নেতাজীর জীবনী ও বাণী/প্রস্তাবনা

উইকিসংকলন থেকে

সুভাষচন্দ্রের জীবনী ও বাণী

 আজ সমস্ত ভারতবাসী কি হিন্দু, কি মুসলমান সকলেই নেতাজী সুভাষচন্দ্রের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছেন। সুভাষচন্দ্রের দেশের প্রতি গভীর ও একনিষ্ঠ ভালবাসা, দেশকে স্বাধীন করিবার উগ্র আকাঙ্ক্ষা, দেশের সেবার জন্য আজীবন অশেষ দুঃখকষ্ট ভোগ, তাঁর পবিত্র কলঙ্কহীন চরিত্র, দেশের জন্য তাঁর সর্ব্বস্ব ত্যাগ, তাঁর দুঃখময় নিঃস্বার্থ ব্রহ্মচারীর জীবন, তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ও রাজনৈতিক বিজ্ঞতা এবং তাঁর অসীম দুর্জ্জয় সাহস, সংগ্রামাত্মক মনোভাব—এই সকল গুণের জন্য নেতাজী দেশবাসীর নিকট দেবতার ন্যায় পূজার অর্ঘ পাইতেছেন। আমরা বাঙালী, আমাদের পক্ষে তিনি আরও গৌরবের পাত্র; কারণ সুভাষচন্দ্রও সোনার বাঙ্গালা মায়ের সন্তান এবং আমাদের অতি প্রিয় জন। বাঙ্গালার জল, বাঙ্গালার মাটি, বাঙ্গালার বায়ু তাঁহাকে মানুষ করিয়াছিল। তাই তিনি মনেপ্রাণে বাঙ্গালী ছিলেন। এই দেশপ্রেমিকের জীবনের নাটকীয় ঘটনাবলীর সহিত পরিচিত হইবার আন্তরিক ইচ্ছা সকলের মনে আজ জেগে উঠেছে। তাঁর জীবনী ও বাণী আমাদের কাছে খুব প্রিয়তর।

 মাতাপিতা—সুভাষচন্দ্রের পৈতৃক বাসস্থান ছিল চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্গত কোদালিয়া গ্রামে। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে ২৩শে জানুয়ারী উড়িষ্যার প্রধান সহর কটকে সুভাষচন্দ্রের জন্ম হয়। সুভাষচন্দ্রের পিতার নাম স্বর্গীয় জানকীনাথ বসু। তিনি কটকে ওকালতী করিতেন। তখন উড়িষ্যা বাংলা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। জানকীনাথ তাহার গভীর পাণ্ডিত্য ও আইন জ্ঞানের জন্য সরকারী উকিল পদ প্রাপ্ত হন এবং স্থানীয় উকিল সমিতির নেতা ছিলেন। তিনি খুব উদার প্রকৃতির ও জনপ্রিয় লোক ছিলেন। জনপ্রিয়তার জন্য তিনি অনেক বৎসর কটক মিউনিসিপ্যালিটি ও জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ অলঙ্ক‌ৃত করেন। এই সব জনহিতকর কার্য্যের জন্য রাজসরকার তাঁহাকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেন। জানকীনাথের দেশপ্রেমও কম ছিল না। আইন অমান্য আন্দোলন দমন করিবার জন্য ভারত সরকার কঠোর নীতি অবলম্বন করেন। জানকীনাথ এই নীতির প্রতিবাদে রাজপ্রদত্ত ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব ত্যাগ করেন।

 সুভাষচন্দ্রের মাতা শ্রীযুক্তা প্রভাবতী দেবী একজন আদর্শ হিন্দুমহিলা। তিনি অত্যন্ত ধর্ম্মপ্রাণা, দানশীলা, পরদুঃখকাতরা রমণী। তাঁহার স্বামী প্রভূত অর্থ উপার্জন করিলেও প্রভাবতী সাধারণভাবে থাকিতেন এবং তাঁহার পুত্রকন্যাদিগকে সাধাসিধে ধরণে মানুষ করেন।

 মাতাপিতা পুত্রকন্যাদের নিকট জীবন্ত আদর্শ। পৃথিবীতে যে সকল লোক সামান্য অবস্থা হইতে বড় হইয়াছেন, তাঁহারা বাল্যকালে মা-বাপের নিকট হইতে শিক্ষা ও প্রেরণা লাভ করিয়াছেন। শিবাজী, বিদ্যাসাগর, নেপোলিয়ন এব্রাহাম, লিন্কল‍্ন প্রভৃতি মহাপুরুষদের জীবনে মায়ের শিক্ষার প্রভাব প্রত্যক্ষ দেখিতে পাওয়া যায়। শিবাজীর মাতা শিবাজীকে বাল্যকালে ভারতীয় বীরদের কাহিনী শুনাইতেন। সেইজন্য শিবাজী এত বড় বীর হইয়াছিলেন। পিতা জানকীনাথের তেজস্বিতা ও স্বদেশপ্রেম এবং মাতা প্রভাবতীর ধর্ম্মপ্রাণতা, সহৃদয়তা, সারল্য পুত্র সুভাষচন্দ্রের জীবনকে বহুলাংশে প্রভাবান্বিত করিয়াছিল।

 জানকীনাথের আটটি পুত্র ও ছয়টি কন্যার মধ্যে ছয়টি পুত্র ও দুইটি কন্যা জীবিত আছেন। ছয় পুত্রের নাম শ্রীসতীশচন্দ্র বসু, শ্রীশরৎচন্দ্র বসু, সুরেশচন্দ্র বসু শীসুধীর চন্দ্র বসু, ডাঃ সুনীলচন্দ্র বসু ও শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু। সতীশচন্দ্র ও শরৎচন্দ্র কলিকাতা হাইকোর্টের সুবিখ্যাত ব্যারিষ্টার। শরৎচন্দ্র ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ জননায়ক। সুনীলচন্দ্র কলিকাতার বিখ্যাত চিকিৎসক। সব ভাইদের মধ্যে শরৎচন্দ্র শৈশবকাল হইতে সুভাষকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনেও যখন সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস উপরওয়ালাদের বিরাগভাজন হইয়াছিলেন তখন শরৎচন্দ্র ছোট ভায়ের কার্য্যাবলীর অনুমোদন করিয়াছিলেন।

 বাল্যকাল—সুভাষচন্দ্র পাঁচ বৎসর হইতে বার বৎসর পর্যন্ত কটকে খৃষ্টীয় মিশনারী (পাদ্রী) স্কুলে পাঠ করেন। বিদেশী স্কুলে পাঠ করিলেও বিদেশী সভ্যতার ও সমাজের কোন খারাপ প্রভাব তাঁর চরিত্রে প্রবেশ করে নাই। বরঞ্চ সুভাষচন্দ্র পাদ্রীদের কতকগুলি ভাল গুণ অনুকরণ করেন এবং এখানে তাঁহার ইংরাজি শিক্ষার বনিয়াদ গড়ে উঠে।

 ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে সুভাষচন্দ্র র‍্যাভেন‍্শা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্ত্তি হন। এই স্কুল হইতে তিনি ১৯১৩ খৃষ্টাব্দে সতের বৎসর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়া উত্তীর্ণ হন। ইংরাজী পরীক্ষায় তিনি এত ভাল উওর করিয়াছিলেন যে পরীক্ষক নিজেও ঐরূপ উত্তর করিতে পারিতেন না বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন। তিনি বিদ্যালয়ে সর্ব্ব পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করিতেন। গৃহে যেমন মাতাপিতার চরিত্র পুত্রের চরিত্রকে প্রভাবান্বিত করে, বিদ্যালয়ে তেমন শিক্ষকের চরিত্র ছাত্রের চরিত্রকে প্রভাবান্বিত করে। আদর্শ শিক্ষক বেণীমাধব দাস মহাশয়ের মহৎ গুণাবলী সুভাষচন্দ্রের জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।

 স্কুলে পাঠ্যাবস্থায় তাঁহার জীবনে অপূর্ব্ব পরিবর্তন ঘটে এবং ধর্ম্মের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ জন্মে। তের বৎসর বয়সের সময় হইতে সুভাষচন্দ্র শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের ও স্বামী বিবেকানন্দের পুস্তকাদি পাঠ করিতে আরম্ভ করেন। তিনি তাহাদের উপদেশমত ধ্যান-ধারণা অভ্যাস করেন এবং চরিত্রগঠন করেন। ধনীর দুলাল হইয়াও বাল্যকাল হইতেই পার্থিব সুখের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা হয়। ধর্ম্মজীবন যাপন করিবার জন্য তাঁহার হৃদয়ে প্রবল আকাঙ্ক্ষা জন্মে। মাতৃদেবীর সহিত তিনি প্রায়ই ধর্মালোচনা করিতেন। তিনি পড়াশুনা করা অপেক্ষা দরিদ্র নারায়ণের সেবা, রূগ্নের শুশ্রুষা করিতে ভালবাসিতেন। এই সময়ে তাহার জীবনে একটি উচ্চ ও মহৎ আদর্শের বীজ উপ্ত হয়। এই অল্প বয়সে যে আধ্যাত্মিক প্রভাব তাঁহার জীবনে দেখা যায়, সেই প্রভাব তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনকে বহু পরিমাণে গঠিত করে।

 কলেজ জীবন—১৯১৩ খৃষ্টাব্দে সুভাষচন্দ্র প্রেসিডেন্সী কলেজে আই-এ ক্লাসে ভর্ত্তি হন এবং সংস্কৃত, গণিত ও লজিক এই কয়টি বিষয় পাঠ্যরূপে গ্রহণ করেন। তখনকার দিনে প্রত্যেক স্কুলে ও কলেজে ভাল ছাত্রদের একটি দল থাকিত। চিরকুমার থাকিয়া আজীবন দেশসেবা করাই ইহাদের মূলমন্ত্র ছিল। পাঠ ছাড়া ব্যায়ামচর্চ্চ, ধ্যান-ধারণা ইহাদের নিত্যকর্ম্ম ছিল। দলপতি সভ্যদের চরিত্র গঠনের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতেন। আজকাল ছাত্রদের মধ্যে এইরূপ আন্দোলন খুবই কমিয়া আসিতেছে। উচ্চ রাজনীতি চর্চা ভাল কিন্তু ছাত্রজীবনের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্র-গঠন না হইলে ভবিষ্যৎ জীবনে কোন মহৎ কাজ করা যায় না। কলিকাতায় সুভাষচন্দ্র এইরূপ একটি ভাল দলে যোগদান করেন। ডাঃ সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডক্টর প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ এই দলে ছিলেন। ইহারা সকলেই প্রসিদ্ধ দেশসেবক ও চিরকুমার। প্রফুল্ল চন্দ্র টাকশালে ১৭০০ টাকা মাহিনার চাকরি ত্যাগ করিয়া অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভ্য।

 এই সময় সুভাষচন্দ্রের জীবনে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে। পূর্ব হইতে সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং সন্ন্যাস জীবনের প্রতি আগ্রহ প্রবল হইয়া উঠে। হিমালয়ে ও তীর্থস্থানে অনেক সাধু সন্ন্যাসী বাস করেন ইহা তিনি জানিতেন। উপযুক্ত গুরুর উপদেশ ব্যতীত মোক্ষ পাওয়া যায় না। তাই বুদ্ধের মত তিনি সংসারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করিয়া ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে শীতকালে আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতে সদ‍্গুরুর সন্ধানে অকস্মাৎ গৃহত্যাগ করেন। তিনি দিনের পর দিন দারুণ শীতে হিমালয়ের হিংস্রজন্তুপূর্ণ বনে জঙ্গলে পাহাড় পর্ব্বতে ঘুরিয়া বেড়াইলেন। উপযুক্ত আহার নাই, উপযুক্ত বস্ত্র নাই। সেদিকে তাঁহার কোন ভ্রূক্ষেপই ছিল না। তারপরে তিনি হরিদ্বার, মথুরা, বৃন্দাবন, গয়া প্রভৃতি তীর্থস্থানেও গুরুর সন্ধানে পাগলের মত পরিভ্রমণ করেন। তিনি আগ্রাতে প্রেমানন্দ বাবাজী, বৃন্দাবনে সাধুপ্রবর রামকৃষ্ণ দাস বাবাজী, বারাণসীতে রাখাল মহারাজের সাক্ষাৎ লাভ করেন। অনেক মন্দিরের মোহান্তর জীবন-প্রণালীও অবগত হন কিন্তু ইহাদের কেহই তাহার ধর্ম্মতৃষ্ণা তৃপ্ত করিতে পারিলেন না। উপরন্তু রাখাল মহারাজ বাপ-মার অনুমতি না লইয়া আসাতে সুভাষচন্দ্রকে গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতে উপদেশ দেন। তিনি শেষে হতাশ হইয়া অকস্মাৎ একদিন গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন, যেমন অকস্মাৎ তিনি গৃহত্যাগ করেন। দীর্ঘ ছয় মাস অনুপস্থিতির পর হঠাৎ আবির্ভাবে প্রভাবতী কাঁদিয়া বলিলেন, “সুভাস, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবার জন্য জন্মিয়েছ?” মাতাপিতা আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলেই সুভাষচন্দ্রকে দেখিয়া আনন্দে আত্মহারা হইলেন।

