ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/রথযাত্রা

উইকিসংকলন থেকে

রথযাত্রা।

 কা! কা!—একটা কাক উষাকে অভিবাদন করিয়া, এবং আমার চতুর্দিকে নিদ্রিত গলিত-দ্রব্যভোজী শত-সহস্র কাককে প্রথম সঙ্কেত জ্ঞাপন করিয়া, আমাকে জাগাইয়া দিল। এই গভীর খিলান-মণ্ডলের প্রতিধ্বনিকারী প্রস্তয়ারণ্য,ঐ অশুভ বায়স-সঙ্গীতকে আরও যেন বাড়াইয়া দুলিল। এই বয়সেরা মন্দিরেরই কুলঙ্গিতে বাস করে। কেন না ইহারাও একটু পবিত্র বলিয়া পরিগণিত। এই প্রতিধ্বনির বিরাম নাই—চতুর্দিকেই ইহার পুনরাবৃত্তি হইতেছে। মন্দিরের প্রস্তরময় বীথিগুলির শেষ প্রান্ত পর্য্যন্ত এবং উচ্চ নিম্ন সমস্ত দালানে, আমার চতুর্দিকে, পাকচক্রাকারে ঐ শব্দ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, অথচ কাকগুলা আমার নিকট অদৃশ্য। সমস্ত মন্দির এই কা-কা-রবে অণুরণিত। মন্দিরের পবিত্র ছায়াতলে যে সকল দেবতা বাস করেন—এই প্রভাতিক অভ্যর্থনা-গীতি তাঁহাদের চিরপ্রাপ্য।

 শেষ দীপটি পর্য্যন্ত নিভিয়া গিয়াছে। চন্দ্রমা আর কিরণ বর্ষণ করিতেছেন না। গতকল্য অপেক্ষা আজিকার রাত্রি এই মন্দিরে যেন আরও ঘনীভূত। শীঘ্রই প্রভাত হইবে—ইহা বুঝিবার জন্য বিহঙ্গ-সুলভ তীক্ষ্ণদৃষ্টির প্রয়োজন। মন্দিরের সাগুলি গোরস্থানের ন্যায় অর্দি, সেই জন্য শৈত্য-বিভ্রম উপস্থিত হইতেছে। কিছুই দেখা যায় না। কদাচিৎ দুই একটি অপরিস্ফুট আলোকচ্ছটা,—(যে অন্ধকারে চতুর্দিক আচ্ছন্ন, তাহা অপেক্ষা কিছু কম অন্ধকার, এইমাত্র দুই এইটি ক্ষীণ রশ্মি, খিলানমণ্ডলের বায়ুরন্ধ, দিয়াছিদ্র দিয়া প্রবেশ করিতেছে। পরে বিভিন্ন দিক হইতে, এই কা-কা-রবে সহিত পালোকের ‘ফফর’ শব্দ, ডানার ‘ঝটাপট’ শব্দ সংযোজিত হইল। এইবার কৃষ্ণবর্ণের পিণ্ডগুলা উড়িয়া যাইবে।••••••

 এইবার আলোক আসিয়াছে!•••••••••এ দেশে আলোক যেমন শীঘ্র চলিয়া যায়, তেমনই আবার শক্সি আইসে,•••••••••এত শশ্ন যে নাট্যবিভ্রম বলিয়া মনে হয়। সুদূরপ্রসারিত শুম্ভশ্রেণী পাণ্ডুর স্বচ্ছতায় অনুরঞ্জিত হইল;—উহা এত স্বচ্ছ যে মনে হয়, বুঝি দূরস্ত বস্তুর ছায়াপাত হইয়াছে। ধূসর পাতলা রেশমী কাপড়ের অবগুণ্ঠনের মধ্য দিয়া, স্পর্শাতীত বিবিধ শোভন ছবির ছায়াবাজি যেন দৃষ্ট হইতেছে! মন্দির-দালানের বিন্নি প্রকাণ্ড বিভাগগুলি নেত্রসমক্ষে প্রকাশিত হইল; দালানের চতুস্পথগুলি শেষ প্রান্তে মিলাইয়া গেল। আমার পশ্চাদ্ভাগে, যেখানে গতকল্য সায়াস্ত্রে এক জন পুৰোহিতের নিকট রথযাত্রা সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিয়াছিলাম, সেই রোষদীপ্ত-বিকাটাকার-জন্তু-চিত্রময় বীথিটিতে সেই জন্তুদের ছায়া-ছবি আবার দৃষ্টিপথে পতিত হইল। যে সকল নরমূর্তি ভূতলে শুইয়া ছিল, সেই সকল মম-বস্ত্র-পরিহিত মূর্তিগুলা খাড়া হইয়া উঠিল;—বাহুদ্বয় প্রসারিত করিয়া, পশ্চাতে শরীর হেলাইয়া, যাতায়াত করিতে লাগিল। এই অবাস্তব, বর্ণহীন, ঐন্দ্রজালিক দৃশ্যের মধ্যে, এই শুভ্রবসন স্বচ্ছ মূর্তিগুলিব পদসঞ্চারশব্দ শুনিয়া আশ্চর্য হইতে হয়।

