বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/ভারতের বাহিরে বাঙ্গালীর স্থান

উইকিসংকলন থেকে

ভারতের বাহিরে বাঙ্গালীর স্থান

 বাঙ্গলা দেশ রত্ন-প্রসবিনী। রাজা রামমোহন রায় ও পণ্ডিত ঈরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ন্যায় মহৎ ব্যক্তিগণ বাঙ্গলাদেশে জন্মগ্রহণ করিয়া বাঙ্গালীর মুখ উজ্জ্বল করিয়া গিয়াছেন। সাহিত্য-সম্রাট এবং দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্রকে উপন্যাস জগতে স্যার ওয়াল্টার স্কট এবং দার্শনিকগণের মধ্যে হার্বাট স্পেন্সার এবং জন ষ্টুয়ার্ট মিলের সহিতই তুলনা করা করা চলে। মহামতি গোপাল কৃষ্ণ গোখেল ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে আইন-সচিব ডাক্তার রাসবিহারী ঘোষ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিজ্ঞানাচার্য্য জগদীশ্চন্দ্রকে বাঙ্গলাদেশের অলঙ্কার বলিয়া সমগ্র বাঙ্গালী জাতির মস্তকে জয়মাল্য দিয়াছেন।[১] সুদুর সাগরপারেও তাঁহাদের প্রতিভা অসামান্য খ্যাতির কারণ হইয়াছে। স্বনামধন্য বাগ্নীপ্রবর সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিলাতে গিয়া ওজস্বিনী ভাষায় যে বক্তৃতা দিয়াছিলেন, তাহা শুনিয়া বিলাতের পণ্ডিতমণ্ডলী তাহাকে প্রাচীন রোমের বিখ্যাত বক্তা Cicero এবং প্রাচীন গ্রীসের সুপ্রসিদ্ধ বাগী Demosthenesএর সহিত তুলনা করিয়াছিলেন।

 তারপর যখন আমরা দেখি স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্ম্মসভায় গিয়া সভ্যজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মনস্বীগণকে উপনিষদগীতার বাণী শুনাইয়া আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করিলেন এবং যখন দেখি তাহার প্রশংসাগানে আমেরিকার আকাশ বাতাস মুখরিত হইতে লাগিল, তখনই মনে করিলাম বাঙ্গালা দেশে জন্মগ্রহণ করিয়া আমরা ধন্য হইয়াছি।[২]

 বিজ্ঞান জগতে স্যার জগদীশচন্দ্র যে খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন, বাঙ্গলার নয়—সমগ্র ভারতবর্ষের গৌরবস্থল হইয়াছে। বস্তুতঃ বিজ্ঞানের কেন্দ্রস্থল জার্ম্মাণি, ফ্রান্স, ইংলণ্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশের শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকগণের সমক্ষে বেদীগ্রহণ করিয়া নানা প্রচলিত মতবাদের ভ্রমপ্রদর্শন, এবং তাহাদের উত্থাপিত যুক্তি সকলের অসারতা প্রতিপাদন কেবল জগদীশচন্দ্রের গৌরবের কথা নহে, এই ব্যাপারে সমগ্র ভারত গৌরবান্বিত হইয়াছে। লিভারপুলে ব্রিটিশ এসোসিয়েশনের সভায় অদৃশ্য আলোক সম্বন্ধে তিনি যে বক্তৃতা দেন তাহা শুনিয়া তত্রত্য প্রধান বৈজ্ঞানিকগণ শতমুখে এই বাঙ্গালী যুবকের যশোগান করিয়াছিলেন। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক লর্ড কেলভিন এবং অলিভার লজ জগদীশচন্দ্রকে বিলাতেই অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন।

 প্যারিসে আন্তর্জ্জাতিক (international) কংগ্রেসের অধিবেশন উপলক্ষে তিনি একটি সারগর্ভ বক্তৃতা দিয়াছিলেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল “জীব ও জড় পদার্থের উপর বৈদ্যুতিক সাড়ার সমত্ব।” জার্মাণ, ফরাসী, ইংরাজ, ইতালি প্রভৃতি পাশ্চাত্য দেশের বহু পণ্ডিতমণ্ডলীর সভায় বক্তৃতা দিয়া আত্মপ্রতিষ্ঠা স্থাপন করিয়াছিলেন জগৎপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ডাক্তার জগদীশচন্দ্র বোস। সেদিন বাঙ্গলার গৌরব জগদীশচন্দ্র জন্মভূমির মৃতপ্রায় শরীরে সঞ্জীবনী-সুধা বর্ষণ করিয়া নব জীবন সঞ্চার করিয়াছিলেন।