 এই নিরুদ্দেশ্যে যাত্রার বিষয় ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে তাহার এক বন্ধুকে তিনি জানান, “আমি দিন দিন বুঝতে পারছি যে আমার জীবনে ভগবান নির্দিষ্ট একটি উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্য সাধন করিবার জন্য আমি দেহ ধারণ করিয়াছি। আমি গতানুগতিক ভাবে জীবন যাপন করিব না।”

 এই স্বেচ্ছাকৃত কষ্টদায়ক ভ্রমণে সুভাষের স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া যায় এবং তিনি টাইফয়েডে দীর্ঘকাল শয্যাগত থাকেন। পরে তিনি কাসিয়াং যাইয়া স্বাস্থ্য-লাভ করেন। তিনি ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে প্রথম বিভাগে আই-এ পাশ করেন।

 দর্শনশাস্ত্রে অনার্স লইয়া তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে বি, এ পড়েন। কলেজেই চরিত্র-প্রভাবে সুভাষচন্দ্র ছাত্রদিগের নেতা হন। এই সময়ের এক ঘটনা তাঁহার জীবনে এক পরিবর্তন আনয়ন করে। ইংরাজির অধ্যাপক মিঃ এফ-ওটেন ক্লাসে ছাত্রদিগের সঙ্গে অপমানজনক ব্যবহার করিতেন। তিনি একদিন বি, এ, ক্লাসের একটি ছেলের গালে চড় মারেন। ইহার ফলে ছেলেরা ধর্ম্মঘট করে। যাহা হউক কর্তৃপক্ষ ইহা মিটমাট করিয়া দেন। একমাস পরে মিঃ ওটেন পুনরায় ছাত্রদিগকে অপমান করেন। আত্ম-সম্মান সকলেরই আছে। এই দুর্ব্যবহার ছাত্রদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। ছাত্ররা ধৈর্য্য হারাইয়া ওটেনকে প্রহার করে। কর্তৃপক্ষ শাস্তিস্বরূপ কতিপয় ছাত্রকে কলেজ হইতে বহিষ্কার করিয়া দেন। সুভাষচন্দ্র দলের নেতা ছিলেন বলিয়া দুই বৎসরের জন্য বহিষ্কৃত হইলেন। তিনি বলেন, “এই ঘটনা তাহার জীবনে স্মরণীয় দিন। মহৎ কাজের জন্য দুঃখ ভোগ করায় যে আনন্দ তাহা আমি জীবনে সর্ব্বপ্রথম অনুভব করিলাম। আমার জীবনে এই প্রথম নীতি ও স্বাদেশিকতার কঠোর পরীক্ষা হইয়া গেল।”

 ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে স্যার আশুতোষের চেষ্টায় তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে বি, এ ক্লাসে ভর্ত্তি হন। তথা হইতে ১৯১৯ খৃষ্টাব্দে দর্শন শাস্ত্রে অনার্সে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়া তিনি বি,এ পাশ করেন। সুভাষচন্দ্র ইউনিভারসিটি ট্রেণিং কোরেও যোগদান করেন।

 বিলাতে পাঠ্যাবস্থা—এই সময়ে পাঞ্জাবে জালিয়ানবাগে ওভোয়ার কর্তৃক নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালনা, খিলাফত ব্যাপার ও রাউলাট আইন প্রবর্তন লইয়া দেশে তুমুল আন্দোলন জাগিয়া উঠিয়াছে। শাসকবর্গও দেশব্যাপি কঠোর নীতি আরম্ভ করিয়াছেন। পাছে ভাবপ্রবণ সুভাষচন্দ্র এই আন্দোলনে যোগ দেয় এই ভয়ে সুভাষচন্দ্রের পিতা সুভাষ চন্দ্রকে পড়াইবার জন্য ও বিলাতি আবহাওয়ায় মনের পরিবর্তনের জন্য বিলাত পাঠাইবার প্রস্তাব করিলেন। সুভাষচন্দ্র ইংরাজের গোলামি করিতে ঘৃণা বোধ করেন। যে শাসকের অত্যাচার হইতে দেশকে বাঁচাইতে হইবে তাহারই চাকরি করিতে হইবে—ইহা ভাবিতেও তাঁহার প্রাণে কষ্ট হইতে লাগিল। শেষে অনেক মানসিক তর্কের পর এবং বন্ধুদের ও আত্মীয় স্বজনের অনেক অনুরোধে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিলাত যাইতে মনস্থ করিলেন। সেখানে পিতা যাহা ভাবিয়াছিলেন তাহা হইল না। পাশ্চাত্য সভ্যতার চাকচিক্য তাঁহার মনকে আকৃষ্ট করিতে পারিল না। উপরন্ত তথাকার অধিবাসীদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সামরিক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা, আর্থিক অবস্থার সহিত ভারতবাসীর পরাধীনতা, শিক্ষার অভাব, আর্থিক দুর্দ্দশার তুলনা করিয়া তিনি মনে খুব দুঃখ অনুভব করিলেন।

 ভারতবাসীর অপমানে সুভাষচন্দ্র যেমন ব্যথিত হইতেন ভারতবাসীর সম্মানেও তিনি খুবই আনন্দিত হইতেন। ১৯১৯ খৃষ্টাব্দে লণ্ডনে শ্রীযুক্তা সরোজিনী নাইডু ও শ্রীযুক্ত রায় একটি সভাতে ওজঃস্বিনী ভাষায় বক্ত‌ৃতা করেন। সেখানে বহু লোক সমাগম হইয়াছিল। নাইডুকে সকলেই সন্মান করেন। সুভাষচন্দ্র এই বক্ত‌ৃতার বিষয় বলেন, “যে দেশ নাইডুর মত রমণীর জন্ম দিতে পারে সে দেশ স্বাধীন হইবেই।”

 অনেক ছাত্রই বিলাতে যাইয়া বাপের টাকা লইয়া ছিনিমিনি খেলা করে এবং বিলাস-বসনে অপব্যয় করে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত মিতব্যয়ী ও পরিশ্রমী ছিলেন। বিলাত যাইবার মাত্র নয় মাসের মধ্যে সুভাষচন্দ্র I. C. S. পরীক্ষায় কেবল উত্তীর্ণ হন না পরন্তু তিনি পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন এবং ইংরাজি রচনায় প্রথম হন। এই অল্প সময়ের মধ্যে I. C. S-এর মত কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সুভাষচন্দ্রের অসাধারণ বুদ্ধি ও পাণ্ডিত্যর পরিচয় দেয়।

 পরীক্ষায় পাশ করায় তিনি খুব দুঃখিত হইলেন কিন্তু নিজের আদর্শকে ভুলিলেন না। এক বৎসর অনেক চিন্তার পর তিনি ভারত সচিবের অনুরোধ উপেক্ষা করিয়া পদত্যাগ পত্র দাখিল করিলেন। এই চাকরি অনেকের পক্ষে স্বর্গ সমান। চাকরিজীবি বাঙ্গালীর এর চেয়ে বেশী কাম্য কিছু নাই। চাকরিতে আড়াই হাজার টাকা মাহিনা, আরও উচ্চ বেতনের হাইকোর্টের জজ বা বিভাগীয় কমিশনার পর্যন্ত হওয়া যায়। এত বড় লোভ সম্বরণ করা খুব মানসিক বলের দরকার। এ কি সোজা স্বার্থত্যাগ! তিনি ১৯২১ খৃষ্টাব্দে মে মাসে কেম্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বি, এ, (অনার্স সহ) ডিগ্রি লইয়া ১৬ই জুলাই দেশে ফেরেন।

 ভারতে আগমন—তখন ভারতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণভাবে আরম্ভ হয়েছে। ইংরাজ রাজত্ব ভারতবাসীর সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। পুলিশ, রেল, পোষ্টাফিস, আফিস, আদালত, হাঁসপাতাল এমন কি সৈন্যবিভাগ সবই ভারতবাসী চালায়। মহাত্মা চেয়েছিলেন—এই সব লোক চাকরি ছাড়িয়া দিলে ইংরাজ রাজত্ব একদিনেই অচল হবে। সুভাষচন্দ্র প্রথমেই বোম্বাইতে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করেন কিন্তু গান্ধীজির সহিত আলোচনায় তাঁহার কার্য প্রণালীর বিষয়ে সন্তুষ্ট হইতে পারেন নাই। তৎপরে সুভাষচন্দ্র বাংলার নেতা দেশবন্ধুর সহিত দেখা করেন। দেশবন্ধুর কথায় তিনি মুগ্ধ হন এবং দেশবন্ধুর অনুচররূপে দেশসেবায় জীবন উৎসর্গ করেন।

 জাতীয় কলেজের অধ্যক্ষ—গান্ধীজির আহবানে অনেকেই ওকালতি ডাক্তারি ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। অনেক ছাত্রও স্কুল কলেজ ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। এই সব ছাত্রদের জন্য প্রত্যেক প্রদেশে জাতীয় কলেজ স্থাপিত হইয়াছিল। সুভাষচন্দ্র কলিকাতার জাতীয় কলেজের অধ্যক্ষ ও কংগ্রেস কমিটির প্রচার কর্তা নিযুক্ত হন। অধ্যক্ষ হিসাবে তিনি ছাত্রদিগের মনে প্রথমেই জাতীয়তা ও ত্যাগের কথাই শিক্ষা দেন। সরকার বাহাদুর এই কলেজগুলিকে অঙ্ক‌ুরেই বিনাশ করিবার সুযোগ খুঁজিতে লাগিলেন।

 যুবরাজ বয়কট—১৯২১ খৃষ্টাব্দের ১৭ই নবেম্বরে ইংলণ্ডের যুবরাজ ও ভারতের ভাবী সম্রাট ভারতে আগমন করেন। কংগ্রেসের নির্দ্দেশে সমস্ত ভারত ঐদিন দোকান-পাট যান-বাহন বন্ধ করিয়া শান্তিভাবে পূর্ণ হরতাল পালন করে। গভর্ণমেণ্টের নীতির প্রতিবাদে এইরূপ করা হয়। যুবরাজের প্রতি ব্যক্তিগত অসম্মান কাহারও ছিল না। বাংলায় তখন সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কলিকাতায় ১৭ই তারিখের হরতালকে পরিচালনা করে। যুবরাজের ২৫ শে ডিসেম্বর কলিকাতায় আসার কথা। সেইজন্য ১৯ শে নভেম্বরে বাংলা সরকার সেচ্ছাসেবক বাহিনীকে বে-আইনী ঘোষণা করেন এবং কলিকাতায় শোভাযাত্রা ও সভা নিষিদ্ধ করেন। নেতারা এই আদেশ অমান্য করেন। এই প্রথম আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ হয়। দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র, মৌলানা আজাদ, বীরেন্দ্র শাসমল প্রভৃতি অনেকে গ্রেপ্তার হন। ইহা সত্ত্বেও ২৫শে কলিকাতায় পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সুভাষচন্দ্রের ও দেশবন্ধুর প্রথমবার ছয় মাস কারাবাসের আদেশ হয়। এত কম দণ্ডে সুভাষচন্দ্র বলিয়াছিলেন, “আমি কি মুর্গী চোর যে এত কম দণ্ড হল।” কারাগারে দেশবন্ধুর সহিত সুভাষের খুব ঘনিষ্টতা জন্মে।

 উত্তরবঙ্গ প্লাবন—১৯২২ খৃষ্টাব্দে সুভাষচন্দ্র মুক্তিলাভ করেন। তখন উত্তরবঙ্গে প্রবল বন্যায় সহস্র সহস্র লোক গৃহহীন হইয়াছে। সুভাষচন্দ্র তৎক্ষণাৎ একটি সঙ্কট-ত্রাণ সমিতি গঠন করিয়া সেচ্ছাসেবক লইয়া উত্তরবঙ্গে কর্ম্মক্ষেত্রে ঝাপাইয়া পড়িলেন। তিনি শীঘ্রই চারিলক্ষ টাকা চাঁদা তুলিলেন এবং প্রচুর কাপড়, খাদ্যদ্রব্য যোগাড় করিলেন। তাঁহার কর্ম্মকুশলতায় তদানীন্তন গভর্ণর লর্ড লিটনও প্রীত হইয়াছিলেন।

