বিষয়বস্তুতে চলুন

নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/তৃতীয় অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় অধ্যায়

বিদ্যার্জ্জনে কঠিন প্রয়াস

 কয়লার খাদে কাজ করিতেছি, এমন সময়ে একদিন দুইজন কুলীর কথাবার্ত্তা শুনিতে পাইলাম। ইঙ্গিতে বুঝিলাম ভার্জ্জিনিয়া প্রদেশের কোন স্থানে একটা বড় রকমের নিগ্রোবিদ্যালয় আছে। আমার নিজের পল্লীর পাঠশালা অপেক্ষা বড় স্কুল-কলেজের কথা ইহার পূর্ব্বে আর শুনি নাই।

 আমার আগ্রহ বাড়িল। খনির অন্ধকারের মধ্যে চুপি চুপি হামাগুড়ি দিয়া লোক দুইটির নিকটবর্ত্তী হইলাম। তাহারা বলাবলি করিতেছে যে, ভার্জ্জিনিয়ার ঐ বিদ্যালয়টি নিগ্রোদের জাতীয় বিদ্যালয়। নিগ্রো ছাড়া আর কেহ ঐ বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হইতে পায় না। গরিব নিগ্রো সন্তানদের জন্য বিশেষ সুবিধাও আছে। যাহারা বাপ-মার নিকট হইতে টাকাপয়সা আনিতে অসমর্থ, তাহারাও লেখাপড়া শিখিবার সুযোগ পায়। এরূপ নির্ধন ছাত্রেরা খাটিয়া পয়সা রোজগার করে। পরিশ্রম করিতে পারিলে যে কোন বালকই যথেষ্ট উপার্জ্জন করিয়া নিজের ভরণ-পোষণের খরচ নিজেই জোগাইতে পারে। বিদ্যালয়ের কর্ত্তারা এজন্য একটা নূতন কৌশল অবলম্বন করিয়াছেন। তাহা ছাড়া তাঁহারা সকল ছাত্রকে অন্যান্য বিষয় শিখাইবার সঙ্গেসঙ্গেই দুটা একটা কৃষি-শিল্পকর্ম্ম বা ব্যবসায়ও শিখাইয়া থাকেন। এই সুযোগেও ছাত্রেরা নিজের খরচ নিজেই চালাইয়া লয়। অধিকন্তু ভবিষ্যতের জন্যও তাহাদের অন্ন-সংস্থানের উপায় জানা হইয়া থাকে।

 এই বিদ্যালয়ের নাম “শিক্ষক ও শিল্পবিদ্যালয়”। ভার্জ্জিনিয়ার হ্যাম্পটন নগরে ইহা অবস্থিত।

 আমি তৎক্ষণাৎ স্থির করিলাম আমি ঐ পাঠশালায় ভর্ত্তি হইব। আমার পক্ষে উহা অপেক্ষা সুবিধার স্থান আর কি হইতে পারে? নিজে খরচ চালাইয়া লইব। সুতরাং অভিভাবকের আপত্তি থাকিবে কেন?

 আমি হ্যাম্পটনের নাম জপিতে লাগিলাম। হ্যাম্পটন কোথায়, আমার ম্যান্‌ডেন হইতে কোন্ দিকে বা কতদূর আমি কিছুই জানি না। দিবারাত্রি শুধু সেই বিদ্যালয়ের ধ্যান করিতে লাগিলাম। আমার মনে আর কোন চিন্তা আসিল না।

 কয়লার খনিতে আরও কিছুকাল কাজ করিলাম। এই সময়ে একটা নূতন চাকরীর সন্ধান পাইলাম। আমাদের এই খনি এবং নুনের কল একজনেরই সম্পত্তি ছিল, তাঁহার নাম জেনারেল লুইস্ রাফ্‌নার। রাফ্‌নারপত্নী বড় কড়া মেজাজের মনিব ছিলেন। তাঁহার চাকর কেহই টিকিত না। দুই তিন সপ্তাহের মধ্যেই সকলে পলাইয়া আসিত। দেখিলাম কয়লার খনিতে কাজ করা অপেক্ষা একটা পরিবারের চাকর হওয়া শতগুণে ভাল। আমি চেষ্টা করিয়া ১৫ টাকা মাসিক বেতনে রাফ্‌নার-পত্নীর ভৃত্য নিযুক্ত হইলাম।

 রাফ্‌নার-পত্নীর নিকটে যাইতে প্রথম প্রথম আমার বড় ভয় হইত, আমি কাঁপিতে থাকিতাম। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মনিবের ‘রাশ’ বুঝিয়া লইলাম। তাঁহার বাপের বাড়ী ছিল যুক্তরাজ্যের সর্ব্ববিখ্যাত বিভাগ নিউইংলণ্ড প্রদেশে। সে অঞ্চলের লোকদিগকে “ইয়াঙ্কি” বলে। ইয়াঙ্কিরা আমেরিকার কিছু “চালে” চলেন। তাহাদের দেখিয়া শুনিয়াই যুক্তরাজ্যের অন্যান্য বিভাগের লোকেরা কায়দা-কানুন, চাল-ফ্যাশন ইত্যাদি শিখিয়া থাকেন। কাজেই ইঁহাদের মন জোগাইয়া কাজ করা যে-সে চাকরের সাধ্য নয়। রাফ্‌নার-পত্নী সকল বিষয়ে পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা ভাল বাসিতেন। সময়-নিষ্ঠাও তাঁহার একটা বড় গুণ ছিল, তাঁহার লোকজনের মধ্যে এই গুণের অভাব দেখিলে তিনি চটিয়া যাইতেন। বাড়ী-ঘর, টেবিল-চেয়ার, থালাবাটী সবই ঝাড়া-পুছা ফিট-ফাট চাই। তাঁহার নিকট পান হইতে চূণ খসিবার জো নাই। অধিকন্তু কুঁড়েমি এবং ফাঁকি দিবার প্রবৃত্তিও তিনি দেখিতে পারিতেন না। কাজেই নিয়মিতরূপে যখনকার যাহা কর্ত্তব্য ঠিক তাহা করিলে দাসদাসীরা তাঁহার আদর পাইত।