 গতকল্য যে সানের উপর আমি নিদ্রা গিয়াছিলাম, তাহার নিকটে একটা পাথরের সিঁড়ি মন্দিরের ছাদ পর্য্যন্ত উঠিয়াছে। একটু হাতড়াইয়া ঠাণ্ডা দেওয়ালের উপর হাত বুলাইয়া সেই সিঁড়িটা খুঁজিয়া বাহির করিলাম।

 ছাদের উপরে উঠিলাম। আমি এখন একাকী। গুরুভার, সমতল, খিলান-মণ্ডলের উপর এই ছাদ মরুভূমির ন্যায় ধূধূ করিতেছে। ইহা বড় বড় পাথরের চাক্কা দিয়া বাধানো। উহার দুই ধার প্রসারিত হইয়া দূরবর্তী আকাশের জলদচূড়ায় পর্যবসিত হইয়াছে। নিম্নতলের ন্যায় এখানেও ছায়াবাজির দৃশ্য;—আর একটি পাণ্ডুবর্ণের চিত্রাবলী। এখানে একটু ফর্সা হইয়াছে, কিন্তু এখনও দিন হয় নাই। মন্দিরের অভ্যন্তরে যেরূপ সমস্তই অবাস্তব বলিয়া মনে হইতেছিল, এখানেও সেইরূপ মনে হইতেছে। এই বিস্তীর্ণ ময়দানের চতুর্দিকে যে জলদ-চূড়াগুলি দেখা যাইতেছে, উহা বাষ্পরাশি বই আর কিছুই নহে;—রাত্রিকালে বাষ্পরাশি ঘনীভূত হইয়াছে মাত্র। এই বাষ্পরাশি ঈষৎ নীল রঙ্গের তূলা-ভরা গদীর ন্যায় এরূপ স্থূল যে মনে হয়, আর একটু নিকটে গেলেই উহাকে হস্তের দ্বারা স্পর্শ করা যাইতে পারে। সমস্ত ভূমি ঐ তুলারাশির মধ্যে এরূপ মগ্ন হইয়া আছে যে, কালো কালো কতকগুলা তালপক্ষপুঞ্জ অথবা তালপত্রগুচ্ছ উহার মধ্য হইতে শুধু মাথা বাহির করিয়া আছে। ঐগুলি উচ্চতম তালবৃক্ষের চূড়াদেশ।

 সমুদ্রাভ মণি’র ন্যায় রং—দিব্য শোভন-স্বচ্ছ—এক প্রকার হরিৎ আলোকে উদয়গিরির দিঙমণ্ডল পরিব্যাপ্ত হইল; যেন তৈলের একটি ফোঁটা নৈশ গগন-তটে মালাকারে ক্রমশঃ বিস্তৃত হইল। ওদিকে অস্তাচলদিগন্তে একটি স্কুল লোহিত গোলক অবসাদে ম্রিয়মাণ—একটি পুরাতন গ্রহ শ্রান্তক্লান্ত—একটি প্রাচীন জীবলোক পৃথিবীর অতিসান্নিধ্যবশতঃ ভয়ে আকুল;—ইনি অস্তমান চন্দ্রমা। এক্ষণে মন্দিরের সমস্ত কাকগুলা জাগ্রত হইয়া কা-কা রব করিতেছে। নিম্নদেশ হইতে, আকাশের সৰ্বদিক হইতে, যেখান দিয়াই উহারা চলিয়া যাইতেছে—ঐ কা-কা-ধ্বনি সমুখিত হইতেছে। •••••••

 প্রভাত হইয়াছে, সূর্যোদয়ের আর বড় বিলম্ব নাই। রথের চারিটা প্রকাণ্ড চাকা। টানিবার রসিগুলা ভূতলে বিছাইয়া রাখা হইয়াছে।

