদিকে বিস্তার করিয়াছ, সেইরূপ এখনও প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া কঁশি সংরক্ষণ করা তোমাদের কর্তব্য।” এইরূপে রাণীঠাকুরাণী, উৎসাহজনক বাক্য বলিয়া, সৈন্যের প্রধান প্রধান লোকদিগকে সুবর্ণ বলয় ও পরিচ্ছদ বকশিশ করিলেন; ইহাতে সৈন্যগণ পুনৰ্বার উত্তেজিত হইয়া উঠিল; পুনর্বার রণোৎসাহে তাহাদের হৃদয় পূর্ণ হইল। ঝুঁশির মুখ্য গোলন্দাজ গুলাম গোষ-খা, তোপের উত্তম বন্দোবস্ত করিয়া পূর্ববৎ ইংরাজ-সৈন্যের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করিতে লাগিল। স্বয়ং রাণীঠাকুরাণী কেল্লার বন্দোবস্ত ঠিক করিবার জন্য, বপ্রের উপর ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে লাগিলেন। সেই রাত্রে ইংরাজ গোলন্দাজরাও কেল্লা ও সহরের উপর ভয়ঙ্কর গোলাবর্ষণ করিয়া বপ্র-প্রাকারের স্থানে স্থানে, সছিদ্র ও ভগ্নপ্রায় করিয়া তুলিয়াছিল। ইংরাজের গহ্বরনলী তোপ হইতে, ঝুঁশির প্রাসাদের উপর গোলাবৃষ্টি হওয়ায় তাহারও অনেকটা জখম হইয়াছিল। তাহার দ্বিতীয়তলে গণপতির সিংহাসন ও আয়না-ঘর ছিল। এই আয়নাঘর, লক্ষ্ণৌয়ের উৎকৃষ্ট মূল্যবান্ আর্শির দ্বারা সজ্জিত ছিল। ইহার উপর গোলা আসিয়া পড়ায় কাচের সামগ্রী সব চুরমার হইয়া গিয়াছিল এবং “কুল্পী গোলা” হইতে পেরেক ও ছাগু। চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ায় রাজবাটীর চারিজম লোক নিহত হয়। ইহাতে চারিদিকে হাহাকার পড়িয়া গিয়াছিল। কিন্তু রাণীঠাকুরাণী কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া কোমরে তলবার বাঁধিয়া, বরে উপর উত্তম বন্দোবস্ত করিলেন এবং সৈন্যগণকেও উত্তেজিত করিয়া তুলিলেন। পুনর্ব্বার ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল।

 ইংরাজ-সৈন্য কেল্লা আক্রমণ করিবার অভিপ্রায়ে সবেগে আসিতেছে। দেখিয়া, সহরের ব ও কেল্লার বুরুজ হইতে ঝাঁশির সৈন্য তাহাদিগের উপর তোপ চালাইতে আরম্ভ করিল-“তোপের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে ইংরাজ-সৈন্য একেবারে ধ্বংশপ্রায় হইল, তথাপি উহার। প্রাণের আশা ছাড়িয়া দিয়া সাহসের উপর ভর করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল এবং বপ্র-প্রাকারে সিঁড়ি লাগাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু কিছুতেই পারিয়া উঠিল না। কিয়ৎকালের জন্য কেল্লার লোকেরা সুচারু- রূপে ব সংরক্ষণ করিয়াছিল। কিন্তু অবশেষে ব্রিগেডিয়ার স্টুয়ার্ট সহরের বোচ্ছ দরজা হস্তগত করিয়া দক্ষিণ দিকে আক্রমণ করায় প্রাপরিস্থ গোলন্দাজ সৈন্য হতাশ হইয়া পলাইতে লাগিল। ষ্টুয়ার্টের সৈন্য জয়লাভ করিয়াছে শুনিয়া অন্যান্য বিভাগের ইংরাজ-সৈন্যমধ্যেও উৎসাহ বিস্ফুরিত হইয়া উঠিল; এবং এক্ষণে সকল দিক হইতেই তাহারা সিঁড়ি লাগাইয়া বপ্রের উপর উঠিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। অবশেষে এক সহস্র ইংরাজ-সৈন্য প্রের উপর উঠিতে সমর্থ হইল। এই সময়ে সর- হিউয়োজ তাহার অধীনস্থ সৈন্য লইয়া “বোছা” দরজার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং তিনিও সহরের দিকে চাল আরম্ভ করিলেন। ঝাঁশি-সহরের মধ্যভাগে এক প্রকাণ্ড রাজবাটী ছিল এবং তাহার সংরক্ষণার্থ কতকগুলি লোক তথায় রক্ষিত হইয়াছিল। সর হিউরোজ তাহাদিগকে আক্রমণ করিয়া রাজবাটী হস্তগত করিবার সঙ্কল্প করিলেন।

 এদিকে রাণীঠাকুরাণী, কেল্লার সমস্ত তোপ-মঞ্চ সাপ্লাইবার সুন্দর বন্দোবস্ত করিতেছিলেন। এমন সময়ে যখন শুনিলেন, সহরের দক্ষিণ বপ্র ইংরাজের হস্তগত হইয়াছে, তখন তাহার হৃদয়ে যেন শত বৃশ্চিক দংশন করিল; তাঁহার মুখমণ্ডল পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেল। তিনি কেল্লার উপর আসিয়া শূন্য দৃষ্টিতে সহরের দক্ষিণ দিকে অবলোকন করিতে লাগিলেন সহস্র গোরা-সৈন্য সহরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া হাহাকার উঠাইয়াছে, ইহা তাহার দৃষ্টিপথে পতিত হইল। এই সময়ে কিছুকালের জন্য নৈরাশ্য ও ভীতির চিহু তাঁহার মুখে প্রকাশ পাইয়াছিল; কিন্তু একটু পরেই আপনাকে সালাইয়া শূরত্বের আবেশে হৃদয়কে পূর্ণ করিয়া শেষ পর্যন্ত ইংরাজদিগের সহিত যুদ্ধ করিবেন, এইরূপ দৃঢ় সঙ্কল্প করিলেন।

 অনেক দিনের পুরাতন ভৃত্য এইরূপ দেড় হাজার মুসলমান ও আরবী সৈন্য সঙ্গে লইয়া রাণীঠাকুরাণী সত্বর কেল্লার নীচে অবতরণ করিলেন, এবং কেল্লার বড় দরজা দিয়া বাহির হইয়া, দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হইলেন। সহরের দক্ষিণ বপ্রের উপর দিয়া যে সহস্র গোরা-সৈন্য সহরে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারা তৎক্ষণাৎ তলবার উত্তোলন করিল। রাণীঠাকুরাণী সকলের পশ্চাতে ছিলেন। তিনি এই সময়ে মহা আবেশ সহকারে নগ্ন তুলবার উঠাইয়া সকলের মধ্যভাগে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গোরা-সৈন্য ও ঝুঁশি-সৈন্যের পরম্পর সাক্ষাৎকার হওয়ায়, তলব রে তলবারে ঝনাৎকার উঠাইয়া দুই পক্ষের লোকই একসঙ্গে মিশাইয়া গেল। এই যুদ্ধে অনেক গোরা নিহত হইল—যাহার অবশিষ্ট ছিল, তাহারা সহরের দিকে পলাইয়া গিয়া, বৃক্ষ ও গৃহের অন্তরাল হইতে বন্দুক ছুড়িতে লাগিল। পশ্চাৎ হইতে একদল গোরা-সৈন্য আসিয়াছিল, তাহারাও তলবার না চালাইয়া, দূর হইতে বন্দুকের গুলিবর্ষণ করিতে লাগিল। এই সময়ে রাণীর পুরাতন সর্দারেরা তাঁহার সম্মুখে আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া বলিতে লাগিল “মহারাণি, এই সময়ে সম্মুখে অগ্রসর হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া আপনার কর্তব্য নহে। গোরা-সৈন্য ইমারতের আড়াল হইতে গুলি মারিতেছে—তা ছাড়া শত শত গোরা সহরে প্রবেশ করিয়াছে। সহরের সকল দরজাই খোলা—এক্ষণে সহরের মধ্যে যুদ্ধ করিবার কোন অর্থ নাই। তদপেক্ষা, কেল্লার ভিতরে গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া ঈশ্বর যাহা যুক্তি দেন তাহাই আমাদের করা ভাল। ফিরিয়া যাইবার ইহাই সময়।” এই কথা বলিয়া, তাহারা রাণী ঠাকুরাণীর হাত ধরিয়া ফিরাইয়া দিল। তখন তিনি সৈন্য সমভিব্যাহারে আবার কেল্লার আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।