 ভারতের পূর্ব্বতন গভর্ণর জেনারল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১৩ সালে বিলাত হইতে জগদীশচন্দ্রকে লিখিয়াছিলেন, “আমার অত্যন্ত আনন্দের বিষয় এই যে সমগ্র ইউরোপের গবেষণা কার্যে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছেন ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান। ইহাতে ভারতের গৌরব বহু পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছে!”

 ঋষিকল্প মহাপুরুষ অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিজ্ঞানের গবেষণায় জগদ্বিখ্যাত হইয়াছেন। রসায়ন জগতে তাহার দান অমূল্য একথা সুধীগণ সকলেই স্বীকার করিয়া থাকেন। প্রফুল্লচন্দ্রের প্রণীত “হিন্দু রসায়নের ইতিহাস” রসায়ন শাস্ত্র সম্বন্ধে যুগান্তর উপস্থিত করিয়াছে। হিন্দু আয়ুর্ব্বেদ, চরক, সুশ্রুত, বাগভট, বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, ইতিহাস, কাব্য, দর্শন প্রভৃতি মন্থন করিয়া তিনি এই অভিনব গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন। এই গ্রন্থ প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার যশঃ দিগদিগন্তে ছড়াইয়া পড়িয়াছে।

 বহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের বিশ্ব-বিমোহিনী বক্তৃতা শ্রবণ করিয়া একসময়ে ইংলণ্ডের জনসাধারণ বিস্ময়াভিভূত হইয়াছিল। তত্রত্য বিদ্বান ও ধার্মিক ব্যক্তিগণ ধর্ম্মবিষয়ে তাঁহার সহিত আলাপ আলোচনা করিয়াছিলেন। তিনি সেণ্টজেমস্ হলে পাঁচ হাজার শ্রোতার সম্মুখে ‘সুরাপনি নিবারণ' বিষয়ে তীব্র ভাষায় এক বক্তৃতা দিয়াছিলেন। ‘ভারতের প্রতি ইংলণ্ডের কর্ত্তব্য’ বিষয়ে তাঁহার বক্তৃতা শুনিয়া বিলাতে মহা আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। ‘যিশুখ্রিষ্ট ও খ্রীষ্টান ধর্ম্ম' বিষয়ে কেশবচন্দ্রের বক্তৃতা শুনিয়া ইংরাজগণ মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করিয়াছিলেন। ইংলণ্ডের এক জনসভায় একবার তাঁহাকে extempore (পূর্ব্বে প্রস্তুত না হইয়া) বক্তৃতা দিবার জন্য আহ্বান করা হয়। তিনি বক্তৃতামঞ্চে উঠিয়া শুনিলেন বক্তৃতার বিষয় বস্তু শূন্য (nothing) তিনি এই দুরূহ বিষয়েই গবেষণাপূর্ণ এমন এক বক্তৃতা দিয়াছিলেন যে সমবেত জনমণ্ডলী তাহার পাণ্ডিত্য দেখিয়া বিস্ময়াভিভূত হইয়াছিল। তিনি লণ্ডনে উপস্থিত হইলে স্বয়ং মহারাণী ভিক্টোরিয়া তাহাকে আপন প্রাসাদে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন এবং পুস্তকাদি দিয়া সম্মানিত করিয়াছিলেন।

 উপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগ্রন্থ কেবল বাঙ্গলা দেশেই যুগান্তর আনয়ন করিয়াছিল তাহা নহে, তাঁহার বিষবৃক্ষ প্রভৃতি উপন্যাস ইংরাজি ও অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হইয়া পাশ্চাত্য জগতে যথেষ্ট সমাদর লাভ করিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের অমর সঙ্গীত “বন্দেমাতরম্‌” স্বদেশীযুগে বিলাতের উচ্চপদস্থ রাজপুরুষগণের হৃদয়েও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিয়াছিল। ইংরাজ কবি Grey ‘Elegy' ও অন্যান্য কবিতা রচনা করিয়া যশস্বী হইয়াছেন। সমালোচকগণ বলিয়া থাকেন তিনি যদি একমাত্র ‘Elegy কবিতাটি ভিন্ন আর কোনও কবিতা রচনা না করিতেন তাহা হইলেও তাহার নাম কাব্যজগতে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিত। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ সন্ধেও একথা নিঃসঙ্কোচে বলা যাইতে পারে। একমাত্র এই জাতীয় সঙ্গীতের জন্যই সমগ্র বাঙ্গালীজাতি তাঁহাকে হৃদয়-মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করিয়া চিরদিন পূজার অর্থ প্রদান করিত। বস্তুতঃ এরূপ দেশাত্মবোধপূর্ণ জাতীয় সঙ্গীত জগতের আর কোনও ভাষায় রচিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়না।

 বিশ্বের দরবারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের দান অতুলনীয়। তাঁহার অমর গ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’ ইংরাজিভাষায় অনূদিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই তাহার যশঃ সমগ্র ইংলণ্ডে পরিব্যাপ্ত হয়। তৎপরে সুধীগণের বিচারে এই গ্রন্থ তদানীন্তন গীতিকাব্যগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত হইলে তিনি যখন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত হন, তখন তাহার কবি-প্রতিভা দর্শন করিয়া সমস্ত সভ্যজগৎ তাঁহার শিরে জয়মাল্য প্রদান করে।

 মহাকবি কালিদাসের ‘শকুন্তলা’, ‘মেঘদূত’ প্রভৃতি অমূল্য গ্রন্থসকল পাঠ করিয়া সুধীগণ তাঁহাকে ইংরাজকবি সেক্‌সপিয়ারের সহিত তুলনা করিয়াছেন। তাঁহার রচিত কাব্যগ্রন্থ সকল এখন সমগ্র জগতের সম্পত্তি বলিয়া গণ্য হইয়াছে। এই জন্যই তাঁহার উদ্দেশে বলা হইয়া থাকে—

“ভারতের কালিদাস জগতের তুমি”

 রবীন্দ্রনাথও ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য প্রণয়ন করিয়া সমগ্র জগতে ‘বিশ্বকবি’ নামে অভিহিত হইয়াছেন।

 “বন্দেমাতরম্” সংবাদপত্রের স্রষ্টা পণ্ডিচেরির ঋষি অরবিন্দের নাম অধুন। সভ্যজগতে বিস্তৃত হইয়াছে। ভারতে প্রত্যাবর্তন করিবার পূর্ব্বে তিনি যখন বিলাতে অবস্থান করিতেছিলেন, তৎকালে তাঁহার লিখিত সুচিন্তিত প্রবন্ধ সকল পাঠ করিয়া এবং তাঁহার ওজস্বিনী ভাষা, ভাবের গভীরতা ও যুক্তির সারবত্তা দেখিয়া ইংলণ্ডের পণ্ডিতমণ্ডলী চমৎকৃত হইয়াছিলেন। বিশিষ্ট সমালোচকগণ বলিয়াছিলেন তাঁহার লিখিত প্রবন্ধ সকল প্রসিদ্ধ লেখক ‘জন মর্লে’ অথবা ‘ম্যাথু আরণল্ডের’ লিখিত প্রবন্ধ সকল অপেক্ষা কোনও অংশে নিম্নস্তরের নহে।[৩] ইঁহার “Essays on the Gita” এবং “The Life Divine” অতি উচ্চস্তরের গ্রন্থ। এই পুস্তকদ্বয় প্রণয়ন করিবার অতি উচ্চস্তরের গ্রন্থ। এই পুস্তকদ্বয় প্রণয়ন করিবার পরে তাঁহার খ্যাতি সমগ্র সভ্যজগতে বিস্তৃত হইয়াছে।[৪]