 এইবার, পুরোহিত ব্রাহ্মণের যে মন্দিরাকৃতি ক্ষুদ্র গৃহে পূজা-অর্চনা করিয়া রাত্রিযান করিয়াছিল, সেখান হইতে তাহারা নামিয়া আসিল। তাহাদের সম্মুখে, অষ্টাদশবর্ষীয় এক দল বালক, ত্রিশিখা-বিশিষ্ট মশাল ধরিয়া আছে; এবং বাহিরে আসিয়া, উদীয়মান দিবালোক যেমন-যেমন বৰ্ধিত হইতেছে, অমনই উহারা এক একটা করিয়া মশাল নিভাইয়া দিতেছে। এই বৃদ্ধ পুরোহিতেরা, এক এক জন করিয়া ক্রমান্বয়ে সেই দূরস্থ কৃষ্ণবর্ণ সোপানের উচ্চতম ধাপে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল; এবং ধাপ হইতে ধাপান্তরে ক্রমশঃ যেমন নামিতে লাগিল, ঐ গুহ্যধর্ম্মের সেবক শুভ্রকেশ মুর্ত্তিগুলি প্রভাতের তরুণ আলোকে আরও পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। যাহাতে স্বকীয় ইষ্টদেবের বিশূল-চিটি আরও বিস্তৃতভাবে অঙ্কিত হইতে পারে, এই জন্য উহাদের ললাটের উপরিভাগ হইতে মস্তকের চূড়াদেশ পর্য্যন্ত মুণ্ডিত। পার্থিব বিষয় সম্বন্ধে এমনই উদাসীন যে, উহারা প্রায় উলঙ্গ—একখণ্ড বস্ত্রমাত্র উহাদের গায়ে জড়ানো রহিয়াছে। বর্ণভেদের চিম্নস্বরূপ, শোণের শুভ সূক্ষ্ম সূত্রগুচ্ছ জটা পাকাইয়া তির্যকভাবে বক্ষের উপর লম্বমান। মন্দিরাকৃতি সেই শোভাগৃহের জালা ও রথ—এই উভয়ের মধ্যে রেশমী বস্ত্রে আচ্ছাদিত একটি পদ-সেতু-—যাহার উপর দিয়া কিছু পূর্ব্বে স্বর্ণবিগ্রহটিকে লইয়া যাওয়া হইয়াছিল—সেই সেতুটি এক্ষণে উঠাইয়া লওয়া হইল। এইবার এক দল কৃষ্ণকায় বাদক এরূপ সজোরে বাদ্য বাজাইতে লাগিল যে, কর্ণ বধির হইয়া যায়, এবং এই বাদ্য এরূপ বন্য-ভীষণ ও শোকভারাক্রান্ত যে, শুনিলে শিহরিয়া উঠিতে হয়। এক দল লোক ঢাক পিটিতেছে; অপর এক দল, বিরাটাকার তুরীসমূহ সেই প্রচ্ছন্ন দেবতার অভিমুখে উত্তোলন করিয়া, উহাতে প্রাণপণে ফুৎকার করিয়া অমানুষিক ধ্বনি বাহির করিতেছে।

 রথ সাজানো হইয়াছে। চৌঘুড়ি গাড়ীর অশ্বচতুষ্টয়ের অনুকরণ করিয়া চারিটা বড় বড় কাঠের ঘোড় রথের সম্মুখভাগে স্থাপিত হইয়াছে। এই তেজীয়ান বোযদীপ্ত পক্ষিরাজ ঘোড়াগুলি পা ও ডানার আস্ফালনে আকাশকে তাড়না করিতেছে। লাল রেশমের দুর্ভেদ্য যবনিকার মধ্যে বিগ্রহটি প্রচ্ছন্ন। বিগ্রহ-সিংহাসনের চতুর্দিকে ‘ঝুলানো বাগিচা’র ন্যায় কতকগুলি পুষ্পিত কদলীবৃক্ষ স্থাপিত হইয়াছে। বস্ত্রের ঝালরে দুই তিন গজ লম্বা বৃহদাকার লোলক-সমূহ ঝুলিতেছে। স্বাভাবিক পুষ্প ও জরীজড়ানো পুষ্পমাল দিয়া এই লোলকগুলি রচিত। এই চক্রবিশিষ্ট অট্টালিকার সকল তলার উপরেই কতকগুলি উলঙ্গ প্রায় বালক অধিষ্ঠিত; প্রথমে উহারা বস্ত্রসজ্জার মধ্যে—পুষ্প-গ্রথিত রেশম-মণ্ডিত মঞ্চতলৈ লুক্কায়িত ছিল,উহারাই বিগ্রহের পাশ্বরক্ষী। যে সময়ে নিম হইতে সেই ভীষণ ভূর্য্যধ্বনি হইল, অমনই উহারাও উপর,হইতে রীনাদ করিতে লাগিল।