 এদিকে গোরা-সৈন্য চারিদিকের দরজা দিয়া সহরের মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল; পাঁচ বৎসর বয়স্ক হইতে ৮০ বৎসর বয়স্ক পর্যন্ত পুরুষ দেখিবামাত্র তাহারা গুলি কিম্বা তলবারের দ্বারা নিহত করিতে লাগিল; সহরের একদিকে আগুন লাগাইয়া দিল। সেই সময় সহরের মধ্যে যেরূপ হাহাকার উঠিয়াছিল তাহা অবর্ণনীয়। মেষপালের মধ্যে ব্যাঘ্র আসিয়া পড়িলে যেরূপ দশা হয়, লোকেরা প্রাণভয়ে আকুল হইয়া সেই রূপ পলাইতে লাগিল। কেহ বা গলির মধ্যে প্রবেশ করে, কেহ বা গৃহের বিকট স্থানে গিয়া লুকায়, কেহ বা দাড়ি গোঁপ কামাইয়া স্ত্রীবেশ ধারণ করে, এই প্রকার যে যেরূপ পরিল, প্রাণ বাঁচাইবার উপায় চেষ্টা করিতে লাগিল। গোরারা সহরে প্রবেশ করিয়া সহর একবারে বিজন করিয়া তুলিল; সহরের মধ্যভাগে “ভিড়ার বাগ” নামক একটা উদ্যান ছিল, তাহার মধ্যে সহস্র সহস্র লোক আশ্রয় লইয়াছিল। সেখানেও যখন গোরারা প্রবেশ করিল, তখন সেই সকল লোক অতি দীনভাবে ভূমির উপর সাষ্টাঙ্গ হইয়া করুণস্বরে বলিতে লাগিল “আমি নিরপরাধী কৃষক; আমি যুদ্ধের মধ্যে নাই—দয়া করিয়া আমার প্রাণদান করুন।” তাহাদিগের এইরূপ করুণবাক্য শুনিয়া ইংরাজ সেনানায়কের দয়া হইল; তিনি সেই প্রণত লোকদিগকে অভয়-বচন দিয়া, উদ্যানের চারিদিকে পাহারা বসাইয়া দরজায় তালা লাগাইয়া দিলেন। এবং এইরূপ হুকুম প্রচার করিলেন যে, বাহিরের লোককে ভিতরে আসিতে এবং ভিতরের লোককে বাহিরে যাইতে কদাচ দেওয়া না হয়। কিন্তু অন্য দিকের গোরারা লোকের গৃহে প্রবেশ করিয়া তাহাদিগকে হত্যা করিয়া সোণা-রূপার সামগ্রী লুট করিতে লাগিল। পুরুষ দেখিলেই ধরিতে লাগিল, যতক্ষণ না তাহাদের অর্থ-সম্পত্তি তাহাদের হস্তগত হইল, ততক্ষণ তাহাদের ছাড়িল না—এমন কি অর্থ পাইলেও, শেষে তাহাদিগকে গুলি করিয়া মারিতে লাগিল। কিন্তু এ কথা বলিতে হইবে স্ত্রীলোকদিগকে উহারা কখন ইচ্ছাপূর্বক মারে নাই। তবে কোন কোন স্থলে এরূপ ঘটিয়াছে, গোরারা সম্মুখের দ্বার দিয়া গৃহে প্রবেশ করিয়াছে। দেখিয়া ঘরের স্ত্রীলোকেরা সতীত্বনাশের ভয়ে পশ্চাতের দ্বার দিয়া বাহির হইয়া কূপের মধ্যে পড়িয়া আত্মহত্যা করিয়াছে। কোথাও বা এরূপও ঘটিয়াছে, ঘরে প্রবেশ করিয়া গোরারা পুরুষকে গুলি করিতেছে, সেই সময় তাহার স্ত্রী আসিয়া স্বামীর কোমর জড়াইয়া ধরিয়াছে—সেই অবস্থায় গুলি স্বামীর গায়ে না লাগিয়া স্ত্রীর গায়ে লাগিয়া সে নিহত হইয়াছে।

 যাহা হউক সন্ধ্যাকাল পর্যন্ত গোরারা এইরূপ লুটপাট করিয়া অবশেষে স্বস্থানে প্রস্থান করিল।

 সইর ইংরাজদিগের হস্তগত হইলে, স-হিউ-রোজ রাজবাটী আক্রমণ করিবার জন্য অগ্রসর হইলেন। রাজবাটীর প্রহরীরা প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া রাজবাটী সংরক্ষণের প্রযত্ন করিল। এই যুদ্ধে অনেক গোরা নিহত ও আহত হইল। কিন্তু ইংরাজের সংখ্যা অধিক থাকায় এবং রাজবাটীর চতুর্দিকস্থ ঘরে আগুন লাগাইয়া দেওয়ায়, প্রহরীরা অতিষ্ঠ হইয়া উঠিল, অবশেষে গোরাসৈন্য হল্লা করিয়া রাজবাটীর মধ্যে প্রবেশ করিল। রাজবাটী হস্তগত হইলে, ইংরাজেরা তত্রস্থ লোকদিগকে নিহত করিল। রাজবাটীর চতুর্দিকে ঝুঁশির একদল অশ্বারোহী প্রহরী ছিল, তাহারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করিয়াছিল। অবশেষে তাঁহারাও নিহত হইল। এইক্ষণে সমস্ত রাজবাটী ইংরাজের হস্তগত হওয়ায়, গোরারা প্রাসাদের মূল্যবান্ সামগ্রী সকল লুটপাট করিতে লাগিল। এই সকল সামগ্রীর মধ্যে, ব্রিটিশ রাজচিহ্নাঙ্কিত ধ্বজা—“য়ুনিয়ন্ জ্যা” ইংরাজ-সৈন্যের হস্ত- গত হওয়ায় তাহারা পরমানন্দ লাভ করিল এবং সেই ধ্বজা মহা বিজয়োৎ- সাহে রাজবাটীর উপরে উঠাইয়া তথায় ব্রিটিশ আধিপত্য পুনঃস্থাপিত করিল।

 এদিকে রাণীঠাকুরাণী, ঝাশি সৈন্যের বিজয় লাভ হইতেছে না দেখিয়া, কেল্লার প্রাসাদে ফিরিয়া আসিলেন এবং শোকবিহ্বল হইয়া নিশ্চলভাবে বৈঠকখানা ঘরে আসিয়া বসিলেন। সেই তেজস্বিনী মহিলার এইরূপ দীন অবস্থা দেখিয়া, তাহার আশ্রিত-মণ্ডলীর অত্যন্ত কষ্ট হইল; চিন্তাকুল হইয়া এক্ষণে কি কর্তব্য, মৃদুস্বরে তাহারই বিচার করিতে লাগিল। এক প্রহরের পর, রাণীঠাকুরাণী, সহরের কিরূপ দশা হইয়াছে দেখিবার জন্য বারাণ্ডায় আসিলেন। সেই সময়ে যেরূপ হৃদয়- বিদারক তাঁহার দৃষ্টিপথে পতিত হইল, তাহা দেখিয়া তিনি আর অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিলেন না। “হলবাইপুরা” নামক সহরের সমৃদ্ধিসম্পন্ন প্রধান ভাগে অগ্নি লাগায় সেখানে হাহাকার উঠিয়াছিল। সেই ভরপূর গ্রীষ্মকালের প্রতপ্ত সূর্য্যকিরণের মধ্যে, এই অগ্নিশিখা প্রজলিত হওয়ায় সহরের লোক অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল। চারিদিকে ক্রন্দন ও হাহাকার রবকে কোথায় পলাইবে তাহার ঠিক নাই। শত শত বন্দুকের আওয়াজ শুনা যাইতেছে আর শত লোক নিহত হইতেছে। এইরূপ ভীষণ দৃশ্য অবলোকন করিয়া, রাণীঠাকুরাণী কিয়ৎকালের জন্য একেবারে স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। এই সময়ে আবার শুনিলেন, কেল্লার মুখ্য দ্বার-সংরক্ষণকারী সরদার কুম্বর-খুদাবক্স এবং তোপখানার প্রধান গোলন্দাজগুলাম-গোষ-খান্ ইহারা উভয়েই মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন। এই সংবাদ শুনিয়া রাণীঠাকুরাণী আরও হতাশ হইয়া পড়িলেন। তিনি আপনার অধীনস্থ প্রধান প্রধান লোকদিগকে ডাকাইয়া এইরূপ বলিলেন, “আমরা আজ পর্যন্ত ইংরাজ-সৈন্যের সহিত প্রাণপণ যুদ্ধ করিয়া ঝাশি সংরক্ষণ করিয়াছি, কিন্তু এখনও আমাদের জয়লাভ হইবার কোন চিন্তু দেখা যাইতেছে না। আমাদিগের বীরচুড়ামণি ও গোলন্দাজেরা নিহত হইয়াছে; সুতরাং বপ্রের বন্দোবস্ত যথারীতি না হওয়ায় বপ্র ইংরাজদিগের হস্তগত হইয়াছে। সহরমধ্যে, ইংরাজ-সৈন্য,যত্র তত্র পথরোধ করিয়া বসিয়া আছে। এক্ষণে, হল্লা করিয়া কেল্লার। মধ্যে প্রবেশ করা উহাদিগের সহজ হইয়াছে।

