বিষয়বস্তুতে চলুন

ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/রথযাত্রার আয়োজন

উইকিসংকলন থেকে

রথযাত্রার আয়োজন।

 এই ত আমি শ্রীরাগমে আবার ফিরিয়া আসিলাম। এখন রাত্রি। সম্মুখে বৃহৎ বিষ্ণুমন্দিরের প্রাচীর। যেখানে কেবল ব্রাহ্মণেরা বাস করেইহা সেই গণ্ডির মধ্যে অধিষ্ঠিত, এবং আমি এক্ষণে বীথির সেই অংশে উপস্থিত হইয়াছি, যেখান হইতে সমস্ত মন্দিরটি প্রদক্ষিণ করা যায়। এইখানে চালোকে রথটি অপেক্ষা করিতেছে। উহার উপর একপ্রকার সিংহাসন কিংবা একপ্রকার চূড়া-বিশিষ্ট মঞ্চ;—উহার গায়ে লাল রঙ্গের, পাণ্ডু রঙ্গের রাংতা ঝকমক করিতেছে; উহার ছাদ, মন্দির-চূড়ার অনুকরণে নির্মিত ও বিবিধ অলঙ্কারে বিভূষিত। ঐ সমন্তের তলদেশে যে আসল রথটি অবস্থিত, উহা ব্রাহ্মণ-ভারতের ন্যায় পুরাতন;—উহা উৎকীর্ণ কাঠফলকামূহের একটা গুরুভার প্রকাণ্ড শুপ-এরূপ প্রকাণ্ড যে, মনে হয় না, উহাকে কেহ কখন নড়াইতে পারে। কিন্তু এই বিভূষিত স্তুপটি—এই ঝকমকে অতি প্রকাণ্ড চূড়াসমন্বিত মঞ্চটি আজ বেশ শোভনভাবে স্থাপিত হইয়াছে। এখন উহাকে, রেশম ও রাংতায়-ঢাকা বাঁশের কাঠামেকাগজ-মোড়া খুব হালকা অথচ একটা জমকালো জিনিষ বলিয়া মনে হইতেছে। রথের চারিধারে দলবদ্ধ হইয়া যে সকল শুক্ল-বেশধারী লোক দাঁড়াইয়া আছে, তাহাদের উপর চাদের কিরণ পড়িয়াছে?—এই সকল ভারতবাসী রাত্রিকালে প্রায়ই সূক্ষ্ম মলমল বস্ত্রে স্বকীয় গাত্র ও মস্তক আবৃত করিয়া উপছায়ার ন্যায় বিচরণ করে; কিন্তু যেন চন্দ্রালোকও যথেষ্ট নহে, উহারা আবার মশাল লইয়া আসিয়াছে। কেন না, বিকট বিরাট কূর্ম্ম-সদৃশ এই রথটির গায়ে, বৎসরের মধ্যে একবার চাকা লাগাইবার জন্য উহাদিগকে আজ বিশেষরূপে খাটিতে হইবে। এই রথচক্র গুলি, উচ্চতায় মনুষ্যের অর্ধ-শরীর ছাড়াইয়া উঠে; এই চক্রগুলি পুরু কাঠফলকের দুই স্তবকে নির্মিত; কাঠফলকগুলি উল্টা-উণ্টিভাবে সন্নিবেশিত, এবং লোহার প্রেক্ দিয়া আবদ্ধ। ইতিমধ্যেই উহারা রথ টানিবার রসি ভূমির উপর লম্বা করিয়া বিছাইয়া রাখিয়াছে; এই রসি ব্রহ্মার জঘার ন্যায় স্কুল; বিরাট রথ-যন্ত্রটি নাড়াইবার জন্য তিন চারি শত উন্মত্ত লোক এই রসিতে আপনাদিগকে জুড়িয়া দিবে।