 এইবার সুলক্ষণ হস্তীদিগকে আনা হইল। উহারা নূতন জরীর পোষাক ও মুক্তাখচিত জরীর টুপি পাইবার জন্য, আপনা হইতেই হাঁটু গাড়িয়া বসিল। তাহার পর চলিয়া গিয়া চির-অভ্যস্তভাবে পুরোহিতদিগের পশ্চাতে দণ্ডায়মান হইল। সহযাত্রিগণ এখনও অচল স্থিৱ। যুবকেরা, সম্মুখভাগে চারি সার বাঁধিয়া, ভূতলে-প্রসারিত চারিটা বিস্তীর্ণ রঞ্জুর ধারে ধারে আসিয়া দাঁড়াইল। বীথির যে ধারে মন্দিরের প্রাচীর—সেই ধারটি এক্ষণে তমসাচ্ছন্ন, পরিত্যক্ত, বিষাদময়। কিন্তু অপর ধারে ব্রাহ্মণদিগের আবাস-গৃহের সম্মুখে, জনতার বৃদ্ধি হইয়াছে—উহারা একদৃষ্টে রথের দিকে তাকাইয়া আছে। গবাক্ষ, গুরুভার-স্তম্ভ-সমন্বিত বারাণ্ডা, বিকটাকার পশুমূর্ত্তিভূষিত সোপানাবলী-শিশু ও বৃদ্ধগণ কর্তৃক অধিকৃত। বিশেষতঃ সেখানে রমণীগণের জনতা। উহারা জরীর পাড়ওয়ালা শাড়ী পরিয়াছে, উহাদের গলায় পুষ্পমালা ঝুলিতেছে, অঙ্গে নানাবিধ অলঙ্কার ঝক্ক্ করিতেছে। উহাদের মধ্যে কেহ কেহ, পুরোহিতদিগের জন্য উপহারসামগ্রী আনিয়াছে; কেহ বা চুর্ণ-পাত্র হস্তে করিয়া, ভূতলস্থ নক্সা-চিত্র যেখানে সেখানে লুপ্ত হইয়াছে, সেই সকল নক্সা আবার তাড়াতাড়ি ফুটাইয়া তুলিতেছে। স্থানে স্থানে নূতন হলুদে ফুল বসাইয়া দিতেছে।

 কিন্তু এই উষপ্রধান দেশে, নৰভানু-উদ্ভাসিত মুক্ত আকাশ, মানবের সমৃদ্ধি-আড়ম্বর-প্রদর্শনের পক্ষে কি অনুপযোগী। যখন আমি মন্দিরের ছাদ হইতে নামিয়া আসিলাম, তখন ও শেষাবশিষ্ট মশাল গুলির দীপ্তি—স্মলিতপদ ঊষার অর্ধস্ফুট আলোকে অক্ষু ছিল। তখনও সমস্তই কুহকময় বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছিল; কিন্তু এক্ষণে প্রভাতিক গগনের অভিনব অকলুষ স্বচ্ছতার মধ্যে সে কুহকটা ছুটিয়া গিয়াছে। এখন এই আকাশে আর কিছুই নাই, সর্ব্বত্র কেবলই অপরিসীম বিশুদ্ধতা—মনোহর হরিদ্বর্ণকি-এক প্রভাময় হরিণ—পাণ্ডুর হরিণ—যাহার নাম নাই—যাহা বর্ণনাতীত। ইহার পর, সমস্তই যেন হীন গভ, ম্লানচ্ছবি। এক্ষণে মন্দিরপ্রাচীরে জরাজীর্ণতা ও রক্তিম কুষ্ঠক্ষত-সকল প্রকাশ পাইতেছে। এখন যেন সমস্তই বেশী বেশী দেখা যাইতেছে। এ সমস্ত ঢাকিয়া রাখিতে হইলে, হয় নিশার আবরণ আবশ্যক, নয় দুর্নিরীক্ষ্য মধ্যাহ-সূর্যের দীপ্তপ্রভার প্রয়োজন। রথের বিলাস-সজ্জা নিতান্তই স্থূল ও শিশুচিত্তহারী। হস্তীদের পরিচ্ছদ জীর্ণ ও বহু-ব্যবহৃত। যুবতী ললনাদের মুখমণ্ডর ও কণ্ঠদেশের বিশুদ্ধ তাম-আভা অক্ষুন্ন থাকিলেও, উহাদের দীনহীন মলিন তীরবস্ত্র প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। ব্রাহ্মণ-ভারতের বার্ধক্য ও অবনতি, এই সব অমানুষিক স্মৃতি-মন্দিরের ধ্বংসদশা, উহাদের উৎসব-অনুষ্ঠানাদির ধূলিধূসর জীর্ণতা, এমন কি, এই মহাজাতির বর্তমান হীনতা-—সমস্তই, এই কুহকময় মুহূর্তে, আমার নিকট অপ্রতিবিধেয় বলিয়া মনে হইতেছে। অতীতের লোক—অতীতের ধর্ম্ম—এই উভয়েরই যুগচক্র যেন ঘুরিয়া গিয়াছে, উহারা এক্ষণে শূন্তে বিলীন হইয়াছে।,

 তথাপি এখানে বিদেশীয় ভাবের গন্ধমাত্র নাই। এই প্রাচীন সাজসজ্জার মধ্যে, আধুনিক কালেব ছোটখাটো খুঁটি নাটি সামগ্রী প্রবেশ করিয়া ইহকে বেসুরো বেখাপ্পা করিয়া তুলে নাই। বিধর্ম্মী একমাত্র আমিই এই উৎসব-অনুষ্ঠানে উপস্থিত।