 কেল্লা উহাদিগের হস্তগত হইলে, আমাদিগকে কয়েদ করিয়া, কিরূপ প্রকারে যে উহারা আমাদিগের প্রাণনাশ করিবে তাহার কিছুই ঠিকানা নাই। এইহেতু, বারুদের দ্বারা রাজবাটী উড়াইয়া দিয়া, সেই সঙ্গে আমার ইহলীলা সাঙ্গ করিব এইরূপ সংকল্প করিয়াছি। গোরাদিগকে আমার দেহ স্পর্শ করিতে কখনই দিব না। অতএব, যাহাদিগের মরিতে ইচ্ছা আছে, তাহারা এইখানে থাকুক, বাকী সকলে, আজ রাত্রেই কেল্লা ছাড়িয়া সহরের মধ্যে চলিয়া যাউক এবং আপনার প্রাণ বাচাইবার চেষ্টা দেখুক”। রাণীঠাকুরাণীর এই কথা শুনিয়া, একজন বৃদ্ধ সর্দারের অত্যন্ত কষ্ট হইল; সম্মুখে অগ্রসর হইয়া বিনয়পূর্বক রাণীঠাকুরাণীকে এইরূপ বলিল –“মহারাণি, আপনি কিঞ্চিৎ শান্ত হউন। ঈশ্বরই এই দুঃখ এই সহরের উপর আনিয়াছেন। তাহার আর উপায় নাই। সকল বিষয়ই পূর্ব্বসঞ্চিত কর্ম্মানুসারে হইয়া থাকে। আত্মহত্যা করা মহাপাপ। এই জন্মেই পূর্ব্বপাতকের ফলভোগ করিতেছি, তাহার উপর আর এক মহাপাতকের ভার চাপানো উচিত নহে। যে দুঃখই আসুক না কেন, তাহা দ্বিরুক্তি না করিয়া সহ্য করা আবশ্যক। তাহা হইলে, পরে আর উহার কোন উপসর্গ থাকিবে না। আপনি বীরাঙ্গনা, আত্মহত্যার কথা মনেই আনিবেন না। বিপদ আসিয়াছে; তাহা হইতে এখন উদ্ধার হইতে হইবে। এক্ষণে কেল্লার মধ্যে থাকা যদি নিরাপদ না হয়, তবে আসুন আমরা আজ রাত্রেই শত্রুর ঘের ভাঙ্গিয়া সহরের বাহিরে চলিয়া গিয়া পেশোয়ার সৈন্যের সহিত মিলিত হই। ইতিমধ্যে যদি মৃত্যু আসে তো খুবই ভাল। এখানে আত্মহত্যা করিয়া পাতক সঞ্চয় করা অপেক্ষা, সম্মুখযুদ্ধে রক্তধারায় স্নান করিয়া স্বর্গারোহণ করা অতীব প্রার্থনীয়”। এই কথা শুনিয়া, রাণীঠাকুরাণী একটু আশ্বস্ত হইলেন এবং তাহার হৃদয় আবার বীরভাবে পূর্ণ হইল।

“ধর্মযুদ্ধে মৃতােবাপি তেন লােকয়ং জিতং ।”

 এই উপদেশ বাক্য অনুসারে, তিনি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করিয়া প্রাণত্যাগ করিবেন এইরূপ সংকল্প করিলেন। কিন্তু শ্রীমন্ত দামোদররাও বলেন, এই বৃত্তান্ত ঠিক্ নহে। আসল কথা, “রাণীঠাকুরাণীর প্রধান কর্মচারিমণ্ডলীই হতাশ হইয়া বারুদে আগুন লাগাইয়া প্রাণত্যাগ করিবার প্রস্তাব করে, এবং রাণীঠাকুরাণী এই প্রস্তাবে অনুমোদন না করিয়া, যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিবেন, এইরূপ সংকল্প করেন।”

 সে যাহাই হউক, সন্ধ্যার পর, রাণীঠাকুরাণী আপনার নিকটস্থ পরিজন মণ্ডলীকে ডাকাইয়া আনাইয়া তাহাদিগের নিকট অন্তিম বিদায় গ্রহণ করিলেন এবং তাহাদিগকে যোগ্য পুরস্কারাদি দিয়া, কেল্লার গুপ্তদ্বার দিয়া সহরের মধ্যে পাঠাইয়া দিলেন। এই চিরবিচ্ছেদ-প্রসঙ্গে, রাণীঠাকুরাণীর অনেকদিনকার পুরাতন ব্রাহ্মণ ভৃত্য ও দাসীগণ এবং অন্যান্য আশ্রিতমণ্ডলীর দারুণ কষ্ট উপস্থিত হইল। সকলেই অপূর্ণ- নয়নে প্রিয় স্বামিনীর পাদবন্দনা করিয়া বিদায় গ্রহণ করিল। গুলি প্রভুভক্ত সেবক, রাণীঠাকুরারাণীর সহিত যাইবার জন্য প্রস্তুত হইল এবং তাহাদিগের ইচ্ছা জানাইয়া তাহার অনুমতি গ্রহণ করিল। রাত্রি ১২ ঘটিকার সময় সমস্ত প্রস্তুত করিয়া রাণীঠাকুরাণী কেল্লা হইতে বাহির হইবার সঙ্কল্প করিলেন। তাঁহার পিতা, মে পিতাবে প্রভৃতি আত্মীয়-মণ্ডলী সকলে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। পথ- খরচা হিসাবে কিঞ্চিৎ অর্থ থলিয়ার মধ্যে ভরিয়া, তাহারা অশ্বারোহী কতকঅনুচরবর্গের জিম্মা করিয়া দিলেন; এবং সংস্থানের কুলপরম্পরাগত। রত্নাদি, হস্তিপৃষ্ঠে হাউদায় ভরিয়া, সেই হস্তী আপনাদিগের মধ্যভাগে রাখিলেন। প্রায় দুই শত বাছা বাছা সওয়ার সঙ্গে লইয়া ও পাঠান প্রভৃতি বিজাতীয় সৈন্য সমভিব্যাহারে প্রধান সর্দারগণ কেল্লা হইতে বাহির হইবার নিমিত্ত তৎপর হইল। স্বয়ং রাণীঠাকুরাণী পুরুষবেশ করিলেন, অঙ্গে তার-জড়িত বৰ্ম ধারণ করিলেন এবং কোমরে কিরিচ, প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রের সহিত একটি দিব্য তলোয়ার ঝুলাইয়া আড়াই হাজার টাকা মূল্যের একটি সাদা রঙ্গের তেজালো ঘোড়ার উপর আরোহণ করিলেন। আপনার সঙ্গে তিনি কিছুমাত্র অর্থাদি লইলেন না। কেবল একটি রূপার পেয়ালা বস্ত্রাঞ্চলে বাঁধিয়া লইলেন এবং একটি অল্পবয়স্ক ক্ষুদ্র বালককে রেশমের কাপড়ে বঁধিয়া পৃষ্ঠোপরি লইলেন। এই বালকটিই যে রাণীঠাকুরাণীর প্রাণপ্রিয় দত্তকপুত্র দামোদর রাও, তাহা বোধ হয়। পাঠককে বলিতে হইবে না।