 তাঁহার নিকট আমি প্রায় দেড় বৎসর চাকরী করিলাম। এই মনিবের পরিবারে থাকিয়া আমার খুব উপকার হইয়াছে। এখানে যেরূপ শিক্ষা পাইয়াছি, তাহা অন্যান্য স্থানের শিক্ষা অপেক্ষা কোন অংশেই হীন নয়। এখানে চাকরী করিতে করিতেই অনেক দিকে আমার চরিত্র গঠিত হইয়াছে। আমি আজ কাল পল্লী বা সহরের কোনস্থানে ময়লা জমা দেখিলে তৎক্ষণাৎ নিজ হাতে পরিষ্কার করিয়া ফেলি। ঘরের কোন কোণে ছেঁড়া কাগজ বা ন্যাক্‌ড়া থাকিলে তাহা আমার নিকট বিষবৎ বোধ হয়। ঘরের বা বাড়ীর বেড়া নড়িয়া বা ভাঙ্গিয়া গেলে তাহা মেরামত করিবার জন্য এক মুহূর্ত্তও বিলম্ব করি না। কাপড় জামা ইত্যাদি পরিষ্কার করিতে আমি সর্ব্বদাই মনোযোগী। এই সকল সদ্‌গুণ আমি রাফ্‌নার-পত্নীর নিকট চাকরী করিয়াই লাভ করিয়াছি। সকল বিষয়ে শৃঙ্খলা-জ্ঞান, স্বাস্থ্যরক্ষার নিয়মপালন, এবং যখনকার যা ঠিক তখন তাহা করা এবং নানা সদভ্যাস এই পরিবারেই অর্জ্জিত হইয়াছে। এই চাকরীই আমার কিয়ৎকালের জন্য শিক্ষালয়, শিক্ষাদাতা এবং গ্রন্থপাঠস্বরূপ ছিল এরূপ বলিলে অন্যায় হইবে কি?

 রাফ্‌নার-পত্নী আমার কাজ-কর্ম্ম দেখিয়া আমায় ভাল বাসিতে লাগিলেন। এমন কি, দিবাভাগের বিদ্যালয়ে যাইবার সুযোগও আমি পাইলাম। এতদিন কেবল নৈশবিদ্যালয়েই পড়িতেছিলাম। রাফ্‌নার-পত্নীর কৃপায় এক ঘণ্টা করিয়া দিনের স্কুলেও যাইতে থাকিলাম। তিনি আমার রাত্রের পড়ায়ও যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন। তাঁহার বাড়ীতে থাকিতে থাকিতেই আমি একটা কেরোসিনের বাক্‌স আনিয়া নিজ হাতে আলমারী তৈয়ারী করিয়াছিলাম। তাহার মধ্যে দুই তিনটা থাক করিয়া লইলাম এবং এখান ওখান হইতে কতকগুলি খাতা পত্র, পুঁথি-পুস্তক সংগ্রহ করিয়া তাহাতে সাজাইয়া রাখিলাম। উহাই আমার প্রথম লাইব্রেরী বা “গ্রন্থশালা”!

 সুতরাং রাফ্‌নার পরিবারে আমার দিন সুখেই কাটিতে লাগিল। আমি কিন্তু হ্যাম্পটনকে ভুলি নাই। আমার মাতা অতদূরে কোন্ অজানা স্থানে যাইব শুনিয়া ভাবিয়া আকুল হইলেন। শেষ পর্য্যন্ত যাওয়াই স্থির হইল। হাতে এক পয়সাও নাই। এত দিন আমি ও আমার দাদা যাহা কিছু রোজগার করিয়াছি, সবই গৃহস্থালীতে খরচ হইয়া গিয়াছে—এবং আমার অভিভাবক উড়াইয়াছেন। যাহা হউক, কোন উপায়ে যাইবই যাইব।

 ভগবান্ সহায় হইলেন। দেখিলাম আমার পল্লীর নিগ্রোরা এই সংবাদে সকলেই আন্তরিক সুখী। তাঁহারা আমাকে আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন “নিগ্রোজাতির মুখ উজ্জ্বল কর।” তাঁহাদের আনন্দের বিশেষ কারণ ছিল। তাঁহাদের চির জীবন গোলামীতে কাটিয়াছে। কখন সুদিন আসিবে ইহা তাঁহারা স্বপ্নেও ভাবিতে পারেন নাই। অথচ কেহ বৃদ্ধ বয়সে কেহ বা প্রবীণ বয়সে একে একে নবযুগের নূতন নূতন লক্ষণগুলি দেখিতে পাইলেন। তাঁহারা স্বাধীনতা পাইয়াছেন—তাঁহাদের গ্রামে একটা জাতীয় বিদ্যালয় পর্য্যন্ত খোলা হইয়াছে। কেবল তাহাই নহে, আজ তাঁহাদের এক সন্তান ঘর বাড়ী ছাড়িয়া একটা মহাবিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখিতে চলিল। আজ গ্রামের এক শিশু পরিবারের স্নেহ হইতে দূরে থাকিয়া একটা উচ্চশ্রেণীর পাঠশালায় বিদ্যার্জ্জন করিতে প্রয়াসী। তাঁহাদের পক্ষে ইহা একটা সত্যযুগ বৈ কি? কাজেই কেহ আমাকে একটা রুমাল, কেহ বা একটা ডবল পয়সা, ইত্যাদি উপহার দিতে লাগিলেন।

 আমি যাত্রা করিলাম। মাতাকে অত্যন্ত অসুস্থ ও রুগ্ন অবস্থায় দেখিয়াই যাইতে হইল। সঙ্গে একটা থলে। তাহার মধ্যে কাপড় চোপড় ভরিয়া লইলাম। তখন ওয়েষ্ট ভার্জ্জিনিয়া হইতে ভার্জ্জিনিয়ায় যাইবার রাস্তায় খানিকটা রেলপথ ছিল। অবশিষ্ট রাস্তা ভাড়াগাড়ী করিয়া যাইতে হয়।