 ফলতঃ এই সূর্য্যই এ দেশের মহা-ঐন্দ্রজালিক। সূর্য্যই সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া সমস্ত পদার্থকে রূপান্তরিত করিয়া তুলে। সূর্যের এই আকস্মিক উদয়ে কি-জানি কি-একটু কারুণ্য-রস আছে, যাহা মন্দিরের সহিত আজ যে দেবতার পূজা হইবে, সেই দেবতার সহিত—একতানে মিশিয়া যায়। দিগন্তে একটিমাত্র মেঘখণ্ড। ধরণীর ধূলিকণা যে আমরা—আমাদের দৃষ্টি হইতে এই মেঘখণ্ডটি সূর্য্যকে এখনও পর্য্যন্ত ঢাকিয়া রাখিয়াছে। একটি ঘোর তাম্রবর্ণ কটিবন্ধের উপরিভাগে সূর্য্যদেব অগ্নিশিখা বিকীর্ণ করিতেছেন। বিষ্ণু দেবের ত্রিশূলচিহ্বের ন্যায় তিনটি অগ্নিশিখা প্রদীপ্ত। ইহারই মধ্যে এই প্রকাণ্ড অট্টচূড়াগুলি সূর্য্যদেবের দৃষ্টিপথে পতিত হইআছে। এই রক্তিমাভ পাষাণস্ত,পগুলি-গগনচুম্বী মন্দিরগুলি দেব-মাহাত্ম্যে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে। এই সকল খোদিত প্রস্তরময় মূর্তি-অবণ্যের মধ্যে, টিয়া-পাখীর শত সহস্র নীড় রহিয়াছে। বিবিধ মুখভঙ্গি ও অঙ্গভঙ্গিবিশিষ্ট লোহিত মূর্তির মধ্যে ও বাহু-জ্যার জটিল মিশ্রণের মধ্যে—সেই উচ্চ শুন্য দেশে উহারা ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছে—চীৎকার করিতেছে।  রথের শীর্ষদেশে, গিণ্টিকরা কাজগুলি ঝক্ মক্ করিতেছে। এইবার যাত্রাকাল উপস্থিত। ভূরীধ্বনি করিয়া যেই সঙ্কেত করা হইল, অমনই পেশী-স্ফীত-বাহু শতসহস্র লোক রজ্জর নিকটে সার দিয়া দাঁড়াইল। সমস্ত যুবক-মণ্ডলী—এমন কি, উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণেরাও ভক্তি ও প্রীতিসহকারে এই সাধারণ কার্যে যোগ দিল। এইবার রথ টানিবার উদ্যোগ হইতেছে। লোকেরা রমণীসুলভ বিবিধ ভাবভঙ্গী প্রকাশ করিতেছে। এই সকল ভাবভঙ্গীর সহিত উহাদের নেত্রস্ফুর্ত পৌরুষিক তেজ ও স্কন্ধদেশের বিশালতা মিশ খাইতেছে না। উহারা গুরুকেশভার উন্মোচন করিয়া, এবং বলয়ভূসিত বাহু উত্তোলন করিয়া, কেশে দৃঢ় গ্রন্থি বন্ধন করিল।

 পুনর্ব্বার সঙ্কেত। ঢাক ঢোল সরোযে বাজিয়া উঠিল; সজোরে তুরীদ হইতে লাগিল; তাহার সহিত মানব-কণ্ঠ-নিঃসৃত মহা নিনাদ সম্মিলিত হইল; বাহুর পেশীসমূহ সঙ্কুচিত হইল;—রজুগুলিতে টান পড়িল। কিন্তু এই বিরাটযন্ত্রটি একটুও নড়িল না। গতবর্ষের রথযাত্রার পর হইতে, উহা স্থূল মৃত্তিকার মধ্যে আবদ্ধ।

 একজন প্রধানের অনুজ্ঞাক্রমে, আরও ভাল-করিয়া সমবেত চেষ্টা আরব্ধ হইল। এইবার বোধ হয়, আর কোন বাধা হইবে না। আরও অনেক লোক দোঁড়িয়া আসিল; তুষার-শুভ্র-যজ্ঞসুত্রধারী বৃদ্ধগণ, এই কৃষ্ণ রজুর সহিত তাহাদের শুভ সূত্র সম্মিলিত করিল; জনতা হইতে একটা মহা কোলাহল সমুখিত হইল; বাহু ও প্রকোষ্ঠের মাংসপেশী আরও দৃঢ় কঠিন হইয়া উঠিল। তবু কিছুই হইল না! রজ্জ্বগুলি সুদীর্ঘ মৃত ভুজঙ্গবৎ হতাশ হইয়া হস্ত হইতে ভূতলে ঋলিত হইল!