 যাত্রার সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত হইলে পর, “জয়শঙ্কর” “হর হর মহাদেব” এইরূপ বাক্য উৎসাহভরে গর্জন করিতে করিতে সৰ্বমণ্ডলী কেল্লার নীচে অবতরণ করিলেন। প্রথমতঃ তাহারা কেল্লার সুরঙ্গ-রাস্তা। দিয়া যাইবেন মনে করিয়াছিলেন, কিন্তু মধ্যরাত্রিপ্রযুক্ত সে রাস্তা খুঁজিয়া পাওয়ায়, অতীব দক্ষতা-সহকারে কেল্লাবুরুজের উপর দিয়া, ইংরাজ- সৈন্যের গতিবিধির উপর নজর রাখিয়া, সহরের মধ্যস্থিত উত্তর দরজা দিয়া বাহির হইয়া পড়িবেন, এইরূপ মৎলব করিলেন। যে সময়ে রাণীঠাকু- রাণী, ঝাশিকে শেষ নমস্কার দিয়া, সমস্ত সৈন্য সমক্ষে, আপনার সেই তেজস্বী অশ্বকে পূর্ণবেগে ছুটাইয়া চলিলেন, সেই সময়ে সর্বলোক রাণীঠাকুরাণীকে বিদায়-নমস্কার দিবার জন্য, রাস্তার দুই পার্শ্বে, কেল্লার মধ্যে দণ্ডায়মান ছিল। রাণীঠাকুরাণী সকলের নিকট সপ্রেম বিদায় গ্রহণ করিয়া, অতি সত্বর, কতকগুলি সওয়ার-সমভিব্যাহারে, উত্তর দরজা দিয়া বাহির হইয়া পড়িলেন। সেই দরজার বাহিরে ‘তেহরী’ রাজ্যের তোপমঞ্চ স্থাপিত ছিল। তোপ-মঞ্চের লোকেরা বাধা দেওয়ায়, “ইহা তেহরীর ফৌজ, রোজ সাহেবের সাহায্যে যাইতেছে” এই কথা বলিয়া রাণীঠাকুরাণী অতীব কৌশল-সহকারে, সেই স্থান পার হইয়া গেলেন। রাণীঠাকুরাণীর দল চলিয়া গেলে, তাহার পশ্চাতে তাহার যে সৈন্য আসিতেছিল, ইংরাজসৈন্য তাহাদিগের গতিরোধ করিল। এবং উভয় সৈন্যের মধ্যে গোলাগুলি বর্ষণ আরম্ভ হইয়া মহাযুদ্ধ বাধিয়া গেল। এদিকে, একজন দাসী, একজন বন্দুকধারী অশ্বারোহী, আর দশ পেনেরো জন সওয়ার, ইহাদিগের সহিত রাণীঠাকুরাণী, শত্রু-ছাউনীর মধ্য দিয়া একেবারে কাল্পীর রাস্তায় গিয়া পড়িলেন। সেই সময় ইংরাজ-সেনাপতি সহিউ-রোজ রাণীর পলায়নের বৃত্তান্ত জানিতে পারিয়া তাহাকে অনুধাবন করিবার জন্য লেফটেনেণ্ট বৌকরের নেতৃত্বাধীনে কতকগুলি সওয়ার পাঠাইলেন। কিন্তু রাণীঠাকুরাণীর অশ্ব অতীব দ্রুতগামী হওয়ায়, পলকের মধ্যে বিদ্যুৎবেগে ঘোড়া ছুটাইয়া রাণী অদৃশ্য হইয়া পড়িলেন; ইংরাজ সওয়ারেরা বরাবর তাহার অনুসরণ করিয়াছিল; অবশেষে রাত্রি হওয়ায় আর তাহার সন্ধান পাইল না!

 রাণীঠাকুরাণী কেল্লা ছাড়িয়া চলিয়া গেলে, তাহার পরদিন সকালে, তৃতীয় য়ুরোপীয় পণ্টনের অধিনায়ক, লেফটেনেণ্ট বেগ্রী কঁশির কেল্লার উপর আরোহণ করিলেন। গিয়া দেখিলেন, কেল্লার দরজা একেবারে উদঘাটিত; তিনি পরমানন্দে তাহার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। ভিতরে গিয়া দেখিলেন, একটি মাত্র মনুষ্য নাই। সমস্ত কেল্লা বিনা আয়াসে তাহার হস্তগত দেখিয়া, নিশ্চিন্তমনে তথায় তাহার বিজয়ধ্বজা স্থাপন করিলেন।

 কর্ণেল মেডোজ টেলর সাহেব, রাণীর পলায়ন-ব্যাপার এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন –“অবশেষে,—তখনও অনেক রাত্রি—কেল্লার যে ভাগটি অত্যন্ত নিরালা, সেই ভাগের একটি দরজা খোলা হইল—তাহার মধ্য দিয়া বিষন্নভাবে, পলাতকদিগের যাত্রার-ঠাট বাহির হইল। রাণী এবং তাহার ভগিনী বা সহচরী, পুরুষ-বেশ ধারণ করিয়া কতকগুলি বাছ-বাছা অনুচরবর্গ সঙ্গে লইয়া, নীরবে, সিংহদ্বার পার হইয়া, বাহিরের ঘোর অন্ধকারে আসিয়া পড়িলেন—মৃদুস্বরে দুই চারিটি ফুসফুস কথা ভিন্ন, আর কারও মুখে কথাটি নাই—অবশেষে শেষ লোকটি পর্যন্ত পার হইয়া গেল—অমনি দ্বার রুদ্ধ ও অর্গলবদ্ধ হইল। প্রাণ হাতে করিয়া পলায়ন করাই সেই রাত্রির ব্যাপার; কেননা, ১৪ সংখ্যক ড্রেগুন-সৈন্যের ইংরাজ অশ্বারোহী পর্যটক-প্রহরীদল এবং হাইদ্রাবাদের কণ্টিজেণ্ট-ফৌজ, সতর্ক ও সজাগভাবে সর্ব্বত্র পাহারা দিতেছিল.; মধ্যে কাহারও সহিত সাক্ষাৎ হইলেই নিশ্চিত মৃত্যু—তাহাতে সন্দেহ মাত্র নাই। এই সকল লোকের হস্ত হইতে রাণী কি করিয়া এড়াইয়া গেলেন, তাহা এ পর্যন্ত জানিতে পারা যায় নাই। কিন্তু রাণীর সঙ্গে ভাল ভাল পথ-প্রদর্শক ছিল, এ কথা সত্য। রাণী একজন নির্ভীক ঘোড়সওয়ার ছিলেন, তিনি অতি দ্রুত। বেগে, আড়ো-খাড়ো পথের মধ্য দিয়া জঙ্গল-প্রদেশে আসিয়া পড়িলেন। এই জঙ্গল-প্রদেশে প্রবেশ করাই, তাহার প্রাণ-রক্ষার একমাত্র উপায়।”

 কর্ণেল ম্যালেসন বলেন “সর-হিউরোজ, ইতিমধ্যে কেল্লা আক্রমণ করিবার বিবিধ বন্দোবস্ত করিতেছিলেন। কিন্তু রাণী সে বিষয়ে আর তাহাকে বড় কষ্ট পাইতে দিলেন না।”

 সে যাহা হউক, রাণীঠাকুরাণী ঝাঁশি হইতে বাহির হইয়া গেলে, তাহার পশ্চাতে তাঁহার যে সৈন্য আসিতেছিল, তাহাদিগের সহিত ইংরাজ- সৈন্যের সাক্ষাৎ হওয়ায় তুমুল যুদ্ধ বাধিয়া গেল। ঝাঁশি-সৈন্যের মধ্যে “মকরাণী” অশ্বারোহিদল যদিও বিলক্ষণ শৌর্য্য প্রকাশ করিয়াছিল, কিন্তু অবশেষে ইংরাজের গোলাগুলি প্রহারে অতিষ্ঠ হইয়া মোরপ-তাঁবে। প্রভৃতি সর্দার কে কোথায় পলাইতে লাগিল, তাহার ঠিকানা নাই। ইংরাজ সওয়ারেরা তাহাদিগকে অনুধাবন করিয়া প্রায় দুই শত লোক পাড়াও করিয়া আনিল এবং অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে তাহাদিগের প্রাণনাশ করিল।