 ম্যাল্‌ডেন হইতে হ্যাম্পটন ৫০০ মাইল। অতদূর যাইবার পথ-খরচ আমার নাই। একদিন পাহাড়ের রাস্তায় ভাড়াগাড়িতে করিয়া যাইতেছিলাম। সন্ধ্যার পর গাড়ী একটা সাদা বাড়ীর নিকট থামিল। বুঝিলাম এটা হোটেল, আমার সহযাত্রীরা সকলেই শ্বেতকায়, আমিই একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রো। তাঁহারা সকলেই একে একে নামিয়া এক একটা কামরা দখল করিয়া বসিলেন। হোটেলের কর্ত্তা তাঁহাদের জন্য আয়োজন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের আহারের ব্যবস্থা হইতেছে এমন সময়ে ভয়ে ভয়ে আমি হোটেলের কর্ত্তার নিকট উপস্থিত হইলাম। আমার হাতে এক আধ্‌লাও ছিল না। ভাবিয়াছিলাম গৃহস্বামীর নিকট ভিক্ষা করিয়া রাত কাটাইয়া দিব। সেই সময়ে ভার্জ্জিনিয়ার পার্ব্বত্য প্রদেশে হাড়ভাঙ্গা শীত। ভাবিয়াছিলাম নিশ্চয়ই হোটেলের এক কোণে আশ্রয় পাইব। কিন্তু আমার কাল চাম্‌ড়া দেখিবামাত্রই আমার প্রতি কঠোর আদেশ হইয়া গেল—“তোমার এখানে ঠাঁই নাই।” পয়সার অভাবই আমেরিকায় একমাত্র কষ্ট নয়। সাদা চামড়ার অভাবও বড় বিষম পাপ—এই ধারণা সেই রাত্রে আমার প্রথম জন্মিল।

 সারারাত্রি সেই হোটেলের সম্মুখে হাঁটিয়া গা গরম রাখিলাম। গৃহস্বামীর দুর্ব্ব্যবহারে আমি কিছুমাত্র বিচলিত হই নাই। হ্যাম্পটনের স্বপ্নই আমার সমস্ত হৃদয় ভরিয়া রাখিয়াছিল।

 পথের কষ্ট আরও অসংখ্য প্রকার ভুগিয়াছিলাম। খানিকটা পদব্রজে চলিয়া, খানিকটা গাড়ীওয়ালার হাতে পায়ে ধরিয়া বিনা পয়সায় গাড়িতে চড়িয়া, খানিকটা সহযাত্রীদের নিকট পয়সা ভিক্ষা করিয়া, শেষ পর্য্যন্ত ভার্জ্জিনিয়া প্রদেশের একটা সহরে পৌঁছিলাম। তাহার নাম রিচ্‌মণ্ড, এখান হইতে আমার গন্তব্যস্থান আরও ৮২ মাইল।

 রিচ্‌মণ্ডে পৌঁছিতে বেশী রাত্রি হইয়া গিয়াছিল। হাতে পয়সা নাই—তাহার উপর ছেঁড়া ময়লা পোষাক ও কাল রং। ক্ষুধায় পেট জ্বলিতেছে। কত গৃহস্থের বাড়ীতে স্থান পাইবার জন্য ভিক্ষা করিলাম। কেহই একটা ভালকথাও বলিল না। সকলেই পয়সা চায়। পয়সা দিলে তাঁহাদের বাড়ীতে শয়নভোজনের ব্যবস্থা হইতে পারে। শ্বেতাঙ্গ গৃহস্থেরা এইরূপেই অতিথিসৎকার করিয়া থাকেন! আমি নিরুপায় হইয়া রাস্তায় হাঁটিতে লাগিলাম। হাঁটিতে হাঁটিতে রুটি মাংসের দোকানে কত খাদ্যদ্রব্য সাজান রহিয়াছে দেখিতে পাইলাম। তাহা হইতে একটুকু পাইলেই আমি কৃতকৃতার্থ হইতাম। ভাবিতেছিলাম যদি এক টুকরা মাংসও আজ উহারা আমাকে ধার দেয়, তাহা হইলে ভবিষ্যতে চিরজীবন আমি যাহা কিছু উপার্জ্জন করিব সমস্তই উহাদিগকে মূল্য-স্বরূপ দিব প্রতিজ্ঞা করিতে পারি। কিন্তু আমার প্রতি কাহারও দয়া হইল না। একটা আলু বা এক টুকরা মাংস কেহই আমাকে দিল না। আমি অনাহারে কাটাইলাম।

 রিচ্‌মণ্ডের প্রথম রজনীতে আমার এই অভিজ্ঞতা। আমি ক্ষুধার্ত্ত, দুর্ব্বল ও অবসন্ন ভাবে রাস্তায় ঘুরিতে ফিরিতে থাকিলাম। কিন্তু তথাপি হতাশ হই নাই—জীবনের ধ্রুব-তারাকে ভুলি নাই—হ্যাম্পটনে বিদ্যার্জ্জনের সঙ্কল্প ত্যাগ করি নাই। তার পর যখন আর পায়ে হাঁটা অসম্ভব বোধ হইল, তখন রাস্তার পার্শ্বে একটা কাঠের বড় তক্‌তার নীচে শুইয়া পড়িলাম। কোন লোক দেখিতে পাইল না। সেই রাত্রিতে কত লোক তক্তার উপর দিয়া চলাফেরা করিল। আমি মাটিতে শরীর রাখিয়া থলেটাকে বালিশ করিয়া হ্যাম্পটনের নাম জপিলাম। সকালে উঠিয়া দেখি, আমি একটা জাহাজের নিকটে রহিয়াছি। অসহ্য ক্ষুধার জ্বালা। জাহাজের কাপ্তেনের নিকট কিছু প্রার্থনা করিলাম। তাঁহার অনুমতিক্রমে জাহাজ হইতে মাল নামাইতে লাগিলাম। তারপর যথাসময়ে মজুরির মূল্য পাইয়া খাবার খাইতে বসিলাম। ওরূপ সুখের খাওয়া বোধ হয় আর কখনও আমি খাই নাই।

 কাপ্তেন সাহেব আমার প্রথম কাজেই প্রীত হইয়াছিলেন। তিনি আমাকে আরও কাজ দিতে চাহিলেন। আমি রাজী হইলাম। যে মূল্য পাইতাম তাহা দিয়া দৈনিক আহারের খরচ চলিত—কিন্তু ঘরভাড়া কুলাইত না। কাজেই অল্প খাইয়া থাকিতাম—এবং রাত্রে আসিয়া সেই কাঠের তলায় মাটির উপরে শুইয়া থাকিতাম। এই উপায়ে কিছু পয়সা বাঁচিল। তাহার দ্বারা রিচ্‌মণ্ড হইতে হ্যাম্পটনে যাইবার খরচ সংগ্রহ করিলাম।