 তথাপি উহারা বেশ জানে,—দেবতার রথ নিশ্চয়ই চলিবে। সহস্র বৎসর হইতে আবহমানকাল পর্য্যন্ত রথ অবাধে চলিয়াছে। যাহাদের বাহু এক্ষণে ধূলিসাৎ হইয়া গিয়াছে, যাহাদের আত্মা বহুকাল-যাবৎ দেহান্তর প্রাপ্ত হইয়া, অথবা মায়াময় ব্যক্তিত্ব হইতে মুক্তিলাভ করিয়া, বিশ্বায়ার মধ্যে বিলীন হইয়া গিয়াছে—সেই সব পূৰ্বপুরুষের উদ্যম চেষ্টায় রথ এতকাল চলিয়াছে।

 রথ অবশ্যই চলিবে। রথ চলিবে বলিয়া বৃদ্ধ পুরোহিতদিগের ধ্রুব বিশ্বাস। সেই জন্য তাহারা অবিচলিতভাবে প্রতীক্ষা করিতেছে। তাহাদের নেত্রে অন্যমনস্কভাব; তাহাদের আত্মা ইহারই মধ্যে যেন তপঃক্লিষ্ট দেহ হইতে বিমুক্ত। এমন কি, হস্তীরা পর্য্যন্ত জানে যে, রথ চলিবে; তাই তোহারাও অতীব প্রশান্তভাবে অপেক্ষা করিতেছে। তাহাদের মনে যে চিন্তাপ্রবাহ চলিতেছে, আমাদের নিকট তাহা দুরবগাহ হইলেও, এই সব চিন্তায় তাহাদের বৃহৎ মস্তিষ্ক পূর্ণ। তাহাদের মধ্যে যে হস্তী সর্ব্বজ্যেষ্ঠ, সে বিলক্ষণ জানে, রথ এক সময়ে চলিবেই চলিবে। কেন না, তাহারা তিন চারি পুরুষ হইতে বংশানুক্রমে, মানববাহুকে রজু ধরিয়া রথ টানিতে দেখিয়াছে;—শত বৎসর হইতে এইরূপ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়াছে।

 চলে এসো! আনো ফিনা, আনো কপিকলের রসারসি; উঠাও চাড়া দিয়া! এক দল মুটিয়ার কাঁধে কতকগুলা কাঠের গুড়ি আসিয়া পৌছিল। একটা গুড়ির প্রান্তদেশে একটু ছিলকা উঠাইয়া, আবদ্ধ চাকাটির নীচে সেই প্রান্তভাগ স্থাপিত হইল; এবং গুড়ির উচ্ছিত অপর * প্রান্তের উপর অশ্বারোহীর ধরণে দশ জন লোক বসিয়া ঝকানি দিতে লাগিল; ও দিকে, কপিকলের রসারসি ও,রজ্জ্বগুলিতেও এক সঙ্গে টান পড়িল। এইবার সেই পর্ব্বত-শিখর একটু নড়িল! একটা আনন্দের কোলাহল সমুখিত হইল;—রথ চলিল!

 ভূমিতে চারিটা গভীর খাত খনন করিয়া রথচক্র ঘুরিতে ঘুরিতে চলিল। অক্ষদণ্ডের আর্তনাদ, নিষ্পেষিত কাষ্ঠের কাতরধ্বনি, মনুষকণ্ঠের কোলাহল ও পবিত্র ভূরীর ঘোর নিনাদ যুগপৎ সমুথিত হইল। শিশু-সুলভ আনন্দ উচ্ছসিত হইল; সমস্ত আস্ত-বিবর উদঘাটিত হইল; জয়ধ্বনি করিবার, জন্য সমস্ত অশুভ্র দন্তপাঁতি বিকশিত হইল; সমস্ত বাহু শূন্যদেশে উৎক্ষিপ্ত হইল; এই আনন্দে উন্মত্ত হইয়া লোকেরা রঞ্জুতে টান্ দিতে বিস্মৃত হইল; -রথ থামিল! সমবেত আকর্ষণের প্রথম আবেগে, প্রায় ত্রিশপদ অগ্রসর হইয়াছিল, আবার রথ ভূমিতে আবদ্ধ হইয়া পড়িল। হস্তীর রথের পিছনে পিছনে আসিতেছিল, রথ সহসা থামিয়া যাওয়ায়, উহাদের পরস্পরের মধ্যে ঠেকাঠেকি হইতে লাগিল। আবার সমস্ত গোড়া হইতে আরম্ভ হইল।