 রাণীঠাকুরাণীর পিতা ও মুখ্যকর্মচারী—মোরোপন্ত-তাবে, হস্তি- পৃষ্ঠে রত্ন-ভার বোঝাই করিয়া সেই হস্তীর সঙ্গে সঙ্গে, ঘোড়ায় চড়িয়া পলাইতেছিলেন। পথিমধ্যে, রাত্রির অন্ধকারে, নিজের, তলোয়ারের খোঁচা নিজের জঘায় লাগিয়া গেল। তাহাতে ভয়ানক রক্তস্রাব হইয়া তাহার সমস্ত পায়জামা ভিজিয়া যাইতে লাগিল, তথাপি তিনি ঘোড়ার রেকাবের উপর ভর দিয়া ছুটিতে লাগিলেন; প্রভাত সময়ে, “দতিয়া” সহরের নিকট আসিয়া পৌঁছিলেন। দতিয়ার রাজা ইংরাজের মিত্র। মোরপন্ত সমস্ত রাত্রি অশ্বপৃষ্ঠে ধাবমান হওয়ায় অত্যন্ত শ্রান্ত হইয়া পড়িয়া- ছিলেন, তাহাতে আবার জম্যাদেশে বিষম আঘাত লাগিয়া রক্তধারায় পরিচ্ছদাদি আপ্লুত হইয়াছিল—সুতরাং নিরুপায় হইয়া সহরের দরজার নিকট আসিয়া তত্রস্থ একজন খিলি-ওয়ালার নিকট, দীনবচনে আশ্রয় চাহিলেন এবং তাহাকে কিছু টাকা দিতেও স্বীকৃত হইলেন। তাম্বুল- বিক্রেতা তাঁহাকে আশ্রয় দিয়া আপনার ঘরে রাখিল। এই কথা, দতিয়া-রাজ্যের দেওয়ান জানিবামাত্র তৎক্ষণাৎ সৈন্য পাঠাইয়া তাহাকে ধরিয়া আনাইয়। কয়েদ করিলেন; এবং তাহার নিকট যাহা কিছু অর্থ- সম্পত্তি ছিল সমস্ত হস্তগত করিয়া, নিজ সৈন্য-সমভিব্যাহারে তাহাকে ঝাঁশিতে পাঠাইয়া দিলেন। সেখানে পৌছিবামাত্র ঝাঁশির প্রধান কর্মচারী সরু-রবর্ট হামিণ্ট ও স-হিউ-রোজ, রাজবাটীর সম্মুখে, দিবা দুইটার সময়, তাঁহাকে ফাঁশি দিলেন। এইরূপে রাণীর পিতা মোয়রাপন্তের ইহলীলা সাঙ্গ হইল।

“তাদৃশী জায়তে বুদ্ধিবসায়োহপি তাদৃশঃ।
সহায়স্তাদৃশ এব যাদৃশী ভবিতব্য॥”

 রাণী লক্ষ্মীবাই ঋশি হইতে বহির্গত হইয়া, ১০/১৫ জন সওয়ার-সঙ্গে, ভাণ্ডের-নামক এক সহরে আসিয়া পৌছিলেন। ঘোড়া হইতে নামিয়া, সহরকোতোয়ালের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, স্বীয় দত্তক-পুত্র দামোদর রাওর জন্য আহারের যোগাড় করিলেন। এবং আহারাদি সমাপন করিয়া কাল্পী সহর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। এদিকে লেফটেনেণ্ট বোকর কতকগুলি অশ্বারোহী-সৈন্য লইয়া রাণীকে অনুধাবন করিতেছিলেন। পথিমধ্যে তাহার সহিত সাক্ষাৎ হওয়ায়, রাণী ভঁহাকে তলবারের দ্বারা আঘাত করিয়া, ঘোড় সবেগে ছুটাইয়া নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া পড়িলেন। এবং ১৮৫৮ অব্দের ১২ জুন তারিখে কাল্পীতে আসিয়া পৌছিলেন। সেখানে, নানাসাহেবের ভ্রাতা রাও-সাহেব স্বসৈন্তে অবস্থিতি করিতেছিলেন। রাত্রিতে বিশ্রাম করিয়া, পর দিন প্রাতে শ্রীমন্ত রাও- সাহেব পেশোয়ার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। এবং অপূর্ণ নয়নে নিজ তলবার রাও-সাহেবের হস্তে দিয়া এইরূপ বলিলেন “তোমার পূর্বপুরুষেরাই এই তলবার আমাদিগকে দিয়াছেন। তাহাদের পুণ্য-প্রতাপে আজ পর্যন্ত আমি এই তলবারের যোগ্য ব্যবহার করিয়াছি। এক্ষণে তুমি আর সাহায্য করিতেছ না—অতএব, এই তলবার আমি তোমাকে ফেরত দিতেছি”। এই কথা শুনিয়া, রাও-সাহেবের হৃদয় বিগলিত হইল; এবং তাহার সৈন্যের দ্বারা রাণীর যে সাহায্য হয় নাই, তজ্জন্য দুঃখ প্রকাশ করিয়া এইরূপ বলিলেন “আপনি আজ পর্যন্ত, ঝুঁশির সুবেদার-বংশের অনুরূপ যে পরাক্রম প্রকাশ করিয়াছেন এবং প্রবল ইংরাজ-সৈন্যের হস্ত হইতে আপনাকে মুক্ত করিয়া যেরূপ রণ-কৌশল প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহাতে আপনার ন্যায় বীরাঙ্গনা যদি সমস্ত সৈন্যের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তাহা হইলেই আমাদিগের জয়ের সম্ভাবনা। আমাদিগের পূর্বপুরুষদিগের সময়ে, শিদিয়া হোলকার, গায়কবাড়, বুলে, প্রভৃতি সর্দারগণ রাজ্যরক্ষার্থ আপনাদিগের প্রাণ বিসর্জন করিতে তৎপর হইয়াছিলেন বলিয়াই মহারাষ্ট্রীয় রাজ্যের পতাকা আটক পর্যন্ত উডীয় মান হইয়াছিল; এক্ষণে আপনার ন্যায় শৌর্যশালী সর্দারেরা যদি এই সময়ে আমাদিগকে সাহায্য করেন তবেই আমাদিগের সিদ্ধি লাভ হইতে পারে; অতএব, আপনার তলবার ফিরিয়া লউন এবং আমাদিগকে উত্তমরূপে সাহায্য করুন।” রাও-সাহেবের এই সবিনয় মিনতি মান্য করিয়া রাণী তাহার তলবার পুনঃ গ্রহণ করিলেন। রাও-সাহেব পেশোয়া, সমস্ত সৈন্য একত্র করিয়া, তাহাদিগের কওয়াৎ করাইয়া, রাণীঠাকুরাণীকে ও তত্যা-টোপেকে সেনাপতি-পদে বরণ করিলেন।