 এই ঘটনার বহুকাল পরে রিচ্‌মণ্ডের নিগ্রো-অধিবাসিগণ আমাকে নিমন্ত্রণ করিয়া সম্বর্দ্ধনা করিয়াছে। সম্বর্দ্ধনা-উৎসবে অন্ততঃ দুই হাজার কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ ও রমণী যোগদান করিয়াছিল। ঘটনাচক্রে সেই কাঠের তক্তার সমীপবর্ত্তী এক গৃহে এই অভ্যর্থনা ও সাদরসম্ভাষণাদি নিষ্পন্ন হয়। সকলে অতি আন্তরিকতার সহিতই আমাকে অভিবাদন করিলেন। কিন্তু এই আনন্দের দিনে আমি সম্বর্দ্ধনা অভিবাদন প্রভৃতিতে একেবারেই যোগ দিতে পারি নাই। আমি আমার রিচমণ্ডে প্রথম পদার্পণের কথাই মনে করিতেছিলাম। সেই রজনীর অভিজ্ঞতাই আমার চিত্তে অন্যান্য সকল চিন্তার স্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছিল। আমি সেই রাস্তার পার্শ্বের কাঠের তক্তা এক মুহূর্ত্তের জন্যও ভুলিয়া থাকিতে পারিলাম না।

 কাপ্তেন মহাশয়কে যথেষ্ট ধন্যবাদ দিয়া আমি আমার তীর্থযাত্রায় আবার বাহির হইলাম। হ্যাম্পটনে পৌঁছিবার পথে এবার কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে নাই, পৌঁছিবার সময় হাতে ১॥৴০ পুঁজি থাকিল।

 বিদ্যামন্দিরের বহির্ভাগ দেখিয়াই আমি রোমাঞ্চিত হইলাম। বড় বাড়ী যেন রাজ প্রাসাদ। বিদ্যালয়ের এই ত্রিতল ইষ্টক নির্ম্মিত গৃহ আমার হৃদয়ে একটা নব জগতের বার্ত্তা আনিয়া দিল। ধনি-সমাজ, আপনারা যদি একবার বুঝিতে পারিতেন যে, নূতন শিক্ষার্থীর চিত্তে বিদ্যালয়-গৃহের দৃশ্য কি অপরূপ ভাবলহরী সৃষ্টি করে, তাহা হইলে আপনারা বোধ হয় আপনাদের সর্ব্বস্ব উৎসর্গ করিয়া দেশের বিদ্যামন্দিরগুলিকে নানা উপায়ে সুন্দর সুশ্রী ও অলঙ্কৃত করিতে প্রবৃত্ত হইতেন। আপনারা শিশুহৃদয়ের কোমল চিন্তাগুলি কখনও কল্পনা করিয়া দেখিয়াছেন কি? নবশিক্ষার্থীর অন্তরের কথা বুঝিতে চেষ্টা করিয়াছেন কি? আমি হ্যাম্পটনের বিদ্যালয় গৃহটি দেখিয়া নূতন জীবন লাভ করিলাম—সবই যেন নূতন বোধ হইতে লাগিল—আমার চোখ একটা নূতন দৃষ্টি-শক্তি পাইল। জগতের সকল পদার্থই এক নবভাবে আমার নিকট দেখা দিল—আমি সত্যসত্যই সেই চিরবাঞ্ছিত স্বর্গ-রাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছি।

 আমি বাহিরে কাল বিলম্ব না করিয়া বিদ্যালয়ের কর্ত্তৃপক্ষের নিকট হাজির হইলাম। প্রধান শিক্ষয়িত্রী আমার বেশভূষা ইত্যাদি দেখিয়া তাঁহাদের যোগ্য ছাত্র বিবেচনা করিলেন বলিয়া রোধ হইল না। বোধ হয় বুঝিয়াছিলেন—এ একটা সঙ্, ছেলে খেলা করিতে আসিয়াছে। অবশ্য একবারে তাড়াইয়াও দিলেন না। আমি তাঁহার আশে পাশে ঘুরিতে লাগিলাম। নানাভাবে আমার যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা এবং শিখিবার আকাঙ্ক্ষার পরিচয় দিতে চেষ্টা করিলাম। ইতিমধ্যে কত নূতন নূতন ছাত্র আসিয়া ভর্ত্তি হইল। আমার মনে হইতে লাগিল—আমাকে ভর্ত্তি করিলে ইহাদের কাহারও অপেক্ষা আমি নিন্দনীয় ফল দেখাইব না।

 কয়েক ঘণ্টা পর শিক্ষয়িত্রী আমার উপর সদয় হইলেন। তিনি বলিলেন, “ওখানে ঝাঁটা আছে, ওটা লইয়া পার্শ্বের ঘরটা ঝাড় দাও ত।”

 আমি বুঝিলাম—ইহাই আমার পরীক্ষা। রাফ্‌নার-পত্নীর গৃহে আমি যে শিক্ষা পাইয়াছি এইবার তাহার যাচাই হইতেছে। ভাল কথা—আমি মহা আনন্দে ঘর পরিষ্কার করিতে গেলাম।

 ঘরটা একবার দুইবার তিনবার ঝাড়িলাম। একটা ন্যাকড়ার ঝাড়ন ছিল—তাহা হইতে ধূলিরাশি বাহির করিয়া ফেলিলাম। দেওয়ালের আশে পাশে অলি গলিতে যেখানে যে টুকু ময়লা জমিয়াছিল সমস্তই পরিষ্কার করিলাম। বেঞ্চ, টেবিল, চেয়ার, ডেস্ক ইত্যাদি কাঠের সমস্ত আস্‌বাবই ঝাড়িয়া চক্‌চকে করিয়া রাখিলাম। শিক্ষয়িত্রীকে জানাইলাম ঝাড়া হইয়াছে। তিনিও ‘ইয়াঙ্কি’রমণী। তিনি খুঁটিনাটি সর্ব্বত্রই তন্ন তন্ন করিয়া দেখিলেন। টেবিলের উপর আঙ্গুল দিয়া বুঝিলেন ময়লা কিছুই নাই। নিজের রুমাল বাহির করিয়া পরীক্ষা করিলেন—চেয়ারের কোণ হইতেও কিছু ধূলা বাহির হয় কি না। পরে আমার দিকে তাকাইয়া বলিলেন, “দেখিতেছি, ছোকরা বেশ কাজের।” আমি ‘পাশ’ হইলাম।

 বোধ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করিবার সময়েও কোন বালককে এত কঠিন পরীক্ষা দিতে হয় না। হার্ভার্ড ও ইয়েল বিশ্ব-বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হইতে হইলে শুনিয়াছি ছাত্রদের যথেষ্ট, ‘বেগ’ পাইতে হয়। যাহারা ‘প্রবেশিকা’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া হার্ভার্ড ও ইয়েলের কলেজে লেখাপড়া শিখিবার জন্য সার্টিফিকেট পায়, তাহারা বোধ হয় আমার এই দিনের আনন্দ কিছু কিছু অনুমান করিতে পারিবে। আমিও পরে অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছি। কিন্তু এই পরীক্ষার উপরই আমার ভাগ্য নির্ভর করিতেছিল। ইহার ফলেই আমার জীবনের গতি নির্দ্ধারিত হইল। এরূপ অগ্নিপরীক্ষায় আর আমি কখনও পড়ি নাই।