 স্বরাজ্য দল—১৯২২ খৃষ্টাব্দে ডিসেম্বরে দেশবন্ধুর সভাপতিত্বে গয়ায় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে কংগ্রেসের ভিতর স্বরাজ্য দল নামে একটি দল গঠিত হয়। এই দলের সভ্যরা কাউন্সিল প্রবেশের পক্ষপাতী। দেশবন্ধু এই দলের সভাপতি ও সুভাষচন্দ্র সম্পাদক নিযুক্ত হন। সুভাষচন্দ্র অতি কৃতিত্বের সহিত “ফরওয়ার্ড” ও “বাঙ্গালার কথা” নামক দুইখানি কাগজের সম্পাদনা করেন। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে সুভাষচন্দ্রের কঠোর পরিশ্রমের ফলে স্বরাজ্য দল নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এই বৎসর সুভাষচন্দ্র “তরুণ সঙ্ঘ” নামক একটি দল গঠন করেন। শ্রমিক ও কৃষকদিগের অবস্থার উন্নতি করা এই দলের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

 করপোরেশনের প্রধান কর্ম্মকর্ত্তা—১৯২৫ খৃষ্টাব্দে স্বরাজ্য দল হইতে কলিকাতা করপোরেশনে অধিকাংশ সভ্য নির্ব্বাচিত হন। দেশবন্ধু মেয়র (সভাপতি), সুভাষচন্দ্র প্রধান কর্ম্মকর্ত্তা হন। প্রধান কর্ম্ম কর্ত্তার বেতন ৩০০০৲ টাকা ছিল। সুভাষচন্দ্র স্বেচ্ছায় ১৫০০৲ টাকা লন এবং এই টাকারও বেশীরভাগ তিনি গরীব ছাত্রদের দান করিতেন। সুভাষচন্দ্রের বয়স তখন ২৭ বৎসর। ইহার পূর্ব্বে করপোরেশনে সরকারি প্রভাব ছিল। এখন থেকে সকল সভ্য খদ্দর পরে আসতে লাগলেন, কলিকাতায় ভারতবর্ষের বড় লোকের নামে রাস্তা হ’তে লাগল, বড়লাট বা গভর্ণরদের পরিবর্তে জাতীয় নেতাদের আগমনে নাগরিক সম্বর্ধনা জানান হতে লাগল, বিনা খরচে প্রাথমিক শিক্ষা, ঔষধপথ্য বিলি হতে লাগল।

 ৩ আইনে গ্রেপ্তার—যুবরাজের বয়কটে, স্বরাজ্যদলের সাফল্যে, করপোরেশনের কাজে সুভাষচন্দ্র সকলের প্রিয় হইয়াছিলেন। গভর্ণমেণ্ট সুভাষচন্দ্রের এই জনপ্রিয়তা ও কাজকর্ম্ম ভালচক্ষে দেখিতেন না। বড়লাট ২৪শে অক্টোবর ৩নং রেগুলেশন আইন জারি করিয়া বাংলা সরকারকে বিনা বিচারে আটক করার ক্ষমতা দিলেন। বাংলা সরকার সুভাষচন্দ্রকে ও অন্যান্য অনেককে, ২৫শে অক্টোবর গ্রেপ্তার করিলেন। গ্রেপ্তারের কারণ কিছুই জানান হয় নাই। ষ্টেটসম্যান ও ইংলিশম্যান কাগজ সুভাষচন্দ্রকে বিপ্লবী ষড়যন্ত্রের মস্তিষ্ক বলিয়া অভিহিত করেন। ইহাতে সুভাষচন্দ্র তাহাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা আনেন। সুভাষচন্দ্রকে দুই মাস আলিপুর জেলে থাকিয়াই করপোরেশনের কাজকর্ম্ম চালাইতে দেওয়া হয়। তৎপরে তাহাকে বহরমপুর জেলে পাঠান হয়।

 মান্দালয়ে কারাবাস—বহরমপুর হইতে সত্যেন্দ্র মিত্র প্রভৃতি সাতজন সঙ্গীসহ সুভাষচন্দ্রকে ব্রহ্মদেশের মান্দালয়ে জেলে পাঠান হয়। এইখানে লোকমান্য তিলককে ছয় বৎসর ও পাঞ্জাব কেশরী লাজপৎ রায়কে এক বৎসর কারাবাসে কাটাইতে হয়। মান্দালয় জেলে রাজবন্দীদিগকে দুর্গাপূজার খরচ দিতে গভর্ণমেণ্ট অস্বীকার করায় ১৯২৬ সালের ২০ শে ফেব্র‌ুয়ারীতে সুভাষচন্দ্র ও অন্যান্য বন্দীরা অনশন ধম্মঘট করে। ইহাতে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন হয়। গভর্ণমেণ্ট অবশেষে ধর্ম্মোৎসবের জন্য অর্থ মঞ্জ‌ুর করেন।

 জেলে অবস্থানের কালেই দেশের লোক সুভাষকে ও সত্যেন্দ্র মিত্রকে ১৯২৬ সালে নভেম্বরে বাংলার রাষ্ট্রীয় পরিষদে সদস্য নির্বাচন করেন। ইহাতে তাঁহাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হয়।

 মান্দালয় জেল অস্বাস্থ্যকর জয়গা; এখানে সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া গেল, শরীরের ওজন আধমণ কমিয়া যায় এবং ক্ষয়রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাঁহাকে ইনসিন জেলে পাঠান হয় এবং এখানে সুভাষচন্দ্রের ভ্রাতা ডাঃ সুনীল বসু ও সরকারী ডাক্তার তাঁহাকে পরীক্ষা করিয়া সুভাষচন্দ্রের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলিয়া রিপোর্ট দেন। সেইজন্য বাংলা সরকার কতকগুলি সর্তে তাঁহাকে খালাস দিতে প্রস্তাব করেন। সুভাষচন্দ্রের মত আত্মমর্যাদাজ্ঞানী লোকের পক্ষে এইরূপ মুক্তি পাওয়া অপমানজনক। সুভাষচন্দ্র সম্মত হইলেন না। সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্যের অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হইতে লাগিল। অবশেষে ১৯২৭ সালে ১৬মে তারিখে তিন বৎসর পর তাঁহাকে বিনা সর্তে মুক্তি দেওয়া হয়। সুভাষচন্দ্রের মুক্তির ব্যাপার একটু রহস্যপূর্ণ। ১৫ই মে সুভাষচন্দ্রকে জাহাজে রেঙ্গুন থেকে ডায়মণ্ডহারবারে আনা হয়। সেখানে গভর্ণরের লঞ্চে তাঁহাকে নামান হয় এবং প্রসিদ্ধ ডাক্তারগণ তাঁহাকে পরীক্ষা করেন। ১৬ই মে সকালে তাঁহাকে টেলিগ্রাম করিয়া মুক্তি দেওয়া হয়। সুভাষচন্দ্রের মুক্তিতে সারা বাংলায় একদিনের জন্য দোকানপাট বন্ধ থাকে। সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্যের জন্য মন্দিরে ও গৃহে প্রার্থনা করা হয় এবং শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করা হয়। ইহাতে দেশবাসীর গভীর ভালবাসা প্রমাণ হয়। গ্রেপ্তারের সময় সুভাষচন্দ্র সুস্থ, সবল ও কর্ম্মঠ যুবক ছিলেন, মুক্তির সময় কিন্তু সুভাষচন্দ্র ভগ্নস্বাস্থ্য ভগ্নোদ্যম, উঠিবার শক্তি পর্যন্ত ছিল না। মান্দালয়ের কারাবাসের এই ফল!

 বাংলার নেতা—সুভাষচন্দ্রের কারাবাসের সময়ে বাংলার নেতা দেশবন্ধু দেহত্যাগ করেন। সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্যলাভের পর বাংলার জনমত সুভাষচন্দ্রকে প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ও বাংলার নেতা মনোনীত করেন। নভেম্বরে মাদ্রাজে কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। সুভাষচন্দ্র ও জহরলাল কংগ্রেসের সাধনার সম্পাদক নিযুক্ত হন।

 নেহেরু কমিটি—ভারতে কি প্রকার শাসনতন্ত্র চালু হবে তাহা স্থির করিবার জন্য পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুর সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। নাম নেহেরু কমিটি। এই কমিটি পূর্ণ স্বাধীনতা না মানিয়া ঔপনিবেশিক স্বায়ত্বশাসন মূল নীতিরূপে মানিয়া লন। ইহাতে ব্রিটিশ সাম্রাজের মধ্যেই অংশীদার রূপে ভারতবর্ষকে থাকিতে হইবে। লক্ষ্ণৌতে সর্ব্বদলের একটি সম্মেলন হয়। তাহাতে অধিকাংশের মতে নেহেরু কমিটির স্বায়ত্ত্বশাসন প্রস্তাব পাশ হয় কিন্তু সুভাষচন্দ্র, জহরলাল প্রভৃতি চরমপন্থীদল ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া “স্বাধীনতা সঙ্ঘ” নামক একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করিবার স্থির করেন। সুভাষচন্দ্র এই প্রথম কংগ্রেসের বিরুদ্ধাচরণ করেন।

 সাইমন কমিশন বয়কট —এই বৎসর বিলাত হইতে সাইমন সাহেবের নেতৃত্বে একটি রাজকীয় কমিশন ভারতে আসে। ইহার উদ্দেশ্য ছিল— ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা আলোচনা করা এবং ভারতকে কতটা দায়িত্বপূর্ণ শাসনভার দেওয়া যায় তাহা স্থির করা। কংগ্রেস এই কমিশনকে বয়কট করিবার প্রস্তাব করে। ১৯২৮ সালের ৩রা ফেব্রয়ারীতে ভারত “সাইমন ফিরিয়া যাও” বলিয়া বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। স্কুল-কলেজ দোকান-পাট বন্ধ হয়।

 ১৯২৮সাল—১৯২৮ সালের মে মাসে সুভাষচন্দ্র সবরমতী আশ্রমে মহাত্মাজীর সঙ্গে দেখা করিয়া তাঁহাকে পুনরায় আইন অমান্য আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করিতে অনুরোধ করেন কিন্তু মহাত্মা বলেন, “আমি ভগবানের কোন নির্দ্দেশ পাইতেছি না।”

 ১৯২৮ সালের মে মাসে সুভাষচন্দ্র পুণাতে মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন।

 ১৯২৮ সালে ডিসেম্বরে সুভাষচন্দ্র ভারতীয় যুব কংগ্রেসের কলিকাতা অধিবেশনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হন। এই কংগ্রেসে তিনি প্রথম গান্ধীজীর মতের বিরুদ্ধে বক্ত‌ৃতা করেন।

 কলিকাতা কংগ্রেস—১৯২৮ সালে কলিকাতায় মতিলাল নেহরূর সভাপতিত্বে কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। সুভাষচন্দ্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতা হন।

 এই কংগ্রেসে উগ্রপন্থী দল ও নরমপন্থী দলের মধ্যে বিরোধ প্রবল হয়। উগ্রপন্থীদল চান—ব্রিটিশের সঙ্গে সকল সম্পর্ক বিচ্ছেদ করিয়া পূর্ণ স্বাধীনতা; এই দলে সুভাষচন্দ্র, জহরলাল ছিলেন। নরমপন্থীদল চান—ঔপনিবেশিক স্বায়ত্বশাসন অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতরে থাকিতে। এই দলে মতিলাল, মহাত্মা গান্ধী ছিলেন। মহাত্মাজী একটি প্রস্তাব করেন, “যদি ১৯২৯ সালের মধ্যে ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট নেহরু কমিটির রিপোর্ট মানিয়া লয় অর্থাৎ স্বায়ত্ব-শাসন দেয়, ভারত তাহা গ্রহণ করিবে; যদি তাহা না হয় তবে কংগ্রেস ১৯২৯ সালের শেষে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করিবে”। সুভাষচন্দ্র ‘পূর্ণ স্বাধীনতার’ সংশোধন প্রস্তাব আনয়ন করেন কিন্তু সুভাষের প্রস্তাব ১৩৫০৯৭৩ ভোটে অগ্রাহ্য হয়। এই বৎসরে ৩০শে ডিসেম্বরে সুভাষ হিন্দুস্থান সেবাদলের সভাপতিত্ব করেন। কংগ্রেসের পরই সুভাষচন্দ্র, জহরলাল প্রভৃতি স্বাধীনতা-সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৯হইতে ১৯৩১ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভাপতি হন। ইহা ভারতীয় কলের মজুরদের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান।