 ভারতের বাহিরে যে সকল বাঙ্গালী গুরুদায়িত্বপূর্ণ কার্যে নিযুক্ত হইয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছেন, লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ তাঁহাদের অন্যতম। ১৯১৪—১৮ সালের বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় মহাসমর কালে সামরিক মন্ত্রণা সমিতির (War-Conference) সদস্যরূপে ইনি বিলাত গমন করেন। বিকানীরের মহারাজা তাঁহার সঙ্গী ছিলেন। মহাযুদ্ধের অবসানে যখন সন্ধি বৈঠক (Peace Conference) বসে তখন ভারত গভর্ণমেণ্টের প্রতিনিধিরূপে তিনি তাহাতে যোগদান করেন। অতঃপর ইংলণ্ডে গমন করিলে ইনি লর্ড উপাধিতে ভূষিত হইয়া সরকারি ভারত সচিবরূপে পার্লামেণ্ট মহাসভায় আসন গ্রহণ করেন। এইরূপ উচ্চপদ ও গৌরবজনক উপাধি কোনও ভারতবাসী ইতিপূর্বে প্রাপ্ত হন নাই।

 সমগ্র পৃথিবীতে যে সকল ভাষাবিৎ পণ্ডিত জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, পণ্ডিত হরিনাথ দে তাঁহাদের অন্যতম। ইনি ল্যাটিন ও গ্রীক ভাষায় এম, এ, পরীক্ষা দিয়া উচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। এই অসাধারণ প্রতিভাশালী পুরুষ কেম্ব্রিজ, জার্ম্মাণি এবং ফরাসী দেশে অবস্থান করিয়া ইউরোপীয় প্রায় সমস্ত ভাষাই শিক্ষা করিয়াছিলেন, এবং ল্যাটিন ও গ্রীকভাষায় কবিতা রচনা করিয়া লর্ড চ্যান্সেলরের পদক প্রাপ্ত হন। পণ্ডিত হরিনাথ পালি, বৈদিক-সংস্কৃত এবং সাধারণ সংস্কৃত ভাষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হইয়া এম, এ, পাশ করেন। তেত্রিশটি ভাষায় ইঁহার অধিকার ছিল।

 খনা, লীলাবতী, গার্গী, আত্রেয়ী প্রভৃতি শিক্ষিতা প্রাচীন মহিলাগণ একসময়ে এই ভারতভূমিতে জন্মগ্রহণ করিয়া এদেশকে পবিত্র করিয়াছিলেন। আজ বাঙ্গালী রমণী শ্রীমতী সরোজিনী নাইডু স্বীয় প্রতিভাবলে বিদেশীয়গণের নিকটেও পূজার অর্ঘ্য প্রাপ্ত হইয়াছেন। ইঁহার রচিত দুইখানি ইংরাজি কবিতা পুস্তক[৫] ইংলণ্ডের প্রসিদ্ধ সমালোচকগণ কর্তৃক উচ্চকণ্ঠে প্রশংসিত হইয়াছে। কুমারী তরু ও অরুদত্তের পরে আর কোনও বাঙ্গালী রমণী ইংরাজি কবিতা রচনায় এরূপ কৃতিত্ব দেখাইতে পারেন নাই। ইনি আমেরিকায় গমন করিয়া Miss Mayoর “Mother India” নামক পুস্তকের প্রতিবাদ কল্পে ওজস্বিনী ভাষায় যে বক্তৃতা করিয়াছিলেন তাহা শুনিয়া আমেরিকার জন সাধারণ শতমুখে তাঁহাকে প্রশংসা করিয়াছিলেন।

 সাহিত্যবিজ্ঞান প্রভৃতি কলা বিদ্যায় এবং ধর্ম্মজগতে বাঙ্গালী জাতি যে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া আসিতেছেন, তাহা পাশ্চাত্য জগতের কাহারও অবিদিত নাই। কিন্তু সামরিক বিভাগে বাঙ্গালীর স্থান কোথায় তাহাই এখন বিচার করিতে হইবে।

 ইংরাজ ঐতিহাসিকগণ চিরদিনই বাঙ্গালীকে ভীরু ও কাপুরুষ নামে অভিহিত করিয়া আসিতেছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ লক্ষ্মণ সেনের পলায়ন-কাহিনী তাঁহারা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন। মনস্বী বঙ্কিমচন্দ্র “বাঙ্গলার কলঙ্কে” তাঁহার অখণ্ডনীয় যুক্তিদ্বারা এই কলঙ্ক দূর করিয়া গিয়াছেন।

 বাঙ্গালী কি সতাই ভীরু ও কাপুরুষ? বর্ত্তমানযুগের লব্ধপ্রতিষ্ঠ নাট্যকার ও স্বদেশপ্রেমিক দ্বিজেন্দ্রনাথ গাহিয়াছেন—

একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়,
একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত-সাগরময়,
সন্তান যার তিব্বত চীন জাপানে গড়িল উপনিবেশ,
তুই কি না মাগো তাদের জননী, তুই কি না মাগো তাদের দেশ?