 এদিকে সর-হিউ-রোজ, সসৈন্যে কাল্পী আক্রমণার্থ যাত্রা করিলেন এবং প্রথমে কুঁচ-সহর আক্রমণ করিয়া তাত্যা-টোপে ও বাদে-ওয়ালা নবাবকে যুদ্ধে পরাভূত করিলেন। এই যুদ্ধে অনেক বারুদ গোলা ও ধান্য তাহাদিগের হস্তগত হইল। যুদ্ধে পরাভূত হইয়া, ত্যাটোপে, রাও-সাহেব প্রভৃতি মণ্ডলী কাল্পীতে প্রত্যাগমন করিলেন। বাদেওয়ালে নবাবের যুক্তি-অনুসারে, রাও-সাহেব সমস্ত সৈন্যের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, রাণীঠাকুরাণীর পরামর্শ অনুসারে কাজ করেন নাই, এই হেতু, রাণী এই যুদ্ধে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন নাই। রাণীর নিজ সৈন্য না থাকায়, তিনিও রাও-সাহেবদিগের সহিত কাল্পীতে ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইলেন। কাল্পীতে আসিয়া, রাণী সৈন্যের সুব্যবস্থা করিবার জন্য রাও-সাহেবকে বিশেষরূপে অনুরোধ করিলেন; তিনি বলিলেন, সুব্যবস্থা না থাকাতেই গত যুদ্ধে ইংরাজেরা জয়লাভ করিয়াছে। তাহার পরামর্শ-অনুসারে এবার রাও-সাহেব সমস্ত বন্দোবস্ত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু রাণীকে সমস্ত সৈন্যের নেতৃত্ব না দিয়া, আপনি সেনাপতি হইলেন। রাও-সাহেবের প্রাধান্য-লালসা ও যশেলিগা অত্যন্ত প্রবল ছিল—তাহার বিপুল সৈন্যের আধিপত্য একজন স্ত্রীলোকের হস্তে অৰ্পণ করিতে তিনি ইষ্ট মনে করিলেন না। তথাপি বাহাকারে বহুমান প্রদর্শন করিয়া রাণীর অধীনে ২০০/২৫০ অশ্বারোহী সৈন্য স্থাপন করিলেন এবং তাহাকে যমুনাভিমুখের দিক সংরক্ষণার্থ মিনতি করিলেন। রাণী তাহাদিগের নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়া, সুব্যবস্থা সহকারে, তাহাদিগকে যথাস্থানে স্থাপন করিলেন। সৰু-হিউ-রোজ, একেবারে কাল্পীতে না গিয়া, প্রথমে গলাসহর আক্রমণ করিবেন স্থির করিলেন। এই সময়ে বিদ্রোহী-সৈন্যের বীরোৎসাহ সপ্তমে চড়িয়া উঠিয়াছিল—তাহারা যমুনার শপথ করিয়া বলিতে লাগিল, হয় ইংরাজদিগকে ধরাশায়ী করিব নয় আমরা যুদ্ধাঙ্গনে প্রাণ দিব। এই বলিয়া তাহারা নিরাপদ স্থান ছাড়িয়া ইংরাজদিগের তোপের আন্দাজের মধ্যে আসিয়া পড়িল। ইংরাজেরা এই সুবিধা পাইয়া প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করিতে লাগিল। কাল্পীর সৈন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করিল বটে কিন্তু অবশেষে পরাভূত হইল! কাল্পীর অগ্রগামী সৈন্যদলের পরাভব হইয়াছে, এই সংবাদ অবগত হইবামাত্র, পেশোয়ার সমস্ত সৈন্য হতাশ হইয়া পড়িল। রাও-সাহেব পেশোয়া, বান্দেওয়ালা-নবাব প্রভৃতি মুখ্য যোদ্ধগণ চিন্তাগ্রস্ত হইয়া পলাইবার পরামর্শ করিতে লাগিলেন। সেই সময়, রাণী তাহাদিগকে সাহস দিয়া আপনার ঘোড়া আনিতে বলিলেন এবং তাহাতে সওয়ার হইয়া কতকগুলি সৈন্য সমভিব্যাহারে, ইংরাজদিগের দক্ষিণ পার্শ্ব সবেগে আক্রমণ করিলেন। তাহার এই ঝড়গতি আকস্মিক আক্রমণে ইংরাজ-সৈন্য একেবারে হটিয়া গেল এবং তিনি এরূপ সতেজে যুদ্ধ করিলেন যে ইংরাজ “লাইট ফিল্ড” তোপের গোলন্দাজেরা কিয়ৎকাল স্তব্ধ হইয়া রহিল এবং তাহাদের তোপ বন্ধ হইয়া গেল! শুধু তাহা নহে, রাণীঠাকুরাণী তোপের ২০ ফুট অন্তর-পর্য্যন্ত অগ্রসর হইলেন। তাঁহার দৃষ্টান্তে সাহস পাইয়া কাল্পীর অন্যান্য ফৌজও আসিয়া পড়িল। দুইপক্ষ একেবারে মুখামুখী হওয়ায় ঘোরতর যুদ্ধ বাধিয়া গেল। ইংরাজ গোলন্দাজেরা হতবীর্য্য হইয়া পলাইতে লাগিল। এই সংবাদ পাইয়া সরু-হিউ-রোজ স্বীয় উঠুারোহী সৈন্য লইয়া তৎক্ষণাৎ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এবং তিনি স্বয়ং সম্মুখবর্তী হইয়া সতেজে কাল্পী-সৈন্যের বিরুদ্ধে ধাবমান হইলেন। কাল্পীর সৈন্য এতক্ষণ ভাং পান করিয়া নেশার ঘোরে উন্মত্তের ন্যায় যুদ্ধ করিতেছিল, কিন্তু উষ্ট্রপৃষ্ঠ হইতে যখন গোল-গুলি অজস্র বর্ষণ হইতে লাগিল, তখন তাহাদিগের চেতনা হইল এবং আর রণস্থলে তিষ্ঠিতে না পারিয়া পলাইতে আরম্ভ করিল। এক্ষণে রাণীঠাকুরাণী হতাশ হইয়া রাও সাহেব পেশোয়ার ছাউনী মধ্যে ফিরিয়া আসিলেন। ইংরাজেরা কাল্পী অধিকার করিল এবং দুই লক্ষ টাকার অধিক মূল্যের যুদ্ধ-সামগ্রী তাহাদিগের হস্তগত হইল।

 এদিকে, রাও-সাহেব পেশোয়া পরাভূত হইয়া, সসৈন্যে গোয়া-লিয়ারের ৪৬ মাইল দূরে, গোপালপুর নামক এক সহরে পলাইয়া গেলেন। রাণীও তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। ক্রমে সেখানে ত্যত্যা-টোপে ও বান্দেওয়ালা নবাবও আসিয়া জুটিলেন। তাঁহাদিগের সকলকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও পেশোয়াকে চিন্তাগ্রস্ত দেখিয়া রাণী তাহাদিগকে এইরূপ বলিলেন “আজ পর্যন্ত মারাঠীরা যে শোর্যবীর্য প্রদর্শন করিয়া আধিপত্য স্থাপন করিয়াছে, দুর্ভেদ্য ও বলাঢ্য কেল্লার আশ্রয়ই তাহার মুখ্য কারণ। শ্রছত্রপতি শিবাজি মহারাজ যে, যবনদিগকে পরাভূত করিয়া হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপন করেন, সেও সিংহগড়, রায়গড়, নো আদি কেল্লার বলে। তিনি প্রথমে আত্মরক্ষণের জন্য ঐ সকল প্রচণ্ড কেল্লা হস্তগত করেন, পরে, শোর্য-পরাক্রম প্রদর্শন করিয়া মহারাষ্ট্রীয় আধিপত্য স্থাপন করেন। অতএব, পূর্ব্ব-অভিজ্ঞতা হইতে জানা যাইতেছে যে, কেল্লার সাহায্য ব্যতীত যুদ্ধ করা ব্যর্থ। আমাদিগের অধীনে, ঝাঁশি, কাল্পী প্রভৃতির ন্যায় অনেকগুলি কেল্লা থাকা প্রযুক্তই আমরা আজ পর্যন্ত ইংরাজদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া টিকিয়া থাকিতে পারিয়াছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই সকল কেল্লা আমাদিগের হস্তচ্যুত হইয়াছে। এক্ষণে আর একটি কেল্লা হস্তগত করা আমাদিগের নিতান্ত আবশ্যক। আমরা যেখানেই পলাইতেছি ইংরাজেরা আমাদিগের অনুসরণ করি- এবং কোন প্রকারে আমাদিগকে বিনষ্ট করিবে, এইরূপ স্থির করিয়াছে। যাহা ভবিতব্য তাহা হইবেই। তাহার প্রতি দৃকপাত না করিয়া, এই উপস্থিত বিপদকালে একটা কোন কেল্লা হস্তগত করিয়া ইংরাজদিগের সহিত যুদ্ধে যাহাতে জয়লাভ হয় তাহার উপায় শীঘ্র অবলম্বন করা আবশ্যক।” রাণীঠাকুরাণীর এই বাক্য শুনিয়া, শ্রীমন্ত পেশোয়া বড়ই তুষ্ট হইলেন এবং তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এখন কোন্কেল্লা হস্তগত করিবার চেষ্টা করা যাইবে রাণীঠাকুরাণী বলিলেন, “উপস্থিত বিপদে ঋশি কিম্বা কাল্পী অধিকার করিবার আশায় শত্রুর সম্মুখ দিয়া যাত্রা করায় ইষ্ট নাই। এই হেতু, গোয়ালিয়ারে যাত্রা করিয়া সিন্ধিয়া-সরকার ও তাহার ফৌজের সাহায্য লওয়া যাউ এবং সেখানকার পাহাড়ী কেল্লার আশ্রয় ধরিয়া আমাদিগের মনোরথ সিদ্ধ করিবার চেষ্টা করা যাউক।” এই কথা রাও-সাহেবের বড়ই মনোনীত হইল এবং তিনি ইহার জন্য রাণীঠাকুরাণীকে অভিনন্দন করিলেন। তাত্যা- টোপেও এই কথায় অনুমোদন করিলেন। তাত্যা টোপে ইতিপূর্ব্বে অনেকবার গোপনে গোয়ালিয়রে গিয়াছিলেন তাই তিনি সিন্ধিয়া-সৈন্যের মনোভাব বিলক্ষণ অবগত ছিলেন। অতএব, এক্ষণে গোয়ালিয়ারে যাত্রা করাই স্থির হইল। রাও-সাহেব ও রাণীঠাকুরাণী সসৈন্যে ১৮৫৪ অব্দের ৩০শে মে তারিখে গোয়ালিয়ারের নিকটস্থ মুৱারের ছাউনীতে আসিয়া পৌছিলেন।