 হ্যাম্পটনের প্রধান শিক্ষয়িত্রী, আমার পরীক্ষাকর্ত্রীর নাম ছিল কুমারী মেরী এফ্ ম্যাকি। আমাকে নিজের খরচ নিজেই চালাইতে হইবে শুনিয়া তিনি আমাকে বিদ্যালয়ের একটা খান্সামার কাজ করিতে দিলেন। আমাকে ঘরগুলি দেখিতে শুনিতে হইত, খুব সকালে উঠিয়া বাড়ীর আগুন জ্বালিয়া দিতে হইত। উনন ধরাইয়া দিতে হইত। খাটুনী যথেষ্ট ছিল, কিন্তু ইহাতে আমার ভরণপোষণের প্রায় সমস্ত খরচই পাইতাম।

 হ্যাম্পটন বিদ্যালয়ের বহির্দৃশ্য পূর্ব্বে বর্ণনা করিয়াছি। এক্ষণে ভিতরকার কথা কিছু বলি। মিস্ ম্যাকি আমার জননীর ন্যায় স্নেহশীলা ছিলেন। তাঁহার সাহায্যে ও উৎসাহে আমি সেখানে অনেক উপকার পাইয়াছি। তাঁহাকে আমার জীবনের অন্যতম গঠনকর্ত্রী বিবেচনা করিয়া থাকি।

 একজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষের পরিচয় আমি এখানে পাই। তখন হইতে তিনি আমার হৃদয়-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইয়া আছেন। তাঁহার চরিত্রই আমার জীবনের উজ্জ্বলতম আদর্শস্বরূপ রহিয়াছে। তাঁহার দৃষ্টান্ত সম্মুখে রাখিয়াই আমি কর্ম্মক্ষেত্রে সাহসভরে বিচরণ করিতেছি। সেই উদারস্বভাব বৃহৎপ্রাণ পরোপকারী মহাপুরুষের নাম সেনাপতি স্যামুয়েল সি আর্মষ্ট্রঙ্গ।

 সৌভাগ্যক্রমে আমি ইউরোপ ও আমেরিকার বহু বিখ্যাত লোকের সংস্পর্শে আসিয়াছি। খাঁটি বড় লোক এবং তথাকথিত বড় লোক উভয় প্রকার নামজাদা লোকই আমি অনেক দেখিয়াছি। কিন্তু আমি আজ মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি, সেনাপতি আর্মষ্ট্রঙ্গের ন্যায় চরিত্রবান্ ধর্ম্মভীরু মানবসেবক একজনও দেখি নাই। তিনিই আমার চিন্তারাজ্যের ‘একমেবাদ্বিতীয়ং’ মহাবীর, তাঁহাকে দেখিয়াই ত্যাগাবতার বৈরাগ্যাবতার প্রেমাবতার যীশুখৃষ্ট ও সাধু মহাত্মাদের পরিচয় কিছু কিছু পাইয়াছি বলিতে পারি। সেনাপতি আর্মষ্ট্রঙ্গকে আমি মূর্ত্তিমান ত্যাগধর্ম্মরূপে পূজা করিতাম।

 গোলামাবাদের ঘৃণ্য জীবন এবং কয়লার খাদের দুঃখদারিদ্র্য ভোগ করিবার পরক্ষণেই এই মহা-পুরুষের সাক্ষাৎলাভ করিলাম। বহু পুণ্যফলেই আমার এরূপ ঘটিয়াছিল। যেই আমি তাঁহাকে প্রথম দেখিলাম তখনই আমার মনে হইল যে, ইনি একজন আদর্শ মানব। তখনই যেন বুঝিতে পারিলাম ইঁহার ভিতর অলৌকিক, অনন্যসাধারণ বীরসুলভ শক্তি রহিয়াছে। সেই প্রথম দর্শন হইতে সেনাপতি আর্মষ্ট্রঙ্গকে আমি অনেকবার নানা ভাবে, আপনার জন ভাবে, বন্ধুভাবে দেখিবার অবসর পাইয়াছি। তাঁহার মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত তাঁহাকে আমি আত্মীয় বিবেচনা করিবার সুযোগ পাইয়াছি। ক্রমশ‍ই তিনি আমার জ্ঞানে মহৎ হইতে মহত্তররূপে অধিকতর শ্রদ্ধা, ভক্তি ও পূজার পাত্র হইয়াছিলেন।

 যতই আমার বয়স বাড়িতেছে ততই আমি বিবেচনা করিতেছি যে, ‘মানুষ’ গড়িবার জন্য গ্রন্থপাঠের ব্যবস্থা করিবার আবশ্যকতা বেশী নাই। পুঁথি-কেতাব, খাতা-পত্র, লাইব্রেরী, কল-কব্জা, ল্যাবরেটরী ইত্যাদি সাজ-সরঞ্জাম—এ সব হইতে ছাত্রেরা বেশী কিছু শিখিতে পায় না। এই নির্জ্জীব পদার্থগুলি মানুষের মনুষ্যত্ব গজাইয়া দিতে, বিশেষ সমর্থ নয়। আমি হ্যাম্পটনে থাকিবার কালে ভাবিতাম যে, এই বিদ্যালয় হইতে বাড়ী-ঘর, হাতিয়ার-যন্ত্র, খাতা-পত্র, ইট-কাঠ, বেঞ্চ-টেবিল, ইত্যাদি সবই যদি সরাইয়া লওয়া হয়, তাহা হইলেও বিদ্যালয়ের কিছু মাত্র অঙ্গহানি হইবে না। কারণ এই বিদ্যালয়ের প্রাণদাতা, এই বিদ্যালয়ের প্রাণ-প্রতিষ্ঠাতা, এই বিদ্যালয়ের পিতা স্বরূপ পরিচালক, আর্মষ্ট্রঙ্গ মহোদয় একাকীই এই সমুদয় সাজসরঞ্জাম অপেক্ষা মূল্যবান্। তাঁহার নিকট নিগ্রো বালকেরা একবার করিয়া রোজ আসিতে পারিলেই তাহাদের সর্ব্বোচ্চ শিক্ষালাভের মুফল ফলিবে। আজও আমি সেই কথা বলিতেছি, প্রকৃত চরিত্রবান সমাজসেবক শিক্ষাপ্রচারকের সঙ্গে সহবাস করিতে পাইলে যতখানি চরিত্র গঠিত হয়, মনের তেজ বাড়িতে থাকে, চিত্তের শক্তি বিকশিত হয়, কর্ম্মক্ষমতার উন্মেষ হয়, সৌজন্য-শিষ্টাচার অর্জ্জিত হয়, অন্য কোন উপায়ে তাহা হইতে পারে না। আমাদের তথাকথিত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হইতে গ্রন্থ-পাঠের আড়ম্বর কমিয়া যাইবে না কি? আমাদের শিক্ষা-ক্ষেত্রের কর্ম্মীরা সমগ্র জগতের কাজ-কর্ম্মের মধ্যে রাখিয়া বালক-বালিকাদিগকে মানুষ করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিবেন না কি?