 এই সময়ে মন্দিরটি—এই প্রস্তররাশির প্রকাণ্ড শুপটি একেবারেই জন্য, নৈশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন, শব্দগভীরতায় ভীষণ। জনপ্রাণী নাই, কেবল পার্শ্ববর্তী স্থানের কতকগুলি ব্রাহ্মণ উৎসব উপলক্ষে আসিয়া এইখানে আশ্রয় লইয়াছে। এবং সাদা চাদর মুড়ি দিয়া, সানের উপর সটান পড়িয়া মড়ার মত ঘুমাইতেছে। দূর-দূরান্তরে লম্বমান মিটমিটে প্রদীপগুলা জ্যোৎস্নলোকের সহিত যেন পালা করিয়া, পুত্তলিকা-সমুহের ও স্তম্ভারণ্যের অনন্তত আরও বর্ধিত করিতেছে।

 যে বীথি-পথটি দিয়া কাল প্রভাতে, রথযাত্রা আরম্ভ হইবে, উহা মন্দিরের ভীষণ দন্তুর প্রাকারের চারিধার দিয়া গিয়াছে। এই প্রশস্ত সরল পথটি,—প্রাকার ও ব্রাহ্মণদিগের পুরাতন গৃহ-সমূহের মধ্য দিয়া চলিয়াছে; ছোট ছোট থাম, বারাণ্ডা, বিকট-প্রস্তর-মূর্তি-বিভূষিত সোপান-ধাপ— এই সকলের জটিল মিশ্রণে গৃহগুলি পূর্ণ। পথটি আজ সজীষ হইয়া উঠিয়াছে; কেন না, আজ রাত্রে প্রায় কেহই নিদ্রা যাইবে না। এই সকল শুভ্র-বসন-ধারী লোকেরা দলে দলে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে; মনে হইতেছে যেন, চন্দ্রমার বিরাট ছায়া-মূর্তিখানি উহারা প্রত্যেকে আংশিকভাবে নিজ নিজ দেহে প্রকটিত করিতেছে, এবং দেব ও পশুসমূহের “পিরামিড়” সেই প্রকাণ্ড বিরাট গুরুভার বিষ্ণু-মন্দিরের কৃষ্ণবর্ণ চূড়াগুলি সর্ব্বোপরি রাজত্ব করিতেছে। উচ্চবর্ণের রমণীরা, বালিকারা, গৃহ হইতে বাহির হইতেছে; যে ভূমিখণ্ড চষিয়া—গভীর মাটি খুঁড়িয়া, বিষ্ণুদেবের রথ কাল যাত্রা করিবে, সেই পুণ্যভূমিকে চিত্রিত ও অলঙ্কৃত করিবার জন্য, উহারা স্ব স্ব গৃহের দ্বারদেশে আসিয়া চলা-ফেরা করিতেছে; সচরাচর উহারা প্রাতঃকালেই ঐ লাল মাটি বিচিত্র-রঙ্গের রেখায় অঙ্কিত করে; রথটি খুব প্রত্যুষেই যাত্রা করিবে। আজ রাত্রিটি কি পরিষ্কার! এই চাদের আলোয় দিনের মত সমস্ত স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। আর এই রমণীদিগের নিকট—এই বালিকাদিগের নিকট এত জুই ফুলের মালা রহিয়াছে—এত ফুলের হার তাহাদের কণ্ঠে ঝুলিতেছে যে, মনে হয়, যেন তাহারা সুগন্ধী ধূপাধার সঙ্গে, করিয়া সর্ব্বত্র বিচরণ করিতেছে।  ঐ দেখ একজন নবযুবতী-গঠনটি বেশ ছিপছিপেজরির-কাজ-করা কালো রঙ্গের মলমল-শাড়ী পরিয়াছে; দেখিতে এমন সুশ্রী যে, না ইচ্ছা করিয়াও, তাহার সম্মুখে থমকিয়া দাঁড়াইতে হয়। যতবার সে মাটির দিকে নীচু হইতেছে—যতবার সে উঠিতেছে, ততবারই তাহার বাহু ও চরণদ্বয় হইতে নূপুর-বলয়ের মধুর ঝঙ্কার শ্রুত হইতেছে; যে সকল মনঃকল্পিত নক্সা সে ভূমির উপর আঁকিতেছে, তাহাতে তাহার অপূর্ব্ব কল্পনা-লীলার পরিচয় পাওয়া যায়। * * * আজিকার রাত্রে যে ব্যক্তি আমার প্রদর্শক, তাহার নাম “বেল্লনা"—উচ্চবর্ণের লোক; স্ত্রীলোকটির সহিত সে সাহস করিয়া কথা আরম্ভ করিয়া দিল, এবং আমার হইয়া সে জিজ্ঞাসা করিল—তাহার সাদা গুড়া আমাকে সে কিছু দিতে পারে কি না, যদি দেয়, তাহা হইলে আমিও তাহার গৃহের সম্মুখস্থ ভূমিটি চিত্রিত করিয়া দিই। সে একটু মুচকি হাসিয়া সঙ্কোচের সহিত তাহার চূর্ণাধারটি আমার নিকট পাঠাইয়া দিল, সে স্বয়ং আমার হস্ত স্পর্শ করিতে কুষ্ঠিত হইল। আমার হস্ত হইতে কিরূপ নক্সা বাহির হয়, দেখিবার জন্য কুতূহলী হইয়া, এই সকল উপচ্ছায়াবৎ শুভ্রবসনধারী লোকেরা আমার চারি দিকে ঘিরিয়া দাড়াইল।