 এই সময়ে শ্রীমন্ত মহারাজ জয়াজীরাও সিন্ধিয়া গোয়ালিয়ারের অধিপতি ছিলেন। এই সময়ে তাহার বয়স প্রায় ২৩ বৎসর ছিল; ইনি প্রায়ই বিলাস সম্ভোগেই নিমগ্ন থাকিতেন; কিন্তু এদিকে, বুদ্ধিমান ও যুদ্ধপ্রিয়ও ছিলেন। তাঁহার সুযোগ্য মন্ত্রী দিনকর-ওই প্রকৃতপক্ষে রাজকার্য্য চালাইতেন। দিনকর রাও প্রথমে একজন সামান্য কেরাণী মাত্র ছিলেন, রেসিডেণ্ট বুশবি সাহেব তাহার স্বাভাবিক বুদ্ধিচাতুর্য্য দেখিয়া তাহার ঐরূপ পদোন্নতি করিয়া দেন। সেই অবধি, তিনি অতীব দক্ষতাসহকারে গোয়ালিয়ার রাজ্যের সংস্কার সাধন করিয়া, সুচারুরূপে রাজকার্য নির্বাহ করিতেছিলেন। এই সময়ে ম্যাসন সাহেব গোয়ালিয়ারের রেসিডেণ্ট ছিলেন, তাহার সহিত মহারাজের বিলক্ষণ সদ্ভাব ছিল। মহারাজ একবার কলিকাতায় গিয়া লর্ড ক্যানিঙের সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং দত্তকগ্রহণে তাহার আধিপত্য বংশানুক্রমে স্থায়ী করিতে পারিবেন এই অনুমতিও লাট সাহেবের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এই হেতু সিন্ধিয়া-সরকার ইংরাজের খুব বাধ্য ছিল, কিন্তু সিন্ধিয়ার সৈন্য ও প্রধান-মণ্ডলীর মধ্যে অনেকেরই বিদ্রোহীদিগের সহিত সহানুভূতি ছিল। এই সময়ে রাও-সাহেব সাহায্য প্রার্থনা করিয়া সিন্ধিয়া-সরকারের নিকট এক পত্র পাঠাইলেন। সিন্ধিয়া মহারাজ সাহায্য করা দুরে থাক্‌, এই পত্র পাইয়া বলিয়া উঠিলেন “বিদ্রোহী দিগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া তাহাদিগের সমুচিত শাস্তি দিতে আমি প্রস্তুত আছি।” কিন্তু সুচতুর দেওয়ান দিনকর-ও আপনার মনোগত ভাব শত্রুপক্ষকে জানিতে না দিয়া, গোয়ালিয়ার সহরের সংরক্ষণের জন্য বিবিধ বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন এবং ইংরাজদিগের ফৌজ আসিয়া পৌছিলে তথন তাহাদিগের সহিত মিলিত হইয়া বিদ্রোহীদিগকে আক্রমণ করিবেন এইরূপ স্থির করিলেন। এবং সমস্ত ঘটনা ম্যাকফর্সন সাহেবকে জানাইয়া তাহার সহিত গোপনে পত্রব্যবহার চালাইতে লাগিলেন। কিন্তু এ দিকে, সিন্ধিয়া মহারাজ চপল বাল-স্বভাব প্রযুক্ত, তাহার নিজ খাস সৈন্যের পরামর্শ শ্রবণ করিয়া বিদ্রোহিগণকে আক্রমণ করিতে প্রস্তুত হইলেন। ১লা জুন তারিখে প্রাতঃকালে সিন্ধিয়া মহারাজ যোদ্ধ বেশ ধারণ করিয়া অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া সৈন্য সমভিব্যাহারে, মুরারছাউনীর দুই মাইল দুরে বাহাদুরপুরে আসিয়া উপস্থিত এবং সেখান হইতে বিদ্রোহীদিগের ছাউনীর অভিমুখে গোলাবর্ষণ করিতে লাগিলেন। দুই একটা গোলা ছাউনীর পার্শ্বে আসিয়া পড়ায়, পেশোয়ার সেনা- নায়কগণ শিঙ্গা বাজাইয়া সমস্ত সৈন্যকে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হইতে ইসারা করিল। কিন্তু পেশোয়ার নিকট যে দুই একজন মুস্ফুদ্দি-লোক ছিল তাহারা বলিল পেশোয়া সরকারের সহিত প্রেম-সম্বন্ধ সিন্ধিয়া-সরকারের মধ্যে এখনও জাগ্রত আছে—সিন্ধিয়া-সরকার কখনই আপনার সহিত যুদ্ধ করিবেন না। ঐ যে তোপের আওয়াজ শোনা যাইতেছে, বোধ হয় উহা আপনার স্বাগতা সিন্ধিয়া সেলামী দিতেছেন।” রাও-সাহেব পেশোয়া ও তাত্যাটোপের, সিন্ধিয়ার সাহায্যের উপর পূর্ণ ভরসা থাকায়, তাহারা এই কথায় বিশ্বাস করিয়া যুদ্ধের হুকুম দিলেন না। এদিকে, শত্রুপক্ষ হইতে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ হইতে লাগিল, পেশোয়ার সৈন্য অতিষ্ঠ হইয়া পলাইতে আরম্ভ করিল; পেশোয়া একেবারে বিহ্বল হইয়া পড়িলেন।

 রাণীঠাকুরাণী এইরূপ অবস্থা অবলোকন করিয়া, মহা-আবেশ-সহকারে আপনার দুই তিন শত ঘোড়শোয়ার সঙ্গে লইয়া, একেবারে সম্মুখে অগ্রসর হইলেন এবং সিন্ধিয়ার তোপখানার উপর সবেগে ধাবমান হইলেন। তোপখানা আক্রমণ করিবামাত্র, গোলন্দাজের তোপ ফেলিয়া পলায়ন কেবল, মহারাজ জরাজীরাও-সিন্ধিয়া শৌর্যানলে প্রজ্বলিত হইয়া, আপনার খাস-সৈন্য সঙ্গে লইয়া প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু রাণীর সহিত যুদ্ধে পরাভূত হইয়া, দিনকর-রাও ও দুই এক জন সর্দার সমভিব্যাহারে মহারাজ সিন্ধিয়া আগ্রা অভিমুখে পলায়ন করিলেন।

 এদিকে, শ্রীমন্ত রাও-সাহেব পেশোয়া, মঙ্গলবাদ্য-সহকারে মহা সমারোহে গোয়ালিয়ার-প্রাসাদে আ গমন করিলেন। মহারাণী লক্ষ্মী- বাই ঠাকুরাণী, সৈন্য-ছাউনীর নিকট ‘নবলখ’ নামক এক বাগানবাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাত্যা-টোপে গোয়ালিয়ার-কেল্লায় কতক- করিল। গুলি সৈন্য পাঠাইয়া দিলেন—তাহারা পৌছিবামাত্র কেল্লার সর্দার কেল্লার দ্বার উদঘাটন করিয়া দিল। তাত্যাটোপের সৈন্যগণ, সমস্ত যুদ্ধ- সামগ্রীর সহিত কেল্লা অধিকার করিল। কেল্লা দখল করিয়া বিদ্রোহীরা দেওয়ান দিনকর-রাও এবং অন্যান্য মান্যগণ্য লোকদিগের গৃহ ভূমিসাৎ করিল এবং সহরে লুঠপাঠ আরম্ভ করিয়া দিল। কিন্তু রাও-সাহেব, নগরবাসীদিগের প্রতি কোন প্রকার অত্যাচার না হয় এইরূপ ঘোষণা করিয়া দিয়া লুঠপাঠ শীঘ্রই বন্ধ করিয়া দিলেন।

 ৩রা জুন তারিখে দরবার আহ্বান করিয়া রাজ্যাভিষেক-ক্রিয়া সমাপন করিয়া, রাও-সাহেব, পেশোয়া রাজসিংহাসনে আরোহণ করিলেন। গোয়ালিয়ারে, “গঙ্গা-দশহরা' উপলক্ষে ব্রাহ্মণ-ভোজনের প্রথা থাকায়, তিনি প্রতিদিন সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণকে আকণ্ঠ ভোজন করাইয়া সুবর্ণ দক্ষিণা দিয়া বিদায় করিতে লাগিলেন। এইরূপ চারিদিন ধরিয়া বিজয়গাৎসব চলিতে লাগিল। এদিকে সহিউ-রোজ বিদ্রোহিদলদিগকে পরাভব করিতে করিতে ক্রমশঃ গোয়ালিয়ারের নিকটবর্তী মুরারের ছাউনীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পূর্ব্বে রাও-সাহেব এ সংবাদ জানিতে পারেন নাই। তিনি ব্রাহ্মণ ভোজন করাইতেই ব্যস্ত ছিলেন। এই সংবাদ যখন শুনিলেন, তখন তিনি তাত্যাটোপেকে সৈন্যের ব্যবস্থা করিতে হুকুম দিলেন কিন্তু স্বয়ং ব্রাহ্মণভোজন লইয়াই ব্যাপৃত রহিলেন।