 সেনাপতি আর্মষ্ট্রঙ্গ মৃত্যুর পূর্ব্বে দুইমাস কাল আমার টাস্কেজী বিদ্যালয়ে কাটাইয়াছিলেন। তখন তিনি পক্ষাঘাতে ভুগিতে ছিলেন। সর্ব্বাঙ্গ শিথিল হইয়া গিয়াছিল। তথাপি শেষ মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত তিনি তাঁহার শিক্ষাপ্রচার-ব্রতে লাগিয়াই ছিলেন। কাজের মধ্যে নিজকে ডুবাইয়া ফেলিতে পারে—এরূপ লোক সংসারে বিরল। কিন্তু আর্মষ্ট্রঙ্গ নিজকে সম্পূর্ণ ভুলিতে পারিতেন—আত্মমুখী চিন্তা তাঁহার বিন্দুমাত্র ছিল না। পরসেবাই তাঁহার একমাত্র ধর্ম্ম ছিল। তিনি হ্যাম্পটন বিদ্যালয়ের জন্য এতদিন যাহা করিয়াছেন আমার টাস্কেজী বিদ্যালয়ের জন্যও সেইরূপ খাটিতে লাগিলেন। কেবল তাহাই নহে। আমাদের অঞ্চলে যেখানে যেখানে নিগ্রোসমাজে শিক্ষা-বিস্তারের প্রয়োজন, সেই সকল স্থানের জন্যও তিনি শক্তি প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিলেন। সকল কার্য্যেই তাঁহার সমান আনন্দ। তিনি নিজকে বিসর্জ্জন দিতে শিখিয়াছিলেন—আদর্শের মধ্যে তন্ময় হইতে পারিয়াছিলেন। এজন্য তাঁহার কর্ম্মক্ষেত্রের অভাব হইত না। যখন যেখানে থাকিতেন তখন সেইখানেই তাঁহার আত্মত্যাগী সাধনার কার্য্য চলিতে থাকিত। এখানে আমার কর্ম্মক্ষেত্র, ওটা তোমার কর্ম্মকেন্দ্র, এই আমার গণ্ডী, ঐ পর্য্যন্ত তোমার গণ্ডী—তাঁহার নিঃস্বার্থ চিত্তে এরূপ চিন্তা স্থান পায় নাই। সর্ব্বত্রই তিনি স্বার্থত্যাগের কর্ম্মক্ষেত্র খুঁজিয়া লইতেন।

 সেনাপতি আর্মষ্ট্রঙ্গ নিউ ইংলণ্ড অঞ্চলের অধিবাসী ‘ইয়াঙ্কি’। বিগত সংগ্রামে তিনি এই প্রান্তের পক্ষে দক্ষিণ প্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াছিলেন। সুতরাং অনেকেই মনে করিতে পারেন যে, তিনি হয়ত দক্ষিণ প্রান্তের শ্বেতকায়গণের সম্বন্ধে শত্রুভাব পোষণ করিতেন। আমি বলিতে পারি, তাহা সত্য নয়। তিনি সংগ্রামের পর একদিনও কোন দক্ষিণপ্রান্তবাসী শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি সম্বন্ধে নিন্দা বা তিরস্কারসূচক বাক্য ব্যবহার করেন নাই। বরং যথা সাধ্য তিনি তাহাদের উপকারের জন্য চেষ্টাই করিয়াছেন।

 হ্যাম্পটন বিদ্যালয়ের ছাত্রেরা তাঁহাকে দেবতার মত ভক্তি করিত। আর্মষ্ট্রঙ্গের আরব্ধ কোন কর্ম্ম কৃতকার্য্য হইবে না—এরূপ আমরা ভাবিতেই পারিতাম না। তাঁহার যে কোন আদেশই আমরা পলকের মধ্যে সম্পন্ন করিতে প্রয়াসী হইতাম। তাঁহার আদেশ অনুসারে কাজ করিতে পাইলে আমরা কৃতার্থ বোধ করিতাম। একটা ঘটনার উল্লেখ করিতেছি। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্ব্বে তিনি আমার টাস্কেজী বিদ্যালয়ে অতিথি হইয়া ছিলেন। তখন পক্ষাঘাতে ভুগিতেছিলেন—নাড়িবার ক্ষমতা ছিল না। তাঁহার চেয়ার গড়ান রাস্তা দিয়া একটা পাহাড়ের উপর তোলা হইতেছিল। তাঁহার একটি ভূতপূর্ব্ব ছাত্র তাঁহার চেয়ার টানিয়া তুলিতেছিল। রাস্তা ভাল ছিল না বলিয়া সহজে ঐ কার্য্য সাধিত হয় নাই। অবশেষে যখন পাহাড়ের উপরে উঠা গেল, ছাত্রটি বলিয়া উঠিলেন—“যাহা হউক, আজ আমার সৌভাগ্য, সেনাপতির জন্য মৃত্যুর পূর্ব্বে একটা কঠিন রকমের কাজ করিবার সুযোগ পাইয়াছি।”