 কিন্তু এবার শৃঙ্খলার সহিত আরম্ভ হইল। লোকেরা কপিকলের বসারসি, ফিক্‌না-আদি আনিতে গেল। এই অবসরে, রমণীগণ পুরোহিতজনতার মধ্যে তাড়াতাড়ি আসিয়া—এমন কি, নিরীহ হস্তিগণের প্রায় পদপ্রান্তে আসিয়া উপস্থিত হইল। স্বর্ণবিগ্রহের গুরুভারে, ভূতলে যে রথ্যা খনিত হইয়াছে, তাহা চুম্বন করিবার জন্য এই সময়ে সৌরকর, মন্দির-চূড়া হইতে নামিয়া আসিয়া জনতার উপর পতিত হইল, এবং উহাদিগকে নবতর শোভায় সজ্জিত করিল। সমস্ত নগ্ন বাহুতে ধাতব বলয় ঝকমক করিতেছে; রমণীগণের মুখমণ্ডলে, শলাকা-বিদ্ধ নাসিকাপুটে, হীরামাণিক্যের ভূষণ ঝিকমিক করিতেছে; অতিসূক্ষ রঙ্গিন্ মলমল অথবা জরীর পাড় বিশিষ্ট মমলের ভিতর দিয়া মীনাক্ষী শিবানীর বক্ষের ন্যায় নির্ম্মল কণ্ঠদেশ দেখা যাইতেছে।

 এইবার এই বিরাট যন্ত্রটি দমকে-দমকে ভীষণ বেগে চলিতেছে। মধ্যমধ্যে থামিতেছে—আবার চলিতেছে। এই গতিক্রিয়া ও পৈশিক বলের উদ্দাম বিলাস-লীলা দুই তিন ঘণ্টা ধরিয়া চলিবে। এই যাত্রাপথের পশ্চাদ্ভাগে, ভূমি যেন শত শত হলের দ্বারা কর্ষিত হইয়াছে—সেই ভূমি, যাহা প্রাতঃকালে যেন ‘রোলার যন্ত্রে সমীকৃত হইয়াছিল, এবং শুভ্র নক্সা-চিত্রে ও সুষমান্বিত কুসুমসমূহে বিভূষিত হইয়াছিল!

 যেখানে বীথির বক্‌ ফিরিয়াছে, এবং যে দিকে রথটিকেও ফিরাইতে হইবে, সেই মন্দিরের কোণে রথ আসিয়া যখন অনেকক্ষণ থামিল, সেই অবসরে একজন প্রদর্শক ও একজন ব্রাহ্মণকে লইয়া, একটু নিস্তব্ধতা ও মুক্ত বায়ুর অন্বেষণে, সেই বৃহৎ দালানের জটিল অরণ্য—সেই সহস্র-স্তম্ভ মণ্ডপ-শালা—সেই তমসাচ্ছন্ন অসংখ্য পার্শ্ব-দালানের উৰ্দ্ধদেশে মন্দিরের সেই বিশাল বিস্তীর্ণ ছাদের উপর আবার আরোহণ করিলাম। প্রভাতে যেরূপ মরুবৎ শূন্য দেখিয়াছিলাম, এখনও সেইরূপ। কিন্তু সপ্ত ঘটিকার সূর্যালোকে এই স্থানটি আরও ভগ্নপ্রায়—আরও দীনভাবাপন্ন বলিয়া প্রতীয়মান হইল। রক্তিম-ধূসরবর্ণ;—জরা-জাত বলি-রেখার ন্যায় সর্ব্বত্র। ফাট্ ধরিয়াছে—চীড় পড়িয়াছে। এখনও যথেষ্ট প্রভাত; সূর্য্য এখনও যথেষ্ট নিয়ে; এই ছাদের উপর এখনও বেশ বসা যায়; এমন কি, এই সব অমানুষী মন্দির-চূড়ার দীর্ঘ-প্রক্ষিপ্ত ছায়াতলে দিব্য আরামে শয়ন করাও যায়।

 এই ছাদ,‘ষ্টেপ’ নামক রুসিয়ার অধিত্যকা ভূমির ন্যায় সুবিস্তীর্ণ। কিনারায়, বাদুড়ের ডানা-যুক্ত কতকগুলি পুরাতন ক্ষুদ্র দেবমূর্তি স্বকীয়। চরণযুগল দর্শন করিবার জন্যই যেন বহির্দিকে ঝুঁকিয়া রহিয়াছে। ইহা ছাড়া আর কিছুই নাই;—সমস্তই সমতল। জীর্ণ শীর্ণ লুপ্ত-প্রলেপ দেবমূর্ত্তিসমন্বিত মন্দিরচুড়া ভিন্ন এখানে আর কিছুই নাই;—চুড়াদিগের মধ্যে এক . একটা বিস্তৃত ব্যবধান-পরিসর। সমতল ছাদ হইতে চূড়াগুলি দূরে-দূরে অবস্থিত;— মন্দিরের আয়তন এতই বৃহৎ।

