বিষয়বস্তুতে চলুন

ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/উদয়পুরের সুরম্য বনভূমি

উইকিসংকলন থেকে

উদয়পুরের সুরম্য বনভূমি।

 যাত্রাপথের ধারে, একটি রমণীয় বনে, গিরিপাদমূলে দর্পণবৎ প্রশান্ত সরোবরের সম্মুখস্থ একটি কুটীরে, তিনজন সন্ন্যাসীর বাস। ইহারা যুবা পুরুষ, সুঠাম-সুশ্রী, নগ্নকায়, দীর্ঘকুন্তল-পাথরের ন্যায় পাংশুবর্ণ একপ্রকার চূর্ণে উহাদের আপাদমস্তক আচ্ছন্ন।

 প্রতিদিন সকল সময়েই—যখনই ঐদিক্‌ দিয়া যাইবে—তখনি দেখিতে পাইবে,—ঐ তিনজন সন্ন্যাসী, ঐ অনাবৃত কুটীরে, বৌদ্ধধরণে আসনবদ্ধ হইয়া, স্থিরভাবে সরোবরের সম্মুখে বসিয়া আছে। সরোবরের জলে পর্ব্বতের ছায়া,ঘনঘোর অরণ্যের ছায়া,—উদয়পুর-রাজপ্রাসাদের ছায়া বিপরীতভাবে প্রতিবিম্বিত।

 শুনগরের পশ্চাদ্ভাগে,গবাক্ষবিশিষ্ট সিংহদ্বার পার হইবামাত্র, সহসা এই নিস্তব্ধ বনভূমির আরম্ভ হইয়াছে দেখিতে পাওয়া যায়;— চতুর্দিকৃস্থ শৈলচূড়ার উপর দিয়া চলিয়া অবশেষে সুদূর অরণ্যে, ব্যঘ্রসঙ্কুল জঙ্গলে উহা মিশিয়া গিয়াছে।

 মধ্যবনের গাছগুলা, লঘুশাখাবিশিষ্ট গুল্মতরুগুলা, কতকটা আমাদের দেশের মত। আমাদের শরতের শেষভাগে যেরূপ ফুল-ফুটিয়া থাকে, সেইরূপ খুব দুল ফুটিয়াছে; যদিও এখানে এখন বসন্তকাল, গ্রীষ্মপ্রধান দেশের বসন্তকাল; -তবু বাতাস আগুনের মত। কিন্তু ভারতের অন্যান্য অংশের ন্যায় এখানকার সুন্দর বনভূমিটিও নিশ্চল-নিস্পন্দ এবং এই বসন্তকালেও সমস্তই যেন মৃতকল্প। তিনবৎসর ধরিয়া এইরূপ চলিতেছে।

 নগরদ্বারের এত নিকটে থাকিয়াও এই ছায়াময় স্থানটি যে এমন নিস্তব্ধ ও শান্ত রহিয়াছে, ইহাই আশ্চর্য্য। নগরের অপরপার্শ্বে ই সমস্ত গতিবিধি ও লোকের চলাচল; ধ্যানমগ্ন তিনজন সন্ন্যাসীর সম্মুখ দিয়া এ রাস্তায় কেহ প্রায় যাতায়াত করে না।

 এই বনে কৃষ্ণসার আছে, বানর আছে, ঘুঘু ও টিয়াজাতীয় হরেকরকম পাখী মাছে। বড় বড় জঁকাল ময়ূর দলে-দলে বিচরণ করিতেছে। মরাগাছে মধ্যবর্তী স্থানে, শাদাটে ঝোপঝাড়ের তলায়, ভস্মাভ মৃত্তিকার উপর, এই ময়ূরগুলা সারীবন্দি হইয়া দৌড়িতেছে দেখা যায়;—পুচ্ছের কি চমৎকার উজ্জ্বল প্রভা! হরিদ্বর্ণ ধাতুখণ্ড সমূহের যেন একএকটা সমষ্টি। এই সব পশুপক্ষী ছাড়া রহিয়াছে—কিন্তু ইহাদিগকে ঠিক “বুনো” বলা যায় না; কেন না, এদেশে মানুষেরা ইহাদিগকে হত্যা করে না, তাই আমাদের দেশের মত, ইহারা মানুষ দেখিয়া পালায় না। পর্ব্বতের অপরপার্শ্বে ব্যাঘ্রদি আছে বটে, কিন্তু এই সুরম্য বনে উহাদিগকে বিচরণ করিতে কস্মিনকালেও কেহ দেখে নাই॥