 বাঙ্গালীবীর বিজয় সিংহ সাতশত অনুচর লইয়া জাহাজে চড়িয়া লঙ্কাদ্বীপে উপস্থিত হন, এবং এই মুষ্টিমেয় যোদ্ধার সাহায্যে লঙ্কা জয় করিয়া তথায় বাঙ্গালী জাতির জয়পতাকা উড্ডীন করেন। একথা ইতিহাস পাঠক সকলেই অবগত আছেন। বিজয়সিংহের নাম অনুসারে লঙ্কাদ্বীপের নাম সিংহল হইয়াছে।

 বঙ্গের যে সকল বীর সন্তান ভারতের বাহিরে গিয়া আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন, কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস তাঁহাদের অন্যতম। সুরেশচন্দ্র দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করেন নাই সত্য বটে, কিন্তু তিনি ১৭ বৎসর বয়সে স্বদেশ ও জন্মভূমি ত্যাগ করিয়া বিলাত যাত্রা করেন এবং বিলাতে নানা দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়া তিনি যে শক্তি সঞ্চয় করেন, তাহা সত্যই অদ্ভূত ও চমকপ্রদ। কুলি মজুরের কাজ হইতে ফেরিওয়ালার কাজ করিয়া অনেক সময় তিনি জীবিকা অর্জ্জন করিয়াছেন। পরিশেষে তিনি এক সার্কাসের দলে মিশিয়া আমেরিকা যাত্রা করেন। সামরিক বিভাগ বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শনের উপযুক্ত ক্ষেত্র মনে করিয়া তিনি ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে ব্রেজিল গভর্ণমেণ্টের অধীনে সাধারণ সৈনিকের পদ গ্রহণ করেন এবং ক্রমে কার্য্যদক্ষতাগুণে প্রথমতঃ কর্পোরাল, তৎপরে সার্জ্জেণ্ট, এবং পরিশেষে কর্ণেলের পদে উন্নীত হন। ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে ব্রেজিল প্রদেশে রাষ্ট্রবিপ্লব উপস্থিত হইলে বাঙ্গালীবীর সুরেশচন্দ্র সিংহবিক্রমে শত্রুদলকে বিধ্বস্ত করিয়াছিলেন। তাঁহার বীরত্বে সমগ্র বাঙ্গালী জাতি গৌরবান্বিত হইয়াছে।

 যখন বাহুবলের যুগ ছিল, তখন এই বাঙ্গালা দেশে প্রতাপাদিত্য, সীতারাম রায়, কেদার রায় প্রভৃতি বীর সন্তানগণ প্রচণ্ড মোগলশক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়া কিরূপে আপনাপন শৌর্য বীর্য্যের পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা ইতিহাস পাঠক মাত্রই অবগত আছেন। বিখ্যাত রাজপুত সেনাপতি অম্বররাজ মানসিংহ বঙ্গের বীর কেদার রায়কে যুদ্ধার্থে আহ্বান করিলে তিনি সদম্ভে উত্তর দিয়াছিলেন—

ভিনত্তি নিত্যং করিরাজ কুম্ভং,
বিভর্তি বেগং পবনাতিরেকং,
করোতি বাসং গিরিরাজ শৃঙ্গে,
তথাপি সিংহঃ পশুরেব নান্যঃ।

বঙ্গানুবাদ

করিরাজ পায় লাজ বিক্রমে যাহার,
পবনের বেগে যেই ছুটে অনিবার,
গিরি-শৃঙ্গে বাস করে সতত নির্ভয়,
তবু সিংহ পশু ভিন্ন অন্য কিছু নয়।

