যোগাযোগ

উইকিসংকলন থেকে
যোগাযোগ

যােগাযােগ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়

২ বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রীট, কলিকাতা

প্রকাশক শ্রীপুলিনবিহারী সেন

বিশ্বভারতী, ৬৩ দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন, কলিকাতা

প্রকাশ আষাঢ় ১৩৩৬

পুনর্মুদ্রণ শ্রাবণ ১৩৪০, শ্রাবণ ১৩৫০

কার্তিক ১৩৫৩

মুদ্রাকর শ্রীদেবেন্দ্রনাথ বাগ

ব্রাহ্মমিশন প্রেস, ২১১ কর্নওআলিস স্ট্রীট, কলিকাতা

 যােগাযােগ

 ‘যোগাযোগ’ ১৩৩৬ সালের আষাঢ় মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

 ‘বিচিত্রা’ পত্রে ‘যোগাযোগ’ ধারাবাহিকভাবে (আশ্বিন ১৩৪৪—চৈত্র ১৩৩৫) প্রকাশিত হইয়াছিল। প্রথম দুই সংখ্যায় উপন্যাসটি ‘তিন পুরুষ’ নামে প্রকাশিত হইয়াছিল। তৃতীয় বারে কবি ইহার নাম পরিবর্তন করিয়া ‘যোগাযোগ’ নামকরণ করেন। এই উপলক্ষ্যে ‘বিচিত্রা’য় যে কৈফিয়ত প্রকাশিত হয় তাহা নিম্নে মুদ্রিত হইল।

নামান্তর

 ‘তিন পুরুষ’ নাম ধরে আমার যে-গল্পটা বিচিত্রায় বের হচ্ছে তার নাম রক্ষা করতেই হবে এমন কোনো দায় নেই। কাঁচা থাকতে থাকতেই ও-নামটা বদল করব বলে স্থির করেছি। পাঠক-দরবারে তার কারণ নির্দেশ করি।

 নবজাত কুমারকুমারীদের নাম দেবার জন্যে আমার কাছে অনুরোধ এসে থাকে, অবকাশমতো সে-অনুরোব পালন করেও এসেছি। কারণ এতে কোনো দায়িত্ব নেই। ব্যক্তিসম্বন্ধে মানুষের নাম তার বিশেষণ নয়, সম্বোধন মাত্র। লাউয়ের বোঁটা নিয়ে লাউয়ের বিচার কেউ করে না, ওটাতে ধরবার সুবিধে। যার নাম দিয়েছি সুশীল তার শীলতা নিয়ে আমার কোনো জবাবদিহি নেই। সুশীল-ঠিকানায় পত্র পাঠালে শব্দের সঙ্গে প্রয়োগের অসংগতিদোষ নিয়ে ডাকপেয়াদা কাগজে লেখালেখি করে না, ঠিক জায়গায় চিঠি পৌঁছয়।

 ব্যক্তিগত নাম ডাকবার জন্যে, বিষয়গত নাম স্বভাবনির্দেশের জন্যে। মানুষকেও যখন ব্যক্তি বলে দেখি নে, বিষয় বলে দেখি, তখন তার গুণ বা অবস্থা মিলিয়ে তার উপাধি দিই—কাউকে বলি বড়োবউ, কাউকে বলি মাস্টারমশায়।

 সাহিত্যে যখন নামকরণের লগ্ন আসে দ্বিধার মধ্যে পড়ি। সাহিত্যরচনার স্বভাবটা বিষয়গত না ব্যক্তিগত এইটে হল গোড়াকার তর্ক। বিজ্ঞানশাস্ত্রে বিষয়টাই সর্বেসর্বা, সেখানে গুণধর্মের পরিচয়ই একমাত্র পরিচয়। মনস্তত্ত্বঘটিত বইয়ের শিরোনামায় যখনি দেখব ‘স্ত্রীর সম্বন্ধে স্বামীর ঈর্ষা,’ বুঝব বিষয়টিকে ব্যাখ্যা-দ্বারাই নামটি সার্থক হবে। কিন্তু ‘ওথেলো’ নাটকের যদি এই নাম হত পছন্দ করতুম না। কেননা এখানে বিষয়টি প্রধান নয়, নাটকটিই প্রধান। অর্থাৎ আখ্যানবস্তু, রচনারীতি, চরিত্রচিত্র, ভাষা, ছন্দ, ব্যঞ্জনা, নাট্যরস, সবটা মিলিয়ে একটি সমগ্র বস্তু। একেই বলা চলে ব্যক্তিরূপ। বিষয়ের কাছ থেকে সংবাদ পাই, ব্যক্তির কাছ থেকে তার আত্মপ্রকাশজনিত রস পাই। বিষয়কে বিশেষণের দ্বারা মনে বাঁধি, ব্যক্তিকে সম্বোধনের দ্বারা মনে রাখি।