 সরোবর প্রদক্ষিণ করিয়া যখন এখানে পৌঁছিলাম, ঠিক রাস্তার ধারে নিষ্পন্দনিশ্চল, প্রস্তরবর্ণ এই তিনজন অদ্ভুত সন্ন্যাসীর প্রথম দর্শনেই, আমার অন্তরে একপ্রকার অস্পষ্ট অতি প্রাকৃতিক ভয়ের সঞ্চার হইল। পাষাণপ্রতিমার সহিত প্রভেদ এই যে, ইহাদের লম্বা চুল, গোঁপ, ভুরু সমস্তই কালো; উহাদের নেত্রের অচল স্থিরদৃষ্টি দেখিয়াই যেন একটু ভয় হয়, তা ছাড়া, আর কিছুই জানা জায় না।

 বয়ঃক্রম ২০ বৎসর; ইহারা সন্ন্যাসধর্ম্ম্মে নবব্রতী। তপশচার্য্য ও ব্রতউপবাস সত্ত্বেও উহাদের সুন্দর দেহগঠনে কোনপ্রকার পরিবর্তন উপস্থিত হয় নাই। আসনপীড়ি হইয়া বহুকাল একভাবে বসিয়া থাকিলে, পা শুকাইয়া শীর্ণ হইবার কথা, কিন্তু এখনও তাহা হয় নাই—পা এখনও বেশ স্থূল ও একটু মেয়েলী-ধরণের। চূর্ণলিপ্ত ললাটের উপর শৈবচিহ্ন লালরঙে অঙ্কিত; হঠাৎ রাস্তার সং বলিয়া মনে হইতে পারি, কিন্তু উহাদের চোখের দৃষ্টি এনি স্নিগ্ধগম্ভীর যে, সে ভাব একটুও মনে আইসে না।

 উঁহাদের পশ্চাতে, কুটীরের মধ্যে, কতকগুলি তাম্রসামগ্রী,বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন—সুশৃঙ্খলরূপে সজ্জিত রহিয়াছে। উহাদের প্রাত্যহিক প্রাতঃস্নানে ও মিতাঁহারে এই সমস্ত সামগ্রী ব্যবহৃত হয়। উহাদের মাথার উপর গাছের মরা-ডালপালা প্রসারিত এবং ইহা পাখীদের একটা জটল্লার স্থান। চারিদিক্‌কার শুষ্কতায় অতিষ্ঠ হইয়া,—টিয়া, ঘুঘু, বড়-বড় ময়ুর, ছোট-ঘোট গায়কবিহঙ্গ এইখানে আসিয়া জড় হইয়াছে এবং এই সন্ন্যাসীরা আহারের পর যে অন্ন উহাদের জন্য রাখিয়া দেয় তাহাই উহারা খুঁটিয়া-খুঁটিয়া খায়।

 যদি কোন পথিক সন্ন্যাসিত্রয়ের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়ায় এবং উহাদের সহিত কথা কহে—সন্ন্যাসীরা কখন-কথন ইঙ্গিতের দ্বারা ও একপ্রকার অমনস্ক স্মিতহাস্যসহকারে কুটীরচ্ছায়াতলে বসিবার জন্য তাহাকে আহ্বান করে। কিন্তু সেই ভূমিখণ্ডটি এরূপ সযত্নে সম্মার্জ্জিত,পাছে আবার অপরিষ্কার হয়, এইজন্য উহারা পথিককে দূরে জুতা রাখিয়া আসিতে অনুরোধ করে। পরক্ষণেই আবার তাঁহাদের স্তিমিতনেত্র ধ্যানে নিমগ্ন হয়; তাঁহার পর, যখন ইচ্ছা তুমি চলিয়া যাও,আর উহারা তোমার সহিত কথা কহিবে না—তোমার দিকে একবার চাহিয়াও দেখিবে না।