 জহরলালের দলত্যাগ—১৯২৯ সালের লাহোরে কংগ্রেসের দিন এগিয়ে আসতে লাগল। এদিকে গভর্ণমেণ্টের তরফ থেকে কংগ্রেস প্রস্তাবের কোন সাড়াশব্দ নাই। মহাত্মা কংগ্রেসে সুভাষের ও জহরলালের নেতৃত্বে চরমপন্থী দলের সংখ্যা ও তরুণদের প্রতিপত্তি যে বেড়ে যাচ্ছে এবং তাঁহার প্রতিপত্তি যে কমে যাচ্ছে কলিকাতা কংগ্রেসে ইহা লক্ষ্য করে বিচলিত হলেন। ১৯২৯ সালে অক্টোবরে সুভাষ লাহোরে যুব-সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এবং বিপুল ভাবে সম্বর্দ্ধিত হন। এই লাহোরেই কংগ্রেসের অধিবেশন হইবে। এই সকল চিন্তা মহাত্মাকে অধিক বিচলিত করিল। গান্ধীজি জহরলালকে নিজের দলে টানবার চেষ্টা করতে লাগলেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি জহরলালকে লাহোর কংগ্রেসের সভাপতি মনোনীত করাইলেন। সেই অবধি জহরলাল সুভাষচন্দ্রের উগ্রপন্থীদল ত্যাগ করিয়া মহাত্মার দলে যোগদান করিলেন এবং আজ পর্যন্ত মহাত্মারই বিশ্বস্ত অনুচর আছেন।

 বাংলায় পুনর্নির্ব্বাচন—১৯২৯ খৃষ্টাব্দের এপ্রিলে বাংলার গভর্ণর বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা ভাঙ্গিয়া দেন এবং পুনঃ নির্ব্বাচনের আদেশ দেন। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে জুন মাসে কংগ্রেস প্রার্থীরা বিপুল ভোটাধিক্যে মনোনীত হন।

 কারাদণ্ড—১৯২৯ খৃষ্টাব্দে আগষ্ট মাসে সুভাষচন্দ্র “নিখিল ভারত লাঞ্ছিত রাজনৈতিক দিবস” পালন উপলক্ষ্যে এক শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন। সেইজন্য সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগে মামলা আনা হয়। ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে ২৩শে জানুয়ারীতে সুভাষচন্দ্রের ৯ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

 ১৯২৯ খৃষ্টাব্দে ১৩ই সেপ্টেম্বর লাহোর জেলে যতীনদাস ৬৩ দিন অনশন করিয়া মারা যান। তাঁহার মৃতদেহ কলিকাতায় আনা হইলে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে এক বিরাট শোভাযাত্রা হয়। ২৯ সেপ্টেম্বরে সুভাষচন্দ্র হাওড়ায় রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

 আরউইনের ঘোষণা—১৯২৯ খৃষ্টাব্দের ৩১ অক্টোবরে বড়লাট আরউইন কংগ্রেসকে জানান যে ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট ১৯১৭ খৃষ্টাব্দের ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ব শাসনই ভারতের ভারী শাসনতন্ত্র বলিয়া ঘোষণা করেন এবং সাইমন কমিশনের রিপোর্ট বাহির হইলেই লণ্ডনে একটি গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করা হইবে। এই ঘোষণার পর দিল্লীতে সর্ব্বদলীয় কনফারেন্স হয়। ইহাতে মতিলাল, মদনমোহন, জহরলাল, সরোজিনী নাইডু প্রভূতি অনেকে বড়লাটের ঘোষণা ও ভারতের স্বায়ত্বশাসনের বিস্তারিত আলোচনার জন্য গোলটেবিল বৈঠকের সমর্থন করিয়া এক বিবৃতি দেন। সুভাষ, কিচলু প্রভৃতি কয়েকজন পৃথক বিবৃতি দিয়া ইহার বিরোধিতা করেন। ইহার পর গান্ধীজি ও মতিলাল বড়লাটের সঙ্গে দেখা করেন কিন্তু হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসেন। সুভাষচন্দ্র এইরূপ ভিক্ষাবৃত্তি ও আপোষকরার বরাবরই বিরোধী। তিনি জীবনে কখনও কোন বড়লাট বা গভর্ণরের সঙ্গে দেখাকরেন নাই কারণ তিনি বিশ্বাস করেন স্বাধীনতা কখনও কেহ কাহাকে স্বেচ্ছায় দেয় না। আপোষ করে স্বাধীনতা পাওয়া যায় না।

 লাহোর কংগ্রেস—লাহোর কংগ্রেসে মহাত্মা নিজেই ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। লাহোর কংগ্রেসেও সুভাষচন্দ্র ও মহাত্মা চালিত নরমপন্থীদলের মধ্যে মতভেদ সুস্পষ্ট হয়। আরউইনের ট্রেনে বোমা ফেলা হয় এবং তিনি কোন প্রকারে বাঁচিয়া যান। মহাত্মা আরউইনের নিষ্কৃতির জন্য সমবেদনাজ্ঞাপক একটি প্রস্তাব করেন। সুভাষের দল ইহাতে আপত্তি করেন। সুভাষচন্দ্র লাহোর কংগ্রেসে ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টকে পূর্ণভাবে বয়কট করিয়া পাশাপাশি জাতীয় গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠা করিবার এবং শ্রমিক, কৃষক ও যুবকদিগকে সঙ্ঘবদ্ধ করিবার প্রস্তাব করেন। উহা ভোটে অগ্রাহ হয়।

 সুভাষচন্দ্র তরুণ সম্প্রদায়ের নেতা হন এবং পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য জোর আন্দোলন চালান এবং দেশকে স্বায়ত্বশাসনের প্রস্তাবে সন্তুষ্ট থাকিতে নিষেধ করেন।

 একটা জিনিষ লক্ষ্য করা যায় যে সুভাষচন্দ্র চিন্তায় সকলের অগ্রগামী ছিলেন। কলিকাতার কংগ্রেসে সুভাষের স্বাধীনতা প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয় এবং পর বৎসর লাহোর কংগ্রেসে উহাই গৃহীত হয়। লাহোরে সুভাষের আইন অমান্য আন্দোলন প্রস্তাব প্রত্যাখাত হয়, পর বৎসর কংগ্রেসে উহাই গৃহীত হয়। পরে দেখা যাইবে ত্রিপুরী কংগ্রেসে “ভারত ছাড়” প্রস্তাব প্রত্যাখাত এবং ১৯৪২ সালের কংগ্রেসে তাহাই যাদুমন্ত্ররূপে গৃহীত হয়। লাহোরে সুভাষচন্দ্র প্রস্তাব করেন যে কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতির সভ্য সভাপতির দ্বারা মনোনীত না হইয়া গণতন্ত্রের ভিত্তিতে নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির দ্বারা নির্ব্বাচিত হউক। এই প্রস্তাবও প্রত্যাখাত হয়। কয়েক বৎসর পর আবার এই প্রস্তাবই গৃহীত হয়। লাহোর কংগ্রেসে শেষোক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখাত হওয়ায় সুভষচন্দ্রের দল কংগ্রেসের প্যাণ্ডেল ত্যাগ করিয়া যান এবং দশ মিনিটের মধ্যে কংগ্রেস গণতান্ত্রিক নামক একটি দল গঠন করেন। ইহা গণতন্ত্রনীতির বিরোধী যে সভাপতি নিজের মনোমত সভ্য নিয়োগ করিবেন। সভাপতি জহরলাল সুভাষের দলের শ্রীনিবাস আয়েঙ্গারকে এবং সুভাষকে কার্যকরী সমিতির মধ্যে গ্রহণ করিলেন না। আয়েঙ্গারকে দেশ প্রেমিক এবং মাদ্রাজের হাইকোর্টের Advocate Generalএর পদ ত্যাগ করেন। তিনি ১৯২৬ সালের কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। এইরূপ লোককেও কার্যকরী সমিতির সভ্য করা হয় নাই। ইহার পর অয়েঙ্গার চিরজীবনের মত কংগ্রেস ত্যাগ করেন।

 বাংলায় বিরোধ—দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন ও সুভাষচন্দ্র দুই জনই দেশবন্ধুর প্রিয় অনুচর। দেশবন্ধুর মৃত্যুর সময় সুভাষচন্দ্র কারাগারে ছিলেন। সেইজন্য দেশপ্রিয় বাংলার নেতা হন। তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি ও করপোরেশনের পাঁচ বার মেয়র হন। সুভাষের মুক্তির পরে বাংলার নেতৃত্ব লইয়া সুভাষচন্দ্র ও দেশপ্রিয়ের মধ্যে বিবাদ আরম্ভ হয়। এই ব্যাপার লইয়া অনেক তিক্ততা প্রকাশ পায়। কংগ্রেস মিঃ এম,এস,এ্যনেকে বিবাদ মিটাইবার জন্য সালিশী নিযুক্ত করেন। কলিকাতায় মহারাষ্ট্র ভবনে সালিশী বসিত। ব্যারিষ্টার নিশীথসেন সেনগুপ্তের দিকে ও ব্যারিষ্টার শরৎ বসু সুভাষের দিকে মামলা পরিচালনা করেন। অনেক দিন পর বিবাদ মিটিয়া যায়। সুভাষচন্দ্র লাহোরে যুবক, শ্রমিক ও কৃষকদিগের সভায় অনেক বক্ত‌ৃতা করেন এবং সকলেই তাহাকে সমর্থন করেন।

 তিনবার কারাদণ্ড—ইহার পরে আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ হয়। সুভাষচন্দ্র, সেনগুপ্ত, সত্যরঞ্জন বক্সী, কিরণ শঙ্কর প্রভৃতি নেতাদের কারাদণ্ড হয়। সুভাষের নয় মাস কারাদণ্ড হয়। তাঁহারা আলিপুর জেলে আবদ্ধ থাকেন। এখানে একটি ঘটনা ঘটে। ২৭ শে এপ্রিল সকালে মেছুয়াবাজার বোমার মামলার আসামীরা হাজতে দুর্ব্ববহারের প্রতিবাদে কয়েদীর গাড়ীতে উঠিতে অস্বীকার করে। জেলের কর্তৃপক্ষের আদেশে কতকগুলি পাঠান তাঁহাদিগকে জোর করিয়া গাড়ীতে উঠাইতে যায়। সুভাষচন্দ্র ও অন্যান্য রাজবন্দী ইহাতে আপত্তি করেন। তখন একজন পাঠান সুভাষচন্দ্রকে লাঠি দিয়া আঘাত করে। সুভাষচন্দ্র একঘণ্টা অজ্ঞান অবস্থায় থাকেন। ইহাতে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন হয়। ইহার ফলে জেলকর্ত্তাকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়।

 সুভাষচন্দ্র জেলে থাকা কালেই করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। মুক্তির পর তিনি Trade Union Congressএর সভাপতি নির্ব্বাচিত হন। ১৯৩১ খৃষ্টাব্দে জানুয়ারীতে মালদহ জেলায় সাত দিনের জন্য সুভাষের কারাদণ্ড হয়। লাহোর কংগ্রেসের পর প্রত্যেক বৎসর ২৬ শে জানুয়ারী শোভাযাত্রা করিয়া ও স্বাধীনতা সঙ্কল্প বাক্য পাঠ করিয়া 'স্বাধীনতা' দিবস পালিত হয়। ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে এইরূপ শোভাযাত্রা করাতে সুভাষের ও এগার জনের ছয় মাস কারাদণ্ড হয়।

 গান্ধী আরউইন প্যাক‍্ট—লণ্ডনে প্রথম গোল টেবিল বৈঠকে কংগ্রেসের কোন প্রতিনিধি না থাকায় উহা ব্যর্থ হয়। গভর্ণমেণ্ট দমন নীতি অবলম্বন করিয়া এবং সমস্ত নেতাকে কারাগারে পাঠাইয়াও কোন প্রকারে আইন অমান্য আলোলন বন্ধ করিতে পারিলেন না। উদার নৈতিক দলের তেজ বাহাদুর সপ্র‍‌ু ও জয়াকরের মধ্যস্থতায় গভর্ণমেণ্ট কংগ্রেসের সঙ্গে একটা আপোষ মীমাংসা করার জন্য সকল নেতাকে ও রাজনৈতিক বন্দীদের বিনা সর্ত্তে মুক্তি দেন। এই সর্ত হয় যে মহাত্মা গান্ধী সাময়িক ভাবে আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করিবেন এবং লণ্ডনে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিবেন। ইহাই বিখ্যাত গান্ধী—আরউইন প্যাকট। চরমপন্থী দল এই চুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন।  সর্দ্দার ভাগত সিং পাঞ্জাব বোমা মামলার আসামী ছিলেন। কংগ্রেসের উগ্রপন্থীদল ভাগত সিংহের মুক্তির জন্য গান্ধীকে অনুরোধ করিলেন কিন্তু উহা পাঞ্জাব গভর্ণমেণ্টের ব্যাপার বলিয়া বড়লাট কিছুতেই রাজী হলেন না। ইহাতে তরুণ সম্প্রদায় গান্ধীর উপর খুব অসন্তুষ্ট হইলেন। করাচিতে কংগ্রেসের অধিবেশনের সময় তরুণ সম্প্রদায় ভারতীয় নবযুয়ান (Najuan) কনফারেন্স আহবান করেন। সুভাষ ইহার সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ কংগ্রেস অধিবেশনের পূর্ব্বেই ভাগত সিং ও শুকদেব সিংএর ফাসি হইয়া যায়। এই সংবাদে সমস্ত দেশ ক্ষেপিয়া উঠে। করাচিতে গান্ধীজীকে কাল নিশান দেখান হয় এবং ঢিল ছোড়া হয়। নবযুয়ান কনফারেন্স গান্ধীজীর আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করার নীতিকে নিন্দা করা হয়।