 যখন আমি হ্যাম্পটন বিদ্যালয়ে ছিলাম তখন প্রাই নূতন নূতন ছাত্র ভর্ত্তি হইত। আমাদের বড় স্থানাভাব ছিল। ছাত্রাবাসে আর ছাত্র লওয়া চলিত না। বাহিরে তাঁবু খাটাইয়া ঘর তৈয়ারি করিয়া লইতে হইত। সেই সময়ে আর্মষ্ট্রঙ্গ মহোদয় পুরাতন ছাত্রদের নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিতেন, “তোমাদের মধ্যে কেহ রাত্রে তাঁবুতে শুইয়া ঘরের ভিতর নূতন ছাত্রদের জন্য জায়গা করিতে প্রস্তুত আছ কি?” অমনি প্রত্যেক ছাত্রই ঘর ছাড়িয়া দিয়া তাঁবুতে কষ্টে রাত্রি কাটাইবার জন্য অগ্রসর হইত।

 আমিও এইরূপ একজন স্বার্থত্যাগী ‘পুরাতন ছাত্র’ ছিলাম। আমার মনে আছে—অত্যন্ত কঠোর শীতকালে আমাদের কয়েক বার তাঁবুতে রাত্রি কাটাইতে হইয়াছিল। আমাদের যৎপরোনাস্তি কষ্টও হইয়াছিল। সেনাপতি আর্মষ্ট্রঙ্গের আদেশ, সুতরাং আমরা তাহা প্রাণপণে পালন করিবই। আমাদের কষ্টের কথা তাঁহাকে জানাইব কেন? আমরা একসঙ্গে দুইকাজ করিতেছিলাম—কারণ ইহাদ্বারা আর্মষ্ট্রঙ্গকে খুসী করিতাম, এবং নূতন নূতন ছাত্রের শিক্ষালাভের সুযোগ বাড়াইতে পারিতাম। এক এক রাত্রে মহা ঝড় বহিত—তাঁবু উড়িয়া যাইত—আমরা সেই কন্‌কনে শীতের মধ্যে খোলা মাঠে পড়িয়া থাকিতাম। সেনাপতি সকালে আসিয়া দেখিতেন—আমরা হাস্যমুখে প্রফুল্লচিত্তে শীত সহ্য করিতেছি।

 আর্মস্ট্রঙ্গের কথা এত করিয়া বলিবার কারণ আছে। আমি সকলকে জানাইতে চাহি যে, এরূপ চরিত্রবলে বলীয়ান শিক্ষাপ্রচারকগণের প্রয়াসেই আমেরিকার নিগ্রোসমাজে জ্ঞানালোক প্রবেশ করিয়াছে। আর্মষ্ট্রঙ্গের আদর্শে বহু শ্বেতাঙ্গ শিক্ষিত নরনারী কৃষ্ণকায় সমাজে শিক্ষা প্রচারব্রত গ্রহণ করিয়া আমার স্বজাতিকে উন্নতির পথে তুলিয়াছেন। জগতে এই নীরব নিঃস্বার্থ কর্মবীরগণের জীবনচরিত এখনও প্রকাশিত হয় নাই।

 হ্যাম্পটনে প্রতিদিনকার প্রতি কর্ম্মেই, প্রত্যেক উঠা-বসায় আমি একটা নূতন কিছু শিখিতেছিলাম। সেখানকার জীবনযাত্রা-প্রণালী এবং নিত্য কর্ম্ম-পদ্ধতি আমাকে নানা ভাবে শিক্ষিত করিতেছিল। যথাসময়ে নিয়মিতরূপে খাইতে হয়, এখানে আমি তাহা প্রথম উপলব্ধি করিলাম। টেবিলের উপর কাপড় বিছাইয়া তাহার উপর থালা বাটি রাখিতে হয়—ইহাও আমি জীবনে প্রথম শিখিলাম। খাইতে বসিয়া কিরূপ ব্যবহার করিতে হয়, কোন্ খাদ্যের পর কোন্ খাদ্য লওয়া উচিত—ইত্যাদি আরও অনেকানেক বিষয়ে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা জন্মিল। বিছানার উপর চাদর দেওয়াও আমি পূর্ব্বে আর কোন দিন দেখি নাই। এইরূপে দৈনিক জীবন-যাপনের প্রায় সকল কর্ম্মেই হ্যাম্পটনে আমার ‘হাতে খড়ী’ হইল!

 হ্যাম্পটনেই আমি আবার স্নান করিতেও শিখি। স্নান করিলে যে কত উপকার হয়, শরীর ও স্বাস্থ্যের কত উন্নতি হয়, চিত্তের প্রফুল্লতা বাড়িতে থাকে—তাহা আমি পূর্ব্বে বুঝিতাম না। তখন হইতে আমি প্রতিদিন স্নান করিয়া আসিতেছি। মাঝে মাঝে এমন অনেকের বাড়ীতে অতিথি হইতে হইয়াছে, যেখানে স্নান করিবার ব্যবস্থা নাই। আমি সেখানে নিকটবর্ত্তী কোন নদী বা ঝরণায় যাইয়া স্নান করিয়া পরিষ্কার হইয়াছি। নিগ্রোজাতিকে আমি সর্ব্বদাই বলিয়া থাকি, বাড়ী তৈয়ারী করিতে হইলেই স্নানাগারও যেন প্রস্তুত করা হয়।

 হ্যাম্পটনে আমার দুইটি মাত্র গেঞ্জি ছিল—ময়লা হইয়া গেলে আমি রাত্রে সাবান দিয়া কাচিয়া আগুনে শুকাইয়া লইতাম। পরদিন সকালে তাহা ব্যবহার করিতাম।

 হ্যাম্পটন বিদ্যালয়ের বোর্ডিংএ খাওয়া খরচ মাসিক ৩০৲ টাকা। অমি যে খান্সামার কাজে নিযুক্ত হইয়াছিলাম তাহাতে সমস্ত আয় হইত না—সুতরং আমাকে মাসে মাসে নগদ টাকাও কিছু কিছু দিতে হইত। প্রথমে যখন ভর্ত্তি হই, তখন হাতে ১॥৴৹ মাত্র ছিল। আমার দাদা ক্বচিৎ কখনও ২।৪৲ টাকা পাঠাইতেন। কিন্তু তাহাতে আমার খাই খরচের জন্য দেয় টাকা কুলাইত না।

 কাজেই আমি খান্সামাগিরি এত ভাল করিয়া করিতে লাগিলাম যে, শেষে আমি খাইখরচের সমস্ত টাকাই বেতনস্বরূপ পাইতাম। বিদ্যালয়ের বেতন ছিল বার্ষিক ২১০৲ টাকা। এতটাকা আমার সংগ্রহ করা অবশ্যই অসম্ভব ছিল। আর্মষ্ট্রঙ্গ মহোদয় একজন ইয়াঙ্কি বন্ধুকে বলিয়া আমার বেতন দেওয়াইতেন। বন্ধুটির নাম এস্ গ্রিফিথ্‌স্ মরগ্যান্। শ্রীযুক্ত মরগ্যান্ আমার হ্যাম্পটনের পুরাপুরি বেতন দিয়া আসিয়াছেন। আমি পরে যখন টাস্কেজীতে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি—তখন কয়েকবার এই সহৃদয় দাতার সঙ্গে দেখা করিয়া ধন্য হইয়াছি।