 এই বনমধ্যস্থ সরোবরটি উদয়পুরহারাজের। কেবল তাঁহার প্রাসাদগুলি এবং চিরশুভ্র কতকগুলি পুরাতন মন্দির এই সরোবরে প্রতিবিম্বিত হইয়া থাকে। সরোবরের মধ্যস্থলে-দুইটি ছোটো-ছোটো দ্বীপ এবং সেই দ্বীপের উপর আরও কতকগুলি প্রাসাদ ও প্রাচীরবেষ্টিত উদ্যান রহিয়াছে। তীরভূমির সর্ব্বত্রই ঝোপঝাড় ও গাছে-গাছে জড়াজড়ি। চারিধারে উচ্চ খাড়া পাহাড়-মরা-বনের গালিচা যেন তাহাতে বিছানো রহিয়াছে; ইতস্তত, কোন কোন সূক্ষ্মাগ্র চূড়ার উপর গুবাকালের কোন-একটি ধবলপ্রভ দুর্গপ্রাসাদ, কোন-একটি ক্ষুদ্র দেবমন্দির ইগল্‌পক্ষীর ন্যায় খুব উচ্চে বিরাজমান। গাছের যে-সব ডালপালা একেবারে জলের ধারে মুইয়া পড়িয়াছে, সেই সব ডালপালা এখনো সবুজ; তা ছাড়া, যে দিকে দৃষ্টিপাত কর, সর্ব্বত্রই অকালশরতের “ছ্যাত্‌লা” অথবা শীতের একঘেয়ে ছাই-রং।

 আজ সর্ব্বপ্রথমে সন্ন্যাসিত্রয়ের একটু বাস্তবিক নড়াচড়া দেখিলাম। আজ সূর্যাস্তের সময় এই সুরম্য বনে প্রবেশ করিয়াছিলাম। এই সময়ে, মহারাজার একটা পোড়ো বাড়ীর উপর দিয়া ঘন ধূমপাশি নিয়ত সমুখিত হয়। (ইহা শুধু চতুর্দিক্‌স্থ হরিণদিগের পাদোথ্থিত ধূলারাশির আবর্ত; জঙ্গল শুকাইয়া যাইবার পর হইতে, মহারাজা স্বকীয় প্রাসাদের গবাক্ষ হইতে নীচে ভুট্টা নিক্ষেপ করেন; ইহাই খাইবার জন্য হরিণেরা এখানে প্রতিদিন সায়াহে সবেগে দৌড়িয়া আইসে•••)।

 দেখিলাম, একজন সন্ন্যাসী তাঁহার পশ্চাতে অবস্থিত দর্পণ, চূর্ণ ও লাল-রং আনিবার জন্য আসন হইতে উঠিয়াছে; তাঁহার পর, আবার সেই ধ্যানাসনে উপবিষ্ট হইয়া, শাদা চূর্ণে মুখমণ্ডল ধবলীকৃত করিয়া ললাঙের উপর শৈব চিহ্ন সঙ্গে অঙ্কিত করিতেছে। সায়া-ভোজের জন্য ময়ূর ও ঘুঘু চারিদিক্‌ হইতে আসিয়া জড় হইয়াছে। ইহারা ছাড়া সেখানে আর কেহই নাই। সন্ধ্যাগমে, তবে কাহা জন্য এত সাজসজ্জা!•••

 সে যাহাই হোক, তরুশাখার মধ্য দিয়া একদল অশ্ব খুব ছুটিয়া আসিতেছে, তাঁহারই পদ শুনা যাইতেছে। দরবারের ত্রিশজন সর্দার সমভিব্যাহারে রাজা চলিয়াছেন। অশ্বগুলা বিচিত্রবর্ণ সাজে সজ্জিত। ছিপছিপে-গঠন অশ্বারোহীরা সুদীর্ঘ শুভ্রপরিচ্ছদ পরিধান করিয়াছে। উদয়পুরী-ধরণে গুম্ফরাজি আড়াইয়া উপরদিকে ভোলা; ইহাদের দেহগঠন সুন্দর ও পুরুষোচিত, ফিঁক তাম্রবর্ণ, এবং এই উত্তোলিত ওক্ষের দরুণ মুখে কেমন একটু মার্জারভাব প্রকটিত।

 মহারাজাও অনুচরবর্গের সহিত ছুটিয়া চলিয়াছেন; তাঁহারও মার্জারবৎ শ্মশ্ররাজি; তাঁহারও মুখমণ্ডল, ও সাজসজ্জা অতীব সুন্দর এবং যার-পর-নাই বিশিষ্টধরণের।

 পত্রশূণ্ঠ একটা তরুবীথির মধ্য দিয়া তাঁহারা চলিয়া গেলেন। তাঁহাদের দেখিয়া, আমাদের মধ্যযুগের পাশ্চাত্য অশ্বারোহীদিগকে মনে পড়িল। মনে হইল, যেন সেই অতীতযুগে কোন য়ুরোপীয় “প্রিন্‌স্‌", কিংবা “ডিউক” অশ্বারোহী অনুচরবর্গ ও “ব্যারন্‌গণ সমভিব্যাহারে, সুন্দর শরৎসায়াহ্লো, মৃগয়া হইতে প্রত্যাবর্তন করিতেছেন।•••