 প্রতিবাদ—হিজলী বন্দীশালায় গুলি চালনার ফলে দুইজন রাজবন্দী নিহত হন। সুভাষচন্দ্র ইহার প্রতিবাদে করপোরেশনের অলড্যারম্যানের পদত্যাগ করেন।

 হাজতবাস—বিলাতে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের পর মহাত্মা হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসেন। ১৯৩১ সালে ২৯ শে ডিসেম্বর বোম্বাইতে কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতির অধিবেশন হয়। সুভাষ এই অধিবেশনে যোগদান করিতে আমন্ত্রিত হন যদিও তিনি সভ্যপদ ত্যাগ করেন। বোম্বাই হইতে প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি কল্যান স্টেশনে গ্রেপ্তার হন। কয়েক মাস বিভিন্ন জেলে আটক থাকায় তাঁর স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া যায়। অবশেষে গভর্ণমেণ্ট সুভাষকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপে যাইতে অনুমতি দেয়। কিন্তু তিনি সেখানেও অবাধ স্বাধীনতা পান নাই এমন কি ইউরোপে যাইবার সময় তাঁহাকে মাবাপের সহিত দেখা করিতে দেওয়া হয় না।

 ইউরোপ ভ্রমণ—১৯৩৩ খৃষ্টাব্দে ২৩ শে ফেব্রূয়ারী সুভাষচন্দ্র ইউরোপ যাত্রা করেন এবং ৮ই মার্চ্চ ভিয়েনায় পৌছান। ভিয়েনা সহরের পৌর ব্যবস্থা দেখিয়া তিনি মুগ্ধ হন। ভিয়েনা পৃথিবীর মধ্যে একটি সুন্দর সহর। তিনি কলিকাতা শহরের ব্যবস্থাতে ঐ সব প্রণালী প্রবর্তন করিতে মনস্থ করেন। তিনি ভিয়েনায় সৈন্যদের কুচকায়াজে উপস্থিত ছিলেন। তাহাদিগের নিয়মানুবর্তিতা দেখিয়াও তিনি মুগ্ধ হন।

 অনেক ভারতবাসী বিদেশে যাইয়া স্ফ‌ুর্ত্তি করিয়া বাজে কাজে সময় ও অর্থের অপব্যয় করেন। স্বাধীন দেশে আমাদিগের অনেক শিখিবার বস্তু আছে। সে সব দেশের তুলনায় শিক্ষায়, চরিত্রে, শিল্পে, কৃষিবিদ্যায়, রাজনীতিতে সব বিষয়ে আমরা কত পশ্চাতে পড়িয়া আছি তাহা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। সুভাষ চন্দ্র যেখানেই গিয়াছেন সেখানেই ভারতের সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য তথ্য সংগ্রহ করিয়াছেন।

 এই সময়ে ভারতীয় রাষ্ট্রপরিষদের সভাপতি পরলোকগত বিঠল ভাই প্যাটেল ভিয়েনায় চিকিৎসার জন্য গমন করেন। দুইজন নেতা একঙ্গে ছিলেন এবং সুভাষচন্দ্র প্যাটেলের মৃত্যু পর্যন্ত সেবা করেন। ইহারা উভয়ই ১৯৩৩ সালে ৯ই মে গান্ধীজিকে রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণ করিতে অনুরোধ করেন। প্যাটেল ভারতের বাহিরে স্বাধীনতার আন্দোলন চালাইবার জন্য সুভাষের নামে এক লক্ষ টাকা উইল করিয়া যান। প্যাটেলের মৃত্যুর পর সুভাষ তাঁহার মৃতদেহ ভারতে পাঠাইয়া দেন। ভগ্নস্বাস্থ্য স্বত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র বিদেশে ভারতের পক্ষে অনেক আন্দোলন করেন যদিও ইউরোপে তাহাকে অনেকটা নির্ব্বাসিতের মত জীবন যাপন করিতে হয়। ইংলণ্ড, রাশিয়া, জার্মেনি ও যুক্তরাষ্ট্রে যাইবার অনুমতি ছিল না।

 লণ্ডনে ভারতীয়দের একটি সম্মেলনে সুভাষকে সভাপতিত্ব করার জন্য আমন্ত্রণ করা হয় কিন্তু ব্রিটিশ গভর্নমেণ্ট অনুমতি দেওয়ায় সুভাষচন্দ্র লণ্ডনে যাইতে পারেন নাই। ডাঃ ভাট তাঁহার লিখিত অভিভাষণ পাঠ করেন।

 ১৯৩৩ সালে সুভাষ প্রাগ সহরে যান। সেখানে প্রাগের মেয়র সুভাষকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা করেন। তিনি জেনেভায় কিছুদিন ছিলেন। তিনি ফ্রান্স ও ইটালিতেও ভ্রমণ করেন। তিনি রোমে কিছুদিন থাকেন। পরে সোফিয়া, বুদাপেষ্ট, বুখারেষ্টে ভারত সম্বন্ধে অনেক বক্ত‌ৃতা করেন। বেলগ্রেডে ব্রিটিশ রাজদূত তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করেন, অন্যক্ষেত্রে ব্রিটিশের প্রতিনিধি তাঁহার কার্য্যকলাপের উপর কড়া নজর রাখিতেন।

 পিতার মৃত্যু—১৯৩৪ সালে সুভাষের পিতা অসুস্থ হইয়া পড়েন। তিনি বিমানযোগে ৩রা ডিসেম্বর করাচি হইয়া দমদম পৌঁছান, কিন্তু জানকীনাথ পুত্রের পোঁছিবার পূর্বেই মারা যান। সুভাষ তাঁহার অন্তেষ্টি ক্রিয়ায় যোগদান করেন। সুভাষচন্দ্র কয়েকটি সর্তে স্বগৃহে অন্তরীণ থাকেন। ১৯৩৫ সালের ১০ই জানুয়ারী তিনি পুনরায় ইউরোপ যাত্রা করেন।

 ইউরোপ ভ্রমণ—ইউরোপের প্রথম ভ্রমণের পর সুভাষচন্দ্র Indian Struggle নামক একখানি অতি মূল্যবান পুস্তক রচনা করেন। ইহা লণ্ডনে প্রকাশিত হয়। ইহাতে অন্য বিষয় ব্যতীত তাঁহার ইউরোপের বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞতা বর্ণিত হইয়াছে।

 দ্বিতীয় ভ্রমণে তাঁহার রাজনৈতিক মতের অনেক পরিবর্ত্তন হয়। তিনি নেপলস, রোম, ভিয়েনা, জেনেভা ও প্যারি সহরে অবস্থান করেন। রোমে আফগানিস্থানের নির্বাসিত আমীরের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের দেখা হয়।

 বিদেশে অবস্থান কালে সুভাষচন্দ্র একটি বিষয়ে বিশেষ প্রতিবাদ করেন। ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের প্রতিনিধি ও বেতনভুক চরেরা বিদেশে ভারতের মিথ্যা ও কুৎসিৎ বিবরণ দিয়া থাকেন— যেমন “ভারতে অস্পশ্যতাই একমাত্র সমস্যা, ভারতে বিধবাদের জীবন্ত দগ্ধ করা হয়, মেয়েদের পাঁচ ছয় বৎসরে বিবাহ দেওয়া হয়, লোকেরা কাপড় পরিতে জানে না।” বক্ত‌ৃতার জায়গায় কাল বর্ণের অর্ধ উলঙ্গ ভারতবাসীর ছবি দেখান হয়। মাসিক পত্রিকায় নানা প্রকার কুৎসাপূর্ণ প্রবন্ধ বাহির হয়। ভিয়েনার একখানি ছবির পুস্তকে একটি সাধুর মৃতদেহ রাস্তায় কয়েকদিন পড়িয়া আছে এইরূপ ছবি আছে। এই ছবির নীচে লেখা আছে যে সাধারণ লোকে সাধুর মৃত দেহ স্পর্শ করে না। বায়স্কোপে ভারতের কুৎসাকারী ছবি দেখান হয়। 'Bengali' নামক ছবিতে দেখান হয় ব্রিটিশ ভারতের ত্রাণকর্ত্তা। আর একটি ছবিতে দেখান হয় যে মহাত্মা অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় একটি ইউরোপীয় মেয়ের সঙ্গে নৃত্য করছেন। এই সকল অপকর্ম্মের বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্র বিশেষ প্রতিবাদ করেন।

 ১৯২৬ সালে তিনি আয়র্ল্যাণ্ড ডি ভ্যালেরা ও অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাতে উভয় দেশের মধ্যে সৌহার্ধ্য বর্দ্ধিত হয়। ডি ভ্যালেরা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি খুব সহানুভূতি প্রকাশ করেন। ভারতীয় ছাত্র ও অধ্যাপক যাহাতে আয়র্ল্যাণ্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠের সুবিধা পান তদ্বিষয়ে সুভাষচন্দ্র ডি ভ্যালেরার নিকট অনুরোধ করেন।

 ভারতে আগমন ও গ্রেপ্তার—১৯৩৬ সালে লক্ষ্মৌ কংগ্রেসে যোগদান করিবার জন্য সভাপতি জহরলাল জনমতের অভিপ্রায় অনুসারে সুভাষকে ভারতে আগমনের আমন্ত্রণ জানান। ভারত সরকার ইহা জানিতে পারিয়া ভিয়েনার ব্রিটিশ রাজদূত মারফৎ সুভাষচন্দ্রকে জানাইয়া দেন যে যদি সুভাষ ভারতে ফেরেন তবে তাঁহাকে স্বাধীনভাবে থাকিতে দেওয়া হইবে না। সুভাষ এই অন্যায় ব্যবহারের প্রতিবাদে সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করিয়াই কণ্টিভার্ড জাহাজে রওনা হন। ১১ই এপ্রিল বোম্বাই পৌঁছান মাত্রই তাঁহাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং যারবেদা জেলে পাঠান হয়। এই অন্যায় গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন হয়। কংগ্রেসও ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় পরিষদে মুলতুবি প্রস্তাব আনা হয়। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১০ই মে “নিখিল ভারত সুভাষ দিবস" পালিত হয়। বিলাতেও পার্লামেণ্টে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়। ২০শে মে সুভাষকে যারবেদা জেল হইতে কাসিয়াংএর গির্দ্দা পাহাড়ে শরৎচন্দ্রের বাড়ীতে অন্তরীণ রাখা হয়। সেখান হইতে চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে ১৭ই ডিসেম্বর কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ হাঁসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। অবশেষে সুভাষচন্দ্রকে ১৯৩৭ সালে ১৭ই মাচ্চ সুদীর্ঘ পাঁচ বৎসর পর বিনাসর্ত্তে মুক্তি দেওয়া হয়।

 স্বাস্থ্যোন্নতি —তিনি একমাস ডাঃ নীল রতন সরকারের চিকিৎসায় থাকেন। ১লা মে তিনি পাঞ্জাবের ডালহৌসী নামক স্থানে যাত্রা করেন। ডালহৌসীতে ডাঃ ধরমবীরের গৃহে অবস্থানের পর ৭ই অক্টোবর কলিকাতায় ফেরেন। এই সময় তাঁহার স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়। তিনি কিছুদিন কার্শিয়াংতে থাকার পর ১৮ই নভেম্বর স্বাস্থ্য লাভের জন্য পুনরায় তৃতীয়বার ইউরোপ ভ্রমণ করেন। তিনি অষ্ট্রিয়ায় বাদ‍্গাস্তিনে প্রায় ছয় সপ্তাহ চিকিৎসা করান। এইবার তাঁহার সর্বত্র অবাধ গতিবিধি ছিল। তিনি লণ্ডনে বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হন এবং প্রথম বক্ত‌ৃতা দেন।