 বিষ্ণুর সাঙ্কেতিক চিটি আমি অতি পরিপাটীরূপে লাল মাটির উপর চিত্রিত করিলাম। তখন, বিস্ময় ও মমতা-সূচক অস্ফুট গুঞ্জনধ্বনি চারি দিক হইতে সমুখিত হইল। তখন সেই রূপসী ভারত-ললনা স্বয়ং সেই চূর্ণাধারটি আমার হস্ত হইতে ফিরিয়া লইল; এমন কি, তাহার কল্পত নক্সা-রচনার কাজে আমাকে সহকারী করিতেও সম্মত হইল:চারিধারে গোলাপ ফুলের ও তারার না কাটিয়া তাহাদের প্রত্যেকের মধ্যবিন্দুতে এক একটি Ibiscus ফুল বসাইয়া দিতে হইবে।—ইহাই তাহার নার কল্পনা।

 যাহা হউক, আমাকে সে যে স্পর্শ করিল তাহার পক্ষে ইহা একটা খুব দুঃসাহসের কাজ সন্দেহ নাই। একটা অবিবেচনার কাজ করিয়া ফেলিয়াছে বলিয়া আমার সহিত জড়িত কোন কষ্টকর স্মৃতি তাহার মনে থাকিয়া না যায়, এবং তাহার নিকট হইতে অন্ততঃ শিষ্টাচার-সম্মত একটি বিদায়-দৃষ্টিও যাহাতে আমি লাভ করিতে পারি—এই হেতু, এই সময়ে আমি সরিয়া পড়াই শ্রেয় মনে করিলাম।

 ও-দিকে উজ্জ্বলপ্রভ চুড়াসমন্বিত কনক-পত্র-মণ্ডিত বিষ্ণু-রথের চারিধারে, শুক্লবসনধারী লোকেরা দলে-দলে সম্মিলিত হইয়াছে। দ্বিপ্রহর রাত্রি আগ্রতপ্রায়। এইবার কি একটা রহস্য-ব্যাপার অনুষ্ঠিত হইবে, তাহারই আয়োজন হইতেছে। আমার তাহা দেখিবার অধিকার নাই। উৎসবঘণ্টা এবং জঁমক বর্ধিত করিবার জন্য, বড় বড় সুলক্ষণ হস্তী ('তন্মধ্যে একটির বয়স শতবর্ষ) রথের নিকট আনা হইয়াছে; উহারা জরির সাজে সুসজ্জিত হইয়া চন্দ্রালোকে শরীর দুলাইতেছে—মনে হইতেছে যেন প্রকাণ্ড কতকগুলা কাদার ঢিবি। এই ঘোর নিশাকালেও বৃহৎ ছত্র সকল উদঘাটিত হইয়াছে—ছত্রের প্রান্তদেশে তাবার চাকতি। অষ্টাদশবর্ষীয় এক দল ব্রাহ্মণযুবক ত্রিশূলের অনুকরণে-নির্মিত ত্রিশাখা-বিশিষ্ট কতকগুলা মশাল সইয়া উপস্থিত হইল।