 ইতস্ততঃ, খাতের আকারে কতকগুলি বিচরণভূমি এখান হইতে দৃষ্টিগোচর হইতেছে। তমসাচ্ছন্ন মণ্ডপশাল-সমুহের মধ্যে—কোনরূপ প্রকারে যেন জায়গা যাচাইয়া এই বিচরণভূমি রচিত হইয়াছে। উহার মধ্যে যেটি সকলের মধ্যস্থলে অবস্থিত, তাহাতে বটবৃক্ষ রোপিত;—সেই বটবৃক্ষের সবুজ মাথাগুলি ছাদ পর্য্যন্ত উঠিয়াছে, এবং তাহাতে ফুল ধরিয়াছে। মন্দিরের যে স্থানটি সর্ব্বাপেক্ষা পবিত্র—সেই ভীষণ গুপ্তস্থান —সেই দুরধিগম্য তমসাচ্ছন্ন রহস্য-স্থানকে বেষ্টন করিয়া এই বিচরণভূমিটি অধিষ্ঠিত।

 প্রাচীরের মাথায় যে সকল ছোট-ঘোট দেবমূর্ত্তি ঝুঁকিয়া রহিয়াছে, তাহারা বোধ হয় এই রথযাত্রা দেখিবার জন্য সমুৎসুক। কিন্তু আমি এখান হইতে কিছুই দেখিতে পাইতেছি না—কিছুই শুনিতে পাইতেছি না। নিম্নদেশের চটুল গতিবিধি আমার নিকট প্রচ্ছন্ন। এমন কি নিকটস্থ নগর, গৃহ, মার্গ, সমস্তই আমার নিকট প্রচ্ছন্ন। আমার এই শূন্য মরুক্ষেত্র সেই তাল-অরণ্যের সংলগ্ন বলিয়া মনে হইতেছে,—বাহার চূড়াগ্রভাগ দিগন্তকে নীলিম করিয়া তুলিয়াছে॥

 আমার এই দুর্নিরীক্ষ্য প্রজলন্ত আকাশ-খণ্ডে, কাক চাল ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। মধ্যে মধ্যে সবুজ টিয়া-পাখীগুলা উড়িয়া যাইতেছে। সর্ব্বত্র টিকটিকি গিরগিটি বিচরণ করিতেছে। যে কাঠবিড়ালী ভারতের সমস্ত ভগ্ন মন্দিরসমস্ত বৃক্ষ আশ্রয় করিয়া থাকে—সেই কাঠবিড়ালিরা পরস্পরের অনুধাবন করিতেছে; পবিত্র প্রস্তররাশির মধ্যে খেলা করিয়া বেড়াইতেছে। এখানে নিঝুম নিস্তব্ধতা। এই দেবমূর্তি-সমন্বিত অদ্ভুতাকৃতি চূড়াগুলি আমার মাথা ছাড়াইয়া উঠিয়াছে,—চূড়াগুলি এত অদ্ভুত ও এত উচ্চ যে, ইহা বাস্তুনিৰ্মাণ-পদ্ধতি-বিষয়ক যুবোপীয় সমস্ত সংস্কারের বিরুদ্ধ। এই চূড়াগুলি ব্যতীত এখানে এমন আর কিছুই নাই যা আমার চিত্তে ভীতি-সঞ্চার করিতে পারে। এই চূড়াগুলির নিস্তব্ধতা অনন্ত অসীম।

 এই গগন-বিলম্বী মরুদেশের ছায়াতলে, শান্তি-আরামে এক ঘণ্টা কাণ কাটিয়া গেল। আমার প্রদর্শক ও ব্রাহ্মণ এই কবোষ্ণ পাষাণের উপবেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।•••••••

 নিশ্চয়ই আমার দৃষ্টিবিভ্রম বা ঘূর্ণি-রোগ উপস্থিত!•••••ঐ অদূরে একটা চূড়া ••••এইমাত্র নড়িয়া উঠিল•••••ঐ যে আবার চলিতেছে!••••  মুহূর্তকাল স্তম্ভিত হইলাম, পরে দৃষ্টিপাত করিয়া সমস্ত বুঝিলাম। সুহো! রথের চূড়াটিও মন্দির-চূড়ার অনুকরণে নির্ম্মিত। আমা হইতে বহুদূরে মন্দিরের সম্মুখ দিয়া রথটাকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। আমি যেখানে আছি, তাহারই নীচে, আকৃষ্ট রঞ্জু, উন্মত্ত জনতা, হস্তিবৃন্দ, সহযাত্রিদল—সমস্তই যেন একটা খাতের মধ্যে প্রচ্ছন্ন। যে সিংহাসনের উপর অদৃশ্য বিগ্রহটি আসীন, তাহারই উপরিস্থ চূড়াটিমাত্র আমি দেখিতে পাইতেছি। কোনও জয়ধ্বনি কিংবা কোনও বাদ্যনির্ঘোষ শুনা যাইতেছে না। বিষ্ণুরথের এই শেষ প্রতিবিম্ব আমার নেত্রবিম্বে পতিত হইল। ছাদের ধার দিয়া, প্রস্তররাশির মধ্যে, যেন একটি মন্দির-চূড়া একাকী নিস্তব্ধভাবে আপনা-আপনি চলিতেছে।