 হরিপুরা কংগ্রেস—১৯৩৮ সালের কংগ্রেস সভাপতির জন্য বিভিন্ন প্রদেশ হইতে চারজনের নাম প্রস্তাবিত হয়—সুভাষ চন্দ্র, মৌলানা আজাদ, জহরলাল, আবদুল গফরখান। সুভাষচন্দ্রের দেশের জন্য স্বার্থত্যাগের হেতু বাকী তিনজন সুভাষচন্দ্রের অনুকুলে নাম প্রত্যাহার করেন। সুভাষচন্দ্রই সভাপতি মনোনীত হন। ১৯৩৮ সালের ১৪ই জানুয়ারী তিনি বিমানে দেশে পৌঁছান।

 তাপ্তীনদীর তীরে হরিপুরা গ্রামে কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। মহাত্মার নির্দ্দেশে এই প্রথম গ্রামে কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। সভাপতিকে গ্রাম্য কায়দায় অভ্যর্থনা করা হয়। প্যাটেলের স্মৃতির জন্য কংগ্রেসের জায়গাটার নাম হইয়াছিল ‘বিঠল নগর’। ইহা কংগ্রেসের ৫১ তম অধিবেশন সেইজন্য প্যাণ্ডালে ৫১টি গেট ছিল, ৫১টি জাতীয় পতাকা উড্ডীন ছিল। সভাপতিকে ১টি বলদ চালিত সুসজ্জিত রথে শোভাযাত্রা করিয়া আনা হয়। রথের পশ্চাতে ছয়টি গরুর গাড়ীতে নেতারা ছিলেন। একদল বাসন্তী রঙের শাড়ী পরিহিতা বালিকা সভাপতির কপালে কুম্কুম্ পরাইয়া তাঁহাকে বন্দনা করে। শোভাযাত্রায় প্রতি সারে দশ জন লোক ছিল এবং শোভাযাত্রাটি বার মাইল দীর্ঘ হইয়াছিল। বিঠল নগরে প্রায় আড়াই লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। সুভাষচন্দ্র সারাজীবন দেশের জন্য দুঃখ নির্য্যাতন বরণ করেছেন। সেইজন্য দেশবাসী তাঁহাকে শ্রেষ্ঠ সম্মান দেখাইলেন। তখন সুভাষচন্দ্রের বয়স মাত্র ৪১ বৎসর।

 ১৯৩৮ খৃষ্টাব্দে সুভাষচন্দ্রের প্রথমবার সভাপতি থাকা কালে নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি উল্লেখযোগ্য:—(১) উড়িষ্যা, বিহার, যুক্তপ্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিগণের সহিত গভর্ণরের মতভেদ হওয়ায় গভর্ণরের পরাজয়। (২) পার্লামেণ্টারি কার্য্যকলাপে কংগ্রেসের মর্যাদা বৃদ্ধি। (৩) ভারতের আটটি প্রদেশে কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা শাসন ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন। (৪) আসামে কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন। (৫) বহু দেশীয় রাজ্যে কংগ্রেসের নীতি অনুযায়ী অহিংস গণ আন্দোলন আরম্ভ হয়। (৬) হিন্দু মুশলিমের মিলনের জন্য সুভাষচন্দ্র জিন্নার সহিত আলোচনা চালান। (৭) কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটি দীর্ঘকালব্যাপী বাঙ্গালী-বিহারি বিরোধের সমস্যার সমাধান করেন; যথা (ক) বিহারী ও বাঙ্গালীর মধ্যে কোন ব্যাপারে কোনরূপ বৈষম্য থাকিবে না। (খ) বিহারে দীর্ঘকাল বাস করিবার প্রমাণের যে সার্টিফিকেট (Domiciled certificate) লইবার প্রথা ছিল তাহা রহিত হয়। যে কোন ব্যক্তি দশ বৎসর বাস করিলে ঐ প্রদেশে বাসিন্দা বলিয়া গণ্য হইবেন। (গ) ভারতবাসীকে একটি অখণ্ড জাতি হিসাবে গণ্য করার নীতি গৃহীত হয়। (ঘ) ছাত্রসংখ্যা যথোপযুক্ত হইলে সেই ছাত্রদিগেরও মাতৃ ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে।

 ১৩৪৫ সালে ৭ই মাঘ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রপতিকে শান্তিনিকেতনে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা করেন এবং আম্রকুঞ্জে একটি মহতী সভায় তাহাকে অভিনন্দন করেন।

 ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি নির্ব্বাচন ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের ৫২তম অধিবেশন ত্রিপুরীতে হয়। এই অধিবেশনে সভাপতি নির্ব্বাচন, কংগ্রেসের অধিবেশন ও পরের ঘটনাবলী সুভাষচন্দ্রের জীবনে বড়ই বেদনাদায়ক। সুভাষচন্দ্রের মত ত্যাগী দেশ-প্রেমিক নেতার প্রতি কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতাদের এ আচরণ শোভনীয় হয় নাই। নেতাদের মধ্যে মতভেদ সব দেশেই হইয়া থাকে কিন্তু ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি নির্ব্বাচনের ব্যাপার লইয়া সুভাষচন্দ্র ও দক্ষিণপন্থী নেতাদের মধ্যে যে বিবাদ আরম্ভ হয় তাহা কংগ্রেসের ইতিহাসে অচিন্ত্যনীয়। সুভাষচন্দ্রের দোষ তিনি ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের সঙ্গে কোন আপোষ করিতে রাজি নন, কোন নরমপন্থা অবলম্বন করিতে রাজি নন। সুভাষচন্দ্র ছিলেন জবরদস্ত লোক। তাঁহার চরিত্র ছিল অনমনীয়। ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট দেশীয় রাজ্য ও ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চল লইয়া একটি যুক্তরাষ্ট্র প্রবর্ত্তন করিতে চাহেন। সুভাষচন্দ্র ইহার ঘোর বিরোধী ছিলেন। গান্ধী প্রমুখ দক্ষিণপন্থী নেতাগণ ইহার স্বপক্ষে ছিলেন। সেইজন্য দক্ষিণপন্থী নেতাগণ সুভাষকে সভাপতি পদ হইতে তাড়াইতে চাহেন। প্রথমে বিভিন্ন প্রদেশ হইতে সুভাষচন্দ্র, মৌলানা আজাদ ও ডাঃ পটুভি সীতরামিয়ার নাম প্রস্তাব হয়। মৌলানা আজাদ অন্যান্য দক্ষিণপন্থী নেতাগণের পরামর্শে সীতারামিয়াকে সুপারিশ করিয়া নিজের নাম প্রত্যাহার করেন এবং এক বিবৃতি দেন। সুভাষচন্দ্র এক পাল‍্টা বিবৃতি দিয়া তাঁহার বক্তব্য বলেন। সভাপতি সুভাষ বসুরই নিয়োজিত ওয়ার্কিং কমিটির ছয়জন সদস্য সুভাষচন্দ্র যাহাতে নির্ব্বাচিত না হন এবং ডাঃ পট্টভি নির্বাচিত হন কংগ্রেস ডেলিগেটদের নিকট এইরূপ আবেদন করিয়া এক বিবৃতি দেন। এইরূপ বিবৃতি ও পাল‍্টা বিবৃতি দেওয়ায় ডেলিগেটগণ বুঝিতে পারিলেন সুভাষচন্দ্রই ঠিক পথে চলিতেছেন এবং তাঁহার একটা অনুমোদিত নির্দ্দিষ্ট কর্মপন্থা ও নীতি আছে এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা করিবেন। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস কর্তৃপক্ষকে অন্য কোন যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী বামপন্থী নেতাকে সভাপতি করিতে অনুরোধ জানান। কংগ্রেসের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি বন্ধ করিবার জন্য সর্বশেষে তিনি বামপন্থীদের বিশ্বাসভাজন একজন দক্ষিণপন্থীকে সভাপতি করিতে বলেন। ইহাতে কেহই কর্ণপাত করিলেন না কারণ দক্ষিণপন্থীরা জানিতেন যে তাঁহারাই ভোটে জিতিবেন। যাহা হউক ২৯শে জানুয়ারীতে ভোট গ্রহণ হয়। সুভাষচন্দ্র ১৫৮০ ভোট ও পট্টভি ১৩৭৭ ভোেট পান। দক্ষিণপন্থী নেতাদের বিরুদ্ধাচরণ সত্ত্বেও সুভাষ চন্দ্র সকলকে বিস্মিত করিয়া ২০৩ ভোট বেশী পাইয়া সভাপতি নির্ব্বাচিত হন। ইহাতে প্রমাণ হয় সুভাষকে দেশের লোক কতটা সমর্থন করে।

 সভাপতি নির্ব্বাচনের পর—সভাপতি নির্ব্বাচনের পরও যে সকল ঘটনা ঘটে তাহা শোভনীয় হয় নাই। সুভাষচন্দ্র নির্বাচনের ফলাফল সম্বন্ধে বলেন, “আমাদের জয়লাভে নীতি ও আদর্শের জয় হইয়াছে। কংগ্রেসে কোন দলাদলি হইতে দিব না। কংগ্রেস পূর্ব হইতেই ঐক্য বদ্ধ আছে। কংগ্রেসীদের মধ্যে মতভেদ থাকিতে পারে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমরা সকলেই একমত......আমি ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের আস্থাভাজন হইতে চেষ্টা করিব।”

 মহাত্মা গান্ধী নির্বাচন সম্বন্ধে এক বিবৃতি দেন, “আমি গোড়া হইতে তাঁহার (সুভাষচন্দ্রের) নির্বাচনের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলাম। কারণ বর্ণনার প্রয়োজন নাই।...আমার চেষ্টাতেই ডাঃ পট্টভি নির্ব্বাচন হইতে সরিয়া দাঁড়ান নাই। অতএব এই পরাজয় তাঁহার অপেক্ষা আমারই অধিক।...সংখ্যালঘুদের দ্বারা কোন রূপ বাধা সৃষ্টি করা উচিত হবে না। যখন তাঁহারা সহযোগিতা করিতে অসমর্থ হইবেন তখন তাঁহারা সহযোগিতা হইতে বিরত থাকিবেন।...

 মহাত্মার এই বিবৃতির পরে ত্রিপুরী অধিবেশনের পূর্ব্বেই ওয়ার্কিং কমিটির বার জন সদস্য সুভাষচন্দ্রের নিকট পদত্যাগ পত্র দাখিল করেন। জহরলাল পৃথক পত্রে পদত্যাগ করেন। তাঁহাদের উদ্দেশ্য ছিল সুভাষচন্দ্রকে তাঁহার সুস্পষ্ট নীতি অনুসরণে এবং নিজ দল হইতে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্ব্বাচনে স্বাধীনতা দেওয়া। এই সময়ে সুভাষচন্দ্র ১০৩ জরে শয্যাগত, উত্তান শক্তি রহিত। ডাক্তাররা তাঁহাকে কোন কার্য্য করিতে পরামর্শ দেন নাই। এই সঙ্কট মুহূর্ত্তে বারজন সভ্যের পদত্যাগ পত্র দাখিল করা উচিৎ হয় নাই। তাঁহারা ত্রিপুরী কংগ্রেস পর্য্যন্ত ধৈর্য্য ধরিতে পারিলেন না। সুভাষচন্দ্রের যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা ও সংগ্রামাত্মক কর্মসূচীই বিরোধের কারণ। কংগ্রেসের ঐক্য রক্ষাকল্পে সুভাষ যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছিলেন।

 সুভাষচন্দ্র ১৫ই ফেব্রূয়ারী ওয়ার্দ্ধায় মহাত্মার সহিত তিন ঘণ্টা আলোচনা করেন এবং উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি হয় এবং গান্ধীজি তাঁহার পরামর্শ দিতে পরাঙ্ম‌ুখ হইবেন না প্রতিশ্রুত হন। তৎপর বার জন সভ্য অকস্মাৎ পদ ত্যাগ পত্র দাখিল করিলেন। সুভাষচন্দ্র একটু সুস্থ হইয়া পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করিলেন। কৃপালনী কংগ্রেস সম্পাদক ছিলেন। তাঁহার পদত্যাগে সমস্ত কার্য্যই সভাপতি ও অবশিষ্ট সভ্য শরৎ বসুর উপর পড়িল।