 পরিশেষে অত বড় রাজপুতবীর দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে কেদার রায়ের নিকটে পরাভূত হইয়াছিলেন। এই সকল বঙ্গবীরের কীর্ত্তিকথা ভারতের বাহিরে বিস্তৃত হয় নাই, কেবল এই কারণেই যে সকল পাঠক-পাঠিকা এই প্রসঙ্গকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করিবেন তাঁহাদের নিকটে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। কিন্তু বীরত্বের কাহিনী লিখিতে প্রবৃত্ত হইয়া এই সকল প্রাচীন বঙ্গবীরের কথা স্মৃতিপথে উদিত হওয়াও বিচিত্র নহে। সঙ্গে সঙ্গে ইংরাজ কবির “Full many a flower is born to blush unseen” নামক লাইনটি মনে হইয়া যদি দীর্ঘশ্বাস পতিত হয় তাহা হইলেও উপায় নাই। বঙ্গের এই সকল কৃতি সন্তানের কথা স্মরণ করিয়াই কবি ইন্দ্রনাথ তাঁহার “ভারত উদ্ধার” নামক ব্যঙ্গ কাব্যে পাঠকগণকে হাসাইতে হাসাইতে অশ্রুভারাক্রান্ত করিয়াছেন—

“কিন্তু রে কালের স্রোতে পারিজাত জিনি”,
অমূল্য কুসুম কত গিয়াছে ভাসিয়া,
দেখেছি নয়নে হায়, পারিনি ফিরাতে।

 এখন আর বাহুবলের যুগ নাই। এখন ‘সাবমেরিণ, ‘টরপেডো’ এবং বিমান বহরের যুগ। এই যুগে সুভাষচন্দ জন্মিয়াছেন। এ যুগে আণবিক বোমা (Atom Bomb) জগৎ ধ্বংস করিতে উদ্যত। এ হেন যুগে কর্ম্মবীর সুভাষচন্দ্র—বন্ধু-বান্ধবহীন সুভাষচন্দ্র স্বদেশ ও জন্মভূমি ত্যাগ করিয়া ভারতের বাহিরে সম্পূর্ণ অপরিচিতের দেশে গিয়া সামরিক শিক্ষা লাভ করিলেন, এবং ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ ও ‘ঝাঁসীর রাণী বাহিনীর’ ন্যায় দুর্দ্ধর্ষ সেনাবাহিনী গঠন করিয়া প্রচণ্ড মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন—ইহা কত বড় যোগ্যতার বিষয় চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ তাহার বিচার করিবেন। শুধু তাহাই নহে —এই নবগঠিত সেনাবাহিনীর সাহায্যে ভারতের একটা অংশ অধিকার করিয়া তাহার উপর জয়পতাকা উড্ডীন করিলেন, ইহা অপেক্ষা বিস্ময়ের বিষয় আর কি হইতে পারে? প্রয়োজনীয় অর্থ ও উপযুক্ত সমরোপকরণ প্রাপ্ত হইলে ভারতের ইতিহাস হয়ত অন্যরূপ ধারণ করিত।

  1. The race that has produced a jurist like Dr. Rash Behari Ghose, a poet like Rabindranath Tagore and a scientist like Jagadis Chandra Bose, is a race not to be belittled with.
  2. শিকাগো ধর্ম্মসভায় বক্তৃতা দিবার পরদিন তত্রত্য দৈনিক সংবাদ পত্রে লিখিত হইয়াছিল—Our President was wise enough to keep the best man for the last. After hearing him, we think, how foolish it is to send missionaries in those parts of India where a man like Vivekananda is born.
  3. Mr Ghosh’s writing is in no way inferior to that: of Jahn Morley or Mathew Arnold.
  4. ধর্ম্মতত্ত্ব সম্বন্ধে তিনি যে সকল অমূল্যগ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন তাহা পাঠ করিয়া বর্ত্তমান যুগের প্রসিদ্ধ চিন্তাশীল এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক রোঁমা রোলা বলিয়াছেন—“Here comes Aurobinda Ghosh, the completest synthesis that has been realised to this day of the genius of Asia and of the genius of Europe.
    —Romain Rolland.
  5. The Golden Threshold and The Bird of Time.