 হ্যাম্পটনে পুস্তকাভাব ও বস্ত্রাভাব যথেষ্ট হইল। পুস্তক অবশ্য পরের নিকট ধার করিয়া লইলেই কাজ চলে। এই রূপেই আমার চলিত। কিন্তু পোষাক পাই কোথায়? সে থলের মধ্যে আমার যা কিছু সম্পত্তি তাহাতে ত এখানে চলা অসম্ভব। বিশেষতঃ সেনাপতি মহোদয় কাপড় চোপড়ের উপর বিশেষ দৃষ্টিই রাখিতেন কোন ছাত্রের জামার বুতাম নাই দেখিলে তিনি অসন্তুষ্ট হইতেন। জুতা বেশ কালী বা রং করা না দেখিলে তাঁহার বিরক্তি জন্মিত। কোটে কালীর দাগ থাকিলে কোন ছাত্র তাঁহার নিকট আসিতে ইতস্ততঃ করিত। আমার মাত্র একটি পোষাক। তাহা দ্বারাই খান্সামাগিরি ও ছাত্রগিরি করিতে হইবে। চব্বিশ ঘণ্টা এক পোষাক ব্যবহার করিয়া কি তাহা পরিষ্কার রাখা যায়? আমার অবস্থা দেখিয়া শিক্ষক মহোদয়গণের দয়া হইল। তাঁহারা আমাকে পুরাতন জামা পোষাকের বস্তা হইতে একটা পোষাক দান করিলেন। এই পুরাতন বস্ত্রগুলি যুক্তরাজ্যের ইয়াঙ্কি অঞ্চল হইতে হ্যাম্পটনের দরিদ্র ছাত্রগণের জন্য দানস্বরূপ পাওয়া যাইত। বস্ত্র দানের এইরূপ ব্যবস্থা না থাকিলে আমার মত অসংখ্য বালক বিদ্যালাভে বঞ্চিত হইত সন্দেহ নাই।

 এইবার শয্যার কথা কিছু বলিব। এতদিন ত মাটিতে শুইয়া অথবা ন্যাক্‌ড়ার বস্তায় পড়িয়া রাত্রি কাটাইতে অভ্যাস করিয়াছি। হ্যাম্পটন-বিদ্যালয়ে আসিয়া দেখি—প্রত্যেকের বিছানার উপরে দুই দুইটা করিয়া চাদর বিস্তৃত রহিয়াছে। দুইটা চাদরের সমস্যা আমি কোন মতেই মীমাংসা করিতে পারিলাম না। প্রথম রাত্রিতে আমি দুইটা চাদরের নীচেই শুইলাম। দ্বিতীয় রাত্রে ভুল বুঝিতে পারিয়া—দুইটা চাদরের উপরেই শুইয়া পড়িলাম। আমার ঘরে আরও ছয় জন ছাত্র শুইত। তাহারা আমার দুরবস্থা দেখিয়া বোধ হয় মজা দেখিত এবং মনে মনে হাসিত। কেহই কিছু বলিত না। পরে তাহাদিগকে দেখিতে দেখিতে দুইটা চাদরের সার্থকতা বুঝিলাম। একটা গায়ে দিতে হয়—আর একটা পাতিয়া শুইতে হয়।

 হ্যাম্পটনে বোধ হয় আমার অপেক্ষা ছোট ছেলে আর কেহ ছিল না। অনেক প্রবীণ পুরুষ ও স্ত্রী এখানে লেখাপড়া শিখিত। এই সময়ে এই বিদ্যালয়ে প্রায় চারি শত ছাত্র ও ছাত্রী ছিল। সকলকেই বিদ্যার্জ্জনে মহা উৎসুক দেখিতাম। অনেকেরই শিখিবার বয়স পার হইয়া গিয়াছে—অন্ততঃ বই মুখস্থ করিবার সময় আর তাহাদের ছিল না। তথাপি তাহারা চেষ্টা করিত। তাহাদের অকৃতকার্য্যতায় তাহারা ভ্রূক্ষেপ করিত না। তাহাদের আন্তরিকতার দৃষ্টান্ত বিরল। একে বেশী রয়স—তাহার উপর দারিদ্র্য, তাহার উপর অকৃতকার্য্যতা—তথাপি তাহারা বিচলিত হইত না। এরূপ কর্ম্মযোগ বেশী দেখা যায় কি?

 এত আন্তরিকতা, এত উৎসাহ, এত অধ্যবসায়, এত কঠোর সাধনায় ব্রতী হইবার কারণ ছিল। তাহারা সকলেই স্বজাতিকে এবং স্বপরিবারকে উন্নত করিবার জন্য বদ্ধপরিকর। তাহারা কেহই নিজ জীবনের জন্য ভাবিত না। নিজের কষ্ট, নিজের অক্ষমতা, নিজের অকৃতকার্য্যতা—এ সকল দুর্ব্বলতা ও নৈরাশ্যের কারণ তাহাদের চিত্তে কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারিত না। সর্ব্বদা পরের কথা ভাবিত, ভবিষ্যৎ বংশধরগণের কথা ভাবিত, সমগ্র নিগ্রো সমাজের চিন্তায় বিভোর হইয়া থাকিত। এজন্য লাজ মান ভয় তাহাদিগকে স্পর্শ করিতে পারে নাই।

 আর শ্বেতাঙ্গ শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের কথা কি বলিব? তাঁহারা ত স্বর্গের দেবতাস্বরূপই ছিলেন। তাঁহারা নিগ্রোজাতির জন্য যে ত্যাগস্বীকার ও চরিত্রবল দেখাইয়াছেন, তাহা সভ্যতার ইতিহাস-গ্রন্থে অতি উজ্জ্বল স্থান অধিকার করিয়া থাকিবে। আমার বিশ্বাস, অনতিদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাজ্যের দক্ষিণপ্রান্ত হইতে সেই স্বার্থত্যাগ, পরোপকার, মানবসেবা ও শিক্ষা প্রচারের পূণ্যকাহিনী প্রচারিত হইবে।