 ত্রিপুরীতে অধিবেশন— ত্রিপুরী অধিবেশনের মাত্র দশ দিন বাকী আছে। সুভাষচন্দ্র নিউমোনিয়ায় সংশয়াপন্ন পীড়িত। ৬ই মার্চ্চ চিকিৎসকগণের পরামর্শ উপেক্ষা করিয়া এম্বুলেন্স গাড়ীতে হাওড়ায় আসিয়া বোম্বাই মেলে ত্রিপুরী রওনা হন। কংগ্রেসের অধিবেশনের পূর্ব্বে নিখিল ভারত রাষ্ট্রিয় সমিতির অধিবেশনে পণ্ডিত গোবিন্দ পন্থ মহাত্মা গান্ধীর প্রতি ও ১৯২৯ সালের ওয়ার্কিং কমিটির প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করিয়া এবং গান্ধীর সহিত পরামর্শ করিয়া নুতন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্ব্বাচন করিতে অনুরোধ করিয়া একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সুভাষচন্দ্র সভাপতিরূপে আইনতঃ এই প্রস্তাব বিধি বর্হিভূত ঘোষণা করিতে পারিতেন কিন্তু নিজের ব্যাপার বলিয়া উদারতা দেখাইয়া তিনি এই প্রস্তাব উত্থাপনের অনুমতি দেন। পন্থের প্রস্তাবে পাশ হইল, গান্ধীজীর দল জিতলেন। সুভাষ চন্দ্রের নিউমোনিয়া অসুখ এত বাড়িয়া গেল যে ডাক্তার তাঁহাকে জব্বলপুরে হাঁসপাতালে কিংবা সেবা সদনে পাঠানর পরামর্শ দিলেন। সুভাষচন্দ্র বলিলেন, “আমি জবলপুরে হাঁসপাতালে যাইবার জন্য এখানে আসি নাই। কংগ্রেস শেষ হইবার পূর্ব্বে এখানে মরিব সেও ভাল তবুও অন্যত্র যাইব না।” তিনি অসুস্থতার জন্য শোভাযাত্রায় যোগ দিতে পারিলেন না। কংগ্রেস অধিবেশনেও পন্থের প্রস্তাব গৃহীত হইল। শুনা যায় পন্থের প্রস্তাবে স্বপক্ষে ভোট সংগ্রহের জন্য নরমপন্থীরা সমস্ত রাত তাঁবুতে ক্যানভ্যাস করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র গান্ধীজির সঙ্গে মিটমাটের অনেক চেষ্টা করিলেন। গান্ধীজিকে কলিকাতায় আসিয়া ওয়ার্কিং কমিটির সভ্য নির্ব্বাচিত করিতে অনুরোধ করিলেন। তাহাতেও গান্ধীজি রাজি হলেন না। তৎপর সুভাষচন্দ্র অনেক পত্রালাপ করিলেন। তাহাতেও সমস্যার সমাধান হইল না। যখন কোন ফল হইল না তখন তিনি কলিকাতায় নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশন আহ্বান করেন। এখানে নরমপন্থীরা বিপুল সংখ্যায় জমা হইলেন। সুভাষচন্দ্র যখন সমস্ত আপোষ মীমাংসার কোন আশা দেখিলেন না তখন তিনি পদত্যাগ পত্র দাখিল করিলেন। তাঁহার স্থলে রাজেন্দ্র প্রসাদ সভাপতি নির্ব্বাচিত হন।

 সুভাসচন্দ্র ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দের পর কংগ্রেসের ‘ভিক্ষাং দেহি’ নীতিকে অপছন্দ করিতেন। শক্তিশালী নেতার অধীনে কংগ্রেসকে বিপ্লবাত্মক সংগ্রামশীল প্রতিষ্ঠান করিতে চাহিতেন। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দেশের সমস্ত জনগণকে, সমস্ত দলকে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, হিন্দু, মুসলমানকে যাহাতে এক পতাকাতলে আনিতে পারা যায় এবং যাহাতে অবিলম্বে একটি অহিংস সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়া যায় এইরূপ একটি নির্দ্দিষ্ট নীতি ও কার্যক্রম দেশের সম্মুখে উপস্থাপিত করিতে চাহিয়াছিলেন। এমন নেতার দরকার যিনি তাঁহার ব্যক্তিত্বে দেশের মধ্যে কর্মের প্রবল বন্যা বহিয়ে দিতে পারেন। দেশকে নিষ্ক্রিয়তার পথে টেনে নিতে চাননি। মহাত্মা যতদিন আইন অমান্য আন্দোলন চাইতেছিলেন ততদিন সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কোন মতভেদ হয় নাই। ১৯৩৩ সালে এই আন্দোলন বন্ধ হইবার পর হইতে নরমপন্থা ও চরমপন্থীদের বিরোধ দিন দিন বাড়িতে থাকে।

 সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের কর্তৃপক্ষের আচরণে ও একনায়কত্বে বিরক্ত হইয়া কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া চরমপন্থীদের লইয়া Forward Bloc নামক এক দল গঠন করেন। ইহাদের নীতি হইল সংগ্রামাত্মক, কোন আপোষ মুলক নহে। সুভাষচন্দ্রের উদ্দেশ্যে ছিল—ছাত্র, কৃষাণ, শ্রমিক, সমাজতন্ত্রী, সাম্যবাদী সব একত্র করা এবং এক নির্দ্দিষ্ট নীতিতে কাজ করা। স্বাস্থ্য লাভের পর সুভাসচন্দ্র ভারতের সর্বত্র নৃতন দলের নীতি ও কার্যক্রম বিষয়ে বক্ত‌ৃতা দেন এবং ভারতের সর্বত্র Forward Bloc এর শাখা স্থাপিত হয়। কলিকাতা নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি দুইটি প্রস্তাব পাশ করেন যথা:—(১) প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির অনুমতি ভিন্ন কোন প্রদেশের কেহ বা কোন প্রতিষ্ঠান সত্যাগ্রহ করিতে পারিবে না। (২) দ্বিতীয় প্রস্তাবে কংগ্রেস মন্ত্রীদের সহিত কংগ্রেস কমিটিগুলির সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। সুভাষচন্দ্র এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন যে এই প্রস্তাব নিয়মতান্ত্রিকতাকে প্রশ্রয় দিবে, কংগ্রেসের উপর মন্ত্রীদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াইবে এবং কংগ্রেস জন সাধারণ হইতে পৃথক হইয়া পড়িবে। এই সকল কারণে তিনি সর্ব্বত্র এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা আহ্বান করেন। সুভাষচন্দ্র বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতিরূপে দুইটি প্রস্তাবের বিরুদ্ধাচরণ করেন। রাজেন্দ্রপ্রসাদ ওয়ার্দ্ধায় ওয়ার্কিং কমিটিকে আহ্বান করেন। এই অধিবেশনে কমিটি সুভাষচন্দ্রকে বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হইবার এবং তিন বৎসরের জন্য যে কোন কংগ্রেস কমিটির সভ্য হইবার অযোগ্য মনে করেন। হায়! অদৃষ্টের পরিহাস! কিন্তু বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি তাঁহাকে সভাপতি নির্ব্বাচিত করেন। ফলে ওয়ার্কিং কমিটি বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটিকে পর্যন্ত বাতিল করিয়া দেন।

 সুভাষচন্দ্র কোন জাতীয় অপমান সহ্য করিতে পারিতেন না। ইতিহাসে নবাব সিরাজদ্দৌলার কর্তৃক অন্ধকূপ হত্যার অনুষ্ঠান মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। তিনি সিরাজদ্দৌলার মিথ্যা কলঙ্কের নিদর্শন হল ওয়েল মনুমেণ্ট অপসারণের জন্য আন্দোলন করেন। সেইজন্য বাংলা সরকার ভারত রক্ষা আইনানুসারে তাহাকে অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য হাজতে রাখে কিন্তু বিপুল আন্দোলনের ফলে বাংলা সরকার মনুমেণ্ট অপসারিত করিতে বাধ্য হয়। কারাবাস অবস্থায় তিনি উপনির্ব্বাচনে ভারতীয় কেন্দ্রীয় পরিষদে সভ্য নির্ব্বাচিত হন। হাজতে তাঁহার স্বাস্থ্যের পুনরায় অবনতি ঘটে। হাজতে থাকা কালে সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা আনা হয়। একটি কলিকাতায় মহম্মদ আলি পার্কে বক্ত‌ৃতা দেওয়ার জন্য, অপরটি Forward Bloc কাগজে ‘Date of Reckoning’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখার জন্য। সুভাষচন্দ্র তাঁহাকে পর পর বিনাবিচারে অনির্দ্দিষ্ট কাল আটক রাখা অত্যন্ত অন্যায় মনে করিলেন। তিনি ইহার প্রতিবাদে আমরণ অনশন করিতে মনস্থ করিলেন। তৎপূর্ব্বে তিনি বাংলা সরকারকে একখানি আবেগপূর্ণ করুণ পত্র দেন। ইহা হইতে বুঝা যাইবে যে বিনাদোযে কি অমানুষিক অন্যায় ব্যবহার তাঁহার উপর হইয়াছে! এই পত্রের অনুবাদ করিয়া কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত হইল।


ঐতিহাসিক পত্র

 “আমার কোন আশা নাই যে আমি সরকারের নিকট হইতে কোন প্রতিকার পাইব। আমার প্রথম অনুরোধ আমার এই পত্রখানি বাংলা সরকার তাহাদের সরকারি দপ্তরখানায়, রক্ষা করিবেন। এই পত্রের মধ্যে দেশবাসীর প্রতি আমার শেষ বাণী আছে এবং ইহা ‘আমার রাজনৈতিক বাইবেল’ স্বরূপ। বাংলা সরকার আমার সহিত স্পষ্টতঃ বে-আইনী ও অসঙ্গত ব্যবহার করিতেছেন। এই অদ্ভ‌ুত আচরণের একমাত্র কৈফিয়ত আমার মনে হয় যে বাংলা সরকার কোন অজ্ঞাত কারণে আমার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ মূলক নীতি অবলম্বন করিয়াছেন।”

 “...অন্যায় করার চেয়ে অন্যায় সহ্য করা অধিক পাপ। সুতরাং আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করিব। সাধারণ প্রতিবাদ কাগজে বা সভাতে আন্দোলন, সরকারের নিকট আবেদন নিবেদন, পরিষদে মুক্তির দাবি, আইনের আশ্রয়—সবই নিস্ফল হয় নাই কি? এখন বন্দীদের হাতের শেষ অস্ত্র অনশনে প্রাণ ত্যাগ। আমি জানি ইহাতে কোন ফল হইবে না। টেরেন্স ম্যাকসুইনি ও যতীন দাসের দৃষ্টান্ত আমার মানস চক্ষে ভাসিতেছে। (ইহার দুইজনে জেলে অনশনে প্রাণত্যাগ করেন।)”

 “বর্তমান অবস্থায় আমার জীবন দুর্ব্বিষহ হইয়াছে। অবিচার ও অন্যায়ের সঙ্গে অনবরত আপোষ করিয়া জীবনের মূল্য ক্রয় করা আমর ধাতে সয় না। এইরূপ মূল্য দেওয়ার চেয়ে মরণ শ্রেয়ঃ। ......আমি বলি “হয় আমাকে মুক্তি দাও না হয় আমি মরিব”।...যদিও আমার মৃত্যুতে এখনই কোন বাস্তব ফল হইবে না তবুও কোন ত্যাগই বৃথা যায় না। কেবল ত্যাগ ও কষ্টের মধ্যে দিয়েই কোন মহৎ উদ্দেশ্য সফল হয়। সর্ব দেশে সর্বকালে শহীদের রক্ত হইতেই নূতন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।”  “এই মরজগতে সকলই ধ্বংস প্রাপ্ত হয় ও হইবে কেবল ভাব আদর্শ, স্বপ্ন ধ্বংস হইবে না। একজন মানুষ একটা আদর্শের জন্য মরিতে পারে কিন্তু তাহার মৃত্যুর পর সেই আদর্শ সহস্র জীবনে মূর্ত্ত হইয়া উঠে।...এই উপায়ে এক যুগের আদর্শ ও স্বপ্ন অন্য যুগকে প্রভাবান্বিত করে। পৃথিবীতে কোন আদর্শ ই কষ্ট ও ত্যাগের অগ্নিপরীক্ষা ছাড়া সফল হয় নাই।”

 “একটি আদর্শের জন্য জীবন ধারণ করেছি এবং মৃত্যু বরণ করেছি—এই নিশ্চিত চিন্তার চেয়ে মানুষের পক্ষে আর বেশী কি সান্তনা থাকিতে পারে? তাঁর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করিতে শত শত লোক সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হইবে—এই জ্ঞান অপেক্ষা আর কি আত্মতৃপ্তি হইতে পারে? তাঁর বাণী তাঁর আদর্শ দেশের প্রত্যেক স্থানে পর্ব্বতে উপত্যকায় সমভূমিতে এমন কি সমুদ্র পারে দূরাঞ্চলেও নীত হইবে—এই নিশ্চয়তার চেয়ে কি পুরস্কার আত্মা কামনা করে? কোন আদর্শের বেদীমূলে জীবন বিসর্জ্জন অপেক্ষা মানব জীবনের আর কি কাম্য আছে? মানুষ যদি ত্যাগ ও কষ্টের দ্বারা পার্থিব জীবনে কিছু ক্ষতিগ্রস্থ হয় তবে সে প্রতিদানে অমর জীবনের উত্তরাধীকারী হইয়া লাভবান হইবে। ইহাই আত্মার নীতি। জাতিকে বাঁচাইতে হইলে মৃত্যু চাই। ভারত স্বাধীন হইয়া গৌরবের সহিত যাহাতে বাঁচে সেজন্য আমাকে আজ মরিতে হইবে।