 এইক্ষণে যে রহস্যব্যাপারটি অনুষ্ঠিত হইবে, তাহা এই —ইতরসাধারণের অর্শনীয় সেই পবিত্র সাঙ্কেতিক বিগ্রহটিকে—রাগমের সেই অনন্যসাধারণ প্রকৃত বিষ্ণুমূর্তিটিকে আজ মন্দিরের পশ্চাদ্ভাগে—সর্ব্বাপেক্ষা পবিত্র যে স্থান—সেই নির্দিষ্ট স্থানে লইয়া যাওয়া হইবে। এই বিগ্রহটি বিশুদ্ধ স্বর্ণে গঠিত,—পঞ্চশায় ভুজঙ্গের উপর শয়ন। রথের সম্মুখে একটি মঞ্চের উপর প্রাচীন ধবণের একটি মন্দিরাকার গৃহের অভ্যন্তরে স্থাপিত হইবে; গৃহটি এই উদ্দেশ্যেই বিশেষরূপে নির্ম্মিত; বিগ্রহের পাদদেশে দীপমালা জলিবে, এবং পুরোহিতেরা সমস্ত রাত্রি জাগিয়া বসিয়া থাকিবে। তাহার পর কল্য প্রভাতে, যাত্রোৎসবের সময়ে, বিগ্রহটিকে ঐ মন্দির-গৃহের একটা জলার ভিতর দিয়া বাহির করিয়া রথের উপর মন্দির-চূড়ার ন্যায় একটা চন্দ্রাতপের নীচে-বসান হইবে। বিগ্রহটি উহার ভিতর প্রচ্ছন্ন থাকিবে। পূর্ব্বোক্ত মন্দিরগৃহে ফিরিবার সময় যতবার এই শ্রীরাগমের বিষ্ণুমূর্ত্তি বীথিটি পার হইবে,—বলা বাহুল্য, ততবারই উহাকে কাপড় দিয়া খুব ঢাকিয়া লইয়া যাইতে হইবে। কাপড় দিয়া ঢাকা হউক, বা না হউক, সে একই কথা; কেন না, যাহাতে অদীক্ষিত ব্যক্তিগণ বিগ্রহটিকে দেখিতে পায়, এই জন্য উহাকে রাত্রিতেই গৃহান্তরিত করা হইয়া থাকে। কিন্তু এ বৎসর, পূর্ণিমা তিথিতে উৎসবের দিনটা পড়ায়, লোকেরা আমাকে দূরে সরিয়া যাইতে বলিল; কারণ আমিই এখানে একমাত্র বিধর্ম্মী; আর বাস্তবিকই রাত্রিটা খুব পরিষ্কার।

 তখন আমি, অন্য ব্রাহ্মণ পথিকদিগের ন্যায়, মন্দিরের অভ্যন্তরেই (যে প্রস্তরময় গলির উপর দিয়া রথ চলিবে, তাহা হইতে অবশ্য বহুদূরে) শয়ন করিয়া সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। চারি দিক ঘোর নিস্তব্ধ; সেখানকার শৈত্য প্রায় যেন গোরস্থানের ন্যায় স্থিতিশীল। মধ্যে মধ্যে, নিঃশব্দ পদক্ষেপে লোকেরা নগ্নপদে অতি সাবধানে মন্দিরের সানের উপর যাতায়াত করিতেছে। প্রার্থনা মন্ত্রাদির অস্ফুট গুঞ্জন শুনিতে শুনিতে মন্দিরের সেই শব্দযনি খিলানমণ্ডলের নীচে আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম। * * *