 তাত্যা-টোপে মুরারের ছাউনী রক্ষণার্থ সসৈন্যে অগ্রসর হইলেন, উভয় পক্ষে দুই ঘণ্টা ধরিয়া যুদ্ধ হইল, অবশেষে ইংরাজেরা মুরার দখল করিল। এই সংবাদ পাইবামাত্র রাও-সাহেব এস্তব্যস্ত হইয়া সৈন্যশিবিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং যুদ্ধের আয়োজন করিতে লাগিলেন। রাণীঠাকুরাণীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া অতি নম্রতাপূর্ব্বক তাহার সাহায্য প্রার্থনা করিলেন এবং এই আসন্ন বিপৎকালে কি কর্তব্য তাহার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন।  রাণীঠাকুরাণী ইতিপূর্ব্বে সৈন্যের সুব্যবস্থা করিবার জন্য রাও-সাহেবকে বারম্বার অনুরোধ করিয়াছিলেন। কিন্তু তখন তিনি বিজয়গাৎসবে মত্ত হইয়া সে দিকে বড় মনোেযোগ দেন নাই। এতক্ষণে তাঁহার চেতনা হইল। কিন্তু সুযোগ একবার ছাড়িয়া দিলে আর তাহা ফিরিয়া পাওয়া যায় না।

“ন কার্যকালং মতিমান্নতিক্রমে কথংচন।
কথংচিদেব ভবতি কার্যযােগঃ শুদুলভঃ।”

 রাণীঠাকুরাণী তাত্যা-টোপেকে এইরূপ বলিলেন —“আজ পর্যন্ত আমরা যে এত প্রাণপণ পরিশ্রম করিলাম, তাহা সফল হইবার আর আশা রহিল না! শ্রীমন্ত পেশোয়ার দুরাগ্রহী স্বভাব প্রযুক্ত ও তাহার বিজয়োন্মত্ততা বশতঃ আমাদের সমস্ত যুক্তি পরামর্শই বৃথা হইল! ইংরাজসৈন্য আমাদিগের মুখামুখী হইয়াছে, তথাপি এখনও আমাদের সৈন্যমধ্যে কিছুমাত্র ব্যবস্থা নাই। অতএব, এখন আমরা ইংরাজের সম্মুখীন হইয়া কতদুর কৃতকার্য হইব, তাহা তো স্পষ্টই দেখা যাইতেছে। তথাপি, উপস্থিত বিপদের সময়ে সাহস ত্যাগ করিলে কোন ফল হয় না। তুমি এক্ষণে ফৌজের পরিদর্শনে এখনি বহির্গত হও এবং যাহাতে বিরুদ্ধ পক্ষ আমাদিগের প্রতি আক্রমণ করিতে না পারে, তাহার বন্দোবস্ত করো। আমি নিজ কর্তব্যের জন্য প্রস্তুত আছি! এখন তোমার কর্তব্য তুমি কর।” তাত্যা-টোপে, এই, কথা শুনিবামাত্র বীর্যোৎসাহে উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন এবং রাণীঠাকুরাণীর প্রতি গোয়ালিয়ারের পূর্বদিক্‌ রক্ষণের ভার দিয়া নিজে অন্য সৈন্যবিভাগের ব্যবস্থা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

 এক্ষণে রাণীঠাকুরাণী যোদ্ধৃ-বেশ পরিধান করিয়া ও অশ্বারূঢ় হইয়া আপনার সৈন্যের মধ্যে কাওয়াৎ করাইতে লাগিলেন।

 ১৭ই তারিখে ব্রিগেডিয়র স্মিথ যুদ্ধের ব্যুগল বাজাইয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিয়া দিলেন। ইংরাজ-সৈন্য সম্মুখে অগ্রসর হইবামাত্র, রাণীর গোলন্দাজেরা তোপ হইতে গোলাবর্ষণ করিতে লাগিল। ইংরাজেরা। হটিতে লাগিল। ইহা দেখিয়া রাণীর অশ্বারোহী সৈন্যগণ তাহাদিগের উপর ধাবমান হইল। রাণীঠাকুরাণীও মহা আবেশের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন—রণাঙ্গনমধ্যে বিদ্যুল্লতার ন্যায় ইতস্ততঃ ধাবমান হইয়া শত্রু- সংহার করিতে লাগিলেন। এইরূপ তিন দিন ধরিয়া যুদ্ধ চলিল। অব- শেষে ইংরাজেরা শত্রুপক্ষের দুই তিনটা তোপ বলপূর্ব্বক অধিকার করায় পেশোয়ার সৈন্যগণ হতাশ হইয়া পড়িল—এদিকে আর একদল ইংরাজ সৈন্য রাণীর সৈন্যকে আক্রমণ করায়, রাণীর সৈন্য পরাভূত হইয়া পলায়ন এক্ষণে, রাণী, দুই তিনজন দাসী ও দুই এক জন বিশ্বাসী। সর্দার সমভিব্যাহারে শত্রুর হস্ত হইতে কোন প্রকারে এড়াইয়া, সবেগে। ঘোড়া ছুটাইয়া শক্রব্যুহ ভেদ করিয়া বাহির হইবার চেষ্টা করিলেন। ইংরাজ সওয়ারেরা তাহাকে আক্রমণ করিল—তিনি সবেগে ঘোড়া ছুটাইয়া বাহির হইয়া পড়িলেন—ইংরাজ সওয়ারেরা তাহার অনুসরণ করিতে লাগিল। ইতিমধ্যে তাহার দাসী মুদ্রা হঠাৎ চীৎকার করিয়া উঠিল। ‘রাণীঠাকরুণ! মলুম মলুম! এই শব্দ রাণীর কর্ণগোচর হইবামাত্র রাণী ফিরিয়া আসিয়া মুদ্রার হত্যাকারী ইংরাজ-যোদ্ধাকে অসির আঘাতে যমপুরীতে পাঠাইয়া আবার সবেগে ঘোড়া ছুটাইয়া চলিলেন। সম্মুখে একটা ক্ষুদ্র জল-প্রবাহ দেখিয়া ঘোড়া থমকিয়া দাড়াইল। রাণীর প্রিয় ঘোড় যুদ্ধে আহত হওয়ায় তিনি সিন্ধিয়ার অশ্বশাল হইতে এই ঘোড়াটি বাছিয়া লইয়াছিলেন। তিনি ঘোড়াকে খালের উপর দিয়া লইয়া যাইবার বিধিমতে চেষ্টা করিলেন—কিন্তু ঘোড়া আর কিছুতেই অগ্রসর হইল॥ ইতিমধ্যে যে ইংরাজ সওয়ার হার অনুসরণ করিতেছিল, সে সেইখানে আসিয়া পৌছিল। তাহার উপর আক্রমণ করিতে আসিতেছে দেখিয়া তিনি তলবার উত্তোলন করিয়া আত্মরক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন—ঐরূপ কিছু কাল অসিযুদ্ধ চলিতে লাগিল—অবশেষে ইংরাজ সওয়ার রাণীর মস্তকের উপর তলবারের এক দারুণ কোপ বসাইয়া দিল। তাহাতে মস্তকের দক্ষিণ ভাগ একেবারে ছিন্ন হইয়া গেল এবং একটা চক্ষুও বাহির হইয়া পড়িল। ইহার উপরেও দুই এক ছোরার ঘা বসাইয়াছিল। এই সময়ে রাণীও তলবারের এক আঘাতে সেই ইংরাজ- অশ্বারোহীকে যমসদনে পাঠাইলেন। এক্ষণে, তাহার প্রভুভক্ত সেবক রামচন্দ্র রাও তাঁহাকে এইরূপ আহত দেখিয়া অশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিল এবং সেখান হইতে তাঁহাকে উঠাইয়া লইয়া নিকটস্থ একটা পর্ণকুটীরে লইয়া গেল। পর্ণকুটারটির অধিকারী গঙ্গদাস বাবাজী। রাণী অত্যন্ত তৃষিত হওয়ায়, বাবাজী তাহাকে গঙ্গাজল পান করিতে দিলেন। রাণীঠাকুরাণী রক্তাপ্লুত দেহে, আঘাতের এই অসহ যন্ত্রণার মধ্যে, তাহার প্রিয় পুত্র দামোদর রাওর প্রতি বাৎসল্য ভাবে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া, ইহলীলা সম্বরণ করিলেন।

সমাপ্ত