 “দেশবাসীকে আমি বলি—ভুলিও না মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড় অভিশাপ পরাধীন হয়ে থাকা। ভুলিও না অন্যায় ও অবিচারের সঙ্গে আপোষ করা মহাপাপ। সনাতন নিয়ম মনে রাখিও যে যদি কোন জিনিষ পেতে চাও তবে স্বার্থত্যাগ করিতে হইবে। মনে রাখিও যে কোন মূল্য দিয়ে অবিচারের সহিত যুদ্ধ করাই পরম ধর্ম।

 “গভর্ণমেণ্টকে আমি বলি—“অবিচারের ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির পথ পরিত্যাগ করুন। এখনও ফিরিবার সময় আছে।”

 “আমার শেষ অনুরোধ—আপনারা আমাকে শান্তিভাবে মরিতে দিবেন। জোড়পূর্ব্বক কোন বাধা দিবেন না। যতীন দাস, টেরেন্স ম্যাকাসুইনি ও মহাত্মা গান্ধীর অনশন ধর্মঘটের সময় যে রকম কোন বাধা দেন নাই, আমার বিষয়ে সেইরূপ কোন বাধা পাইব না। যদি জোড়পূর্ব্বক আমাকে খাওয়ানর চেষ্টা হয় তবে আমি সমস্ত শক্তি দিয়া তাহা রোধ করিব। আমি ১৯৪০ সালের ২০শে নভেম্বর হইতে অনশন আরম্ভ করিব।”

 পত্রে এই সাবধান বাণী দেওয়ার পর যখন সুভাষচন্দ্র সত্যই অনশন ব্রত আরম্ভ করেন গভর্ণমেণ্ট তাহাকে মুক্তি দেন। এবং তাঁহার আরোগ্যলাভ পর্যন্ত তাঁহার বিরুদ্ধে আনীত মামলা মুলতুবি থাকে।

 জীবনে আধ্যাত্মিক পরিবর্ত্তন ও অকস্মাৎ অন্তর্ধান—মুক্তিলাভের পর সুভাষচন্দ্রের জীবনে এক অভাবনীয় পরিবর্ত্তন আসে। গভর্ণমেণ্টের নির্দয় অত্যাচারে বিনাবিচারে বিনাদোষে ক্রমাগত কারাবাসে এবং কংগ্রেস নেতাদের অশোভনীয় ব্যবহারে কর্ম্মজীবনের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ হন। এই সময় তিনি বর্হিজগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া বাড়ীর দোতলায় নিজের ঘরে নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকিতেন। এই সময় তিনি সম্পূর্ণ মৌন ব্রত অবলম্বন করেন, কাহারও সঙ্গে এমন কি বাড়ীর কোন লোকের সঙ্গেও দেখা সাক্ষাৎ করিতেন না। তিনি তপস্বীর ন্যায় পূজা ও গভীর ধ্যানে সময় অতিবাহিত করিতেন। যিনি দিবারাত্রি বাহিরের কর্মের মধ্যে ডুবিয়া থাকিতেন হঠাৎ তিনি সকল কর্ম্ম হইতে অবসর লইয়া আত্মচিন্তায় মগ্ন হইলেন—ইহাতে সকলেই বিস্মিত হইলেন। তিনি অন্তর্ধানের পূর্বে কয়েক দিবস মাত্র ফলের রস ও দুধ পান করিতেন। হঠাৎ ১৯৪১ সালের ২৬শে জানুয়ারী (ভারতের স্বাধীনতা দিবস) সংবাদ পাওয়া গেল সুভাষচন্দ্র অসুস্থ অবস্থায় তাঁহার বাড়ী হইতে রহস্যজনকভাবে অন্তর্ধান করিয়াছেন। যে দিন অন্তর্ধান করেন সেই দিন তাহার ঘরে ব্যাঘ্রচর্ম্মের উপর একখানি গীতা ও ৺কালীর ছবি পাওয়া যায়। প্রায় একবৎসর তাঁহার অন্তর্ধানের কোন কুল কুনার। হইল না—কোথায় গেলেন বা কি উপায়ে গেলেন। কেহ ভাবিলেন যে রাজনীতিতে বাতশ্রদ্ধ হইয়া সন্ন্যাস-ব্রত অবলম্বন করিয়াছেন; কেহ ভাবিলেন তিনি বিদেশে আশ্রয় লইয়াছেন। সর্বপ্রথমেই ভারতে Council of State এ এবং বিলাতে House of Commonsএ গভর্ণমেণ্টের তরফ হইতে বলা হয় যে সুভাষচন্দ্র খুব সম্ভব বার্লিনে কিংবা রোমে আছেন। এই সংবাদের সূত্র ছিল রোম, বার্লিন ও টোকিও রেডিও হইতে প্রাপ্ত সংবাদ। এইরূপ আনুমানিক সংবাদের উপর নানারূপ জল্পনাকল্পনা ও গবেষণা চলিতে থাকে। হঠাৎ ১৯৪২ সালে ২৮শে মার্চ্চ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংবাদদাতা রয়টার সংবাদ দিলেন— “টোকিও রেডিওতে বলেছে যে সুভাষচন্দ্র স্বাধীন ভারত কংগ্রেসে যোগ দিবার জন্য টোকিও যাইবার পথে জাপানের উপকূলে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হইয়াছেন”। পরদিনই রয়টার জানান যে এই সংবাদ ভূল। সুভাষচন্দ্র বেঁচে আছেন। যাহা হউক এক্ষণে জানা গিয়াছে যে সুভাষচন্দ্র ভারত হইতে আফগানিস্থানের পথে বা অন্য কোন উপায়ে বার্লিন যান। সেখানে হিটলার তাঁহাকে India's Fuehrer and Excellence উপাধি দেন। সুভাষচন্দ্র অক্ষশক্তির সঙ্গে ভারতকে স্বাধীন করবার জন্য একটি চুক্তি করেন। তৎপর তিনি ডুবোজাহাজে জাপানে যান। আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করিয়া ব্রিটিশের সঙ্গে লড়াই করেন। তৎপর জাপান পরাজিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজও আত্মসমর্পণ করে। এইরূপ সংবাদ পাওয়া যায় যে সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুর হইতে বিমানে টোকিও যাইবার পথে বিমান দুর্ঘটনায় সাংঘাতিকভাবে আহত হইয়া হাঁসপাতালে মারা যান। কিন্তু এই সম্বন্ধে পরস্পর বিপরীত সংবাদ আসিতেছে। তিনি মৃত কি জীবিত সঠিক কিছু জানা যায় নাই।

 চারিদিকে গোয়েন্দা ও পুলিশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় কি উপায়ে সুভাষচন্দ্র সকলের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া ব্রিটীশ সিংহের কবল হইতে পলাইতে পারিয়াছিলেন তাহা এখনও রহস্যাবৃত আছে। মহারাষ্ট্রের “পার্বত্য মুষিক” দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাট আলমগীরের কয়েদ খান হইতে সকলের চক্ষে ধূলি দিয়া ফলের ঝুড়ির মধ্যে পাইতে সক্ষম হইয়াছিলেন। সেখানে সেয়ানে কোলাকুলি!

সুভাষচন্দ্রের জীবনের প্রধান ঘটনাবলী।

জন্ম—১৮৯৭ খৃষ্টাব্দ ২৩শে জানুয়ারী
ইউরোপীয়ান স্কুলে পাঠ-১৯০২ খ্রঃ হইতে ১৯০৯ খৃঃ পর্যন্ত
যাঁভেন্শা স্কুলে ,, —১৯০৯ খৃঃ হইতে ১৯১৩ খৃঃ পর্যন্ত
আই, এ ক্লাশে ,, -১৯১৩ খৃঃ হইতে ১৯১৫ খৃঃ পর্যন্ত
ছয় মাসের জন্য গৃহত্যাগ-১৯১৪ খৃঃ।
বি, এ ক্লাসে পাঠ-১৯১৫ খৃঃ, ১৯১৭ খৃঃ-১৯১৯ খৃঃ
ওটেনের ব্যাপারে বহিষ্কার—দুই বৎসর
বিলাত যাত্রা (পাঠের জন্য)—১৯১৯ খৃঃ ডিসেম্বরে
আই, সি, এস পাশ—১৯২০ খৃঃ আগষ্ট
আই, সি, এস ত্যাগ—১৯২৯ খৃঃ মে
কেজি Tripos-১৯২১ খৃঃ মে
জাতীয় বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ-১৯২১ খৃঃ
ভারতে যুবরাজ বয়কট—১৯২১ খৃঃ ১৭ই নভেম্ভর
প্রথম কারাদণ্ড (ছয়মাস)—১৯২২ খৃঃ মাচ্চ
উত্তরবঙ্গ প্লাবনের কার্য—১৯২২ খৃঃ

বঃ প্রাঃ কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক—১৯২৩ খৃঃ
করপোরেশনের প্রঃ কর্ম্মকর্ত্তা—১৯২৪ খৃঃ
মান্দালয় জেলে—১৯২৫ খৃঃ জানুয়ারী—১৯২৭ খৃঃ মে

নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির সম্পাদক
১৯২৭—১৯২৯ খৃঃ

নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কগ্রেসের সভাপতি
১৯২৯ খৃঃ—১৯৩১ খৃঃ

নয় মাস কারাদণ্ড
১৯৩০ খৃঃ জানুয়ারী

করপোরেশনের মেয়র
১৯৩০ খৃঃ আগষ্ট

সাতদিনের কারাদণ্ড
১৯৩১ খৃঃ জানুয়ারী

ছয়মাসের কারাদণ্ড
১৯৩২ খৃঃ

অল‍্ডারম্যানের পদত্যাগ
১৯৩১ খৃঃ

তিন আইনে কারাবাস
১৯৩২ খৃঃ জাঃ—১৯৩৩ খৃঃ ফেঃ

ইউরোপে অবস্থান
১৯৩৩ খৃঃ মার্চ্চ—১৯৩৬ খৃঃ

তিন আইনে কারাবাস
১৯৩৮ খৃঃ

হিরাপুর কংগ্রেসের সভাপতি
১৯৩১ খৃঃ

ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি
১৯৩৯ খৃঃ

সভাপতির পদ ত্যাগ
" 

কংগ্রেস হইতে বহিষ্কার
১৯৩৯ খৃঃ আগষ্ট

ভারত রক্ষা আইনে গ্রেপ্তার
" 

মুক্তি
১৯৪০ খৃঃ

অন্তর্ধান
১৯৪১ খৃঃ জানুয়ারী

 সুভাষচন্দ্র লাহোর, পাবনা, হুগলী, বেরার, যশোহর প্রভৃতি মুক্তি বহু স্থানের যুব সম্মেলনের ও নবযোয়ান সম্মেলনের এবং মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক রাষ্ট্রিয় সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন।

 সুভাষচন্দ্রের জীবন অসীম কষ্ট ও উগ্র ত্যাগের মধ্য দিয়া একটি আদর্শকে সফল করিবার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত জীবন। সেই আদর্শ ছিল ভারতের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার বেদীমূলে সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য জীবনের সকল আশা-ভরসা সকল চিন্তা ভাবনা সকল কর্ম্ম এমন কি নিজের যৌবনকে পর্যন্ত বিসর্জ্জন দিয়াছিলেন। বিবাহ করিলে পাছে পরিবারবর্গের চিন্তার জন্য দেশসেবায় একনিষ্ঠতার অভাব ঘটে সেইজন্য তিনি চিরকুমার থাকেন। তিনি সংসারে থাকিয়া তপস্বীর মত জীবন নির্ব্বহ করিতেন। তাঁর মনোবল ছিল অসীম। সকল নেতার জীবনে দেখা যায় কখন না কখন কিছু পরিবর্ত্তন ঘটে। সুভাষচন্দ্রের মত আজীবন একনিষ্ঠ দেশসেবক খুব কমই দেখা যায়। তাঁর ভগবানে যেমন অসীম ভক্তি ছিল তেমনি তিনি আত্মশক্তিতে খুব বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর এই সকল শক্তির উৎস ছিল আধ্যাত্মিক জীবন ও নিষ্কলঙ্ক চরিত্র। কূট রাজনীতি জ্ঞান, সংগ্রামাত্মক মনোভাব সকলই তাহার ছিল অসাধারণ রকমের।