 এমন একটা-কিছু অবলম্বন করে গল্প লিখতে বসলুম, যাকে বলা যেতে পারে বিষয়। যদি মূর্তি গড়তেম একতাল মাটি নিয়ে বসতে হত। অতএব ওটাকে ‘মাটি’ শিরোনামায় নির্দেশ করলে বিজ্ঞানে বা তত্ত্বজ্ঞানে বাধত না। বিজ্ঞান যখন কুণ্ডলকে উপেক্ষা ক’রে তার সোনার তত্ত্ব আলোচনা করে তখন তাকে নমস্কার করি। কিন্তু কনের কুণ্ডল নিয়ে বর যখন সেই আলোচনাটাকেই প্রাধান্য দেয় তখন তাকে বলি বর্বর। রসশাস্ত্রে মূর্তিটা মাটির চেয়ে বেশি, গল্পটাও বিষয়ের চেয়ে বড়ো। এইজন্যে বিষয়টাকেই শিরোধার্য করে নিয়ে গল্পের নাম দিতে আমার মন যায় না। বস্তুত রসসৃষ্টিতে বৈষয়িকতাকে বড়ো জায়গা দেওয়া উচিত হয় না। যাঁরা বৈষয়িক প্রকৃতির পাঠক তাঁদের দাবির জোরে সাহিত্যরাজ্যে হাটের পত্তন হলে দুঃখের বিষয় ঘটে। হাটের মালিক বিষয়বুদ্ধিপ্রধান বিজ্ঞান।

 এদিকে সম্পাদক এসে বলেন, সংসারে নাম রূপ দুটোই অত্যাবশ্যক। আমি ভেবে দেখলুম, রূপের আমরা নাম দিই, বস্তুর দিই সংজ্ঞা। সন্দেশ যেখানে রূপ সেখানে তাকে বলি ‘অবাক চাকি’, যেখানে বস্তু সেখানে তাকে বলি মিষ্টান্ন। সম্পাদকমশায়ের সংজ্ঞা হচ্ছে ‘সম্পাদক’, এখানে অর্থ মিলিয়ে আদালতে হলফ করে বলতে পারি শব্দের সঙ্গে বিষয়ের ষোলো আনা মিল আছে। কিন্তু সেখানে তিনি বিষয় নন, রূপ—অর্থাৎ স্বতন্ত্র ও একমাত্র—সেখানে কোনো একটামাত্র সংজ্ঞা দিয়ে তাঁকে বাঁধা অসম্ভব। সেখানে তাঁর আছে নাম। সেই নামের সঙ্গে মিলিয়ে শত্রু মিত্র কেউ তাঁর যাচাই করে না। পিতামাতা যদি তাঁকে ‘সম্পাদক’ নামই দিতেন তবে নাম সার্থক করবার জন্য সম্পাদক হবার কোনো দরকারই তাঁর থাকত না।

 গল্প জিনিসটাও রূপ; ইংরেজিতে যাকে বলে ক্রিয়েশন। আমি তাই বলি, গল্পের এমন নাম দেওয়া উচিত নয় যেটা সংজ্ঞা, অর্থাৎ যেটাতে রূপের চেয়ে বস্তুটাই নির্দিষ্ট। বিষবৃক্ষ নামটাতে আমি আপত্তি করি। কৃষ্ণকান্তের উইল নামে দোষ নেই। কেননা ও-নামে গল্পের কোনো ব্যাখ্যাই করা হয় নি।

 সম্পাদকমশায় যখন গল্পের নামের জন্যে পেয়াদা পাঠালেন তাড়াতাড়ি তখন ‘তিন পুরুষ’ নামটা দিয়ে তাকে বিদায় করা গেল। তার পরক্ষণেই নামটা কাহিনীর আঁচলের সঙ্গে তার গ্রন্থিবন্ধন করে নিয়ে কানে কানে মুহূর্তে মুহূর্তে বলতে লাগল, যদেতৎ অর্থং মম তদস্তু রূপং তব। আমার সঙ্গে তোমাকে সম্পূর্ণ মিলে চলতে হবে। ছায়েবানুগতাস্বচ্ছা ইত্যাদি। কাহিনী বলে, তার মানে কী হল? নাম বলে, বাক্যে ভাবে আজ থেকে আমাকে সপ্রমাণ করে চলাই তোমার ধর্ম। কাহিনী বলে, রেজিস্টার বইয়ে কর্তার তাড়ায় সম্মতি সই করেছি বটে, কিন্তু আজ আমি হাজার হাজার পাঠকের সামনে দাঁড়িয়ে সেটা বেকবুল যেতে চাই।

 কর্তা বলেন, তিন পুরুষের তিন-তোরণ-ওআলা রাস্তা দিয়ে গল্পটা চলে আসবে এই আমার একটা খেয়ালমাত্র ছিল। এই চলাটা কিছুই প্রমাণ করবার জন্যে নয়, নিছক ভ্রমণ করবার জন্যেই। সুতরাং এই নামটা ত্যাগ করলে আমার গল্পের কোনাে স্বত্বের দলিল কাঁচবে না।

 অতএব সর্বসমক্ষে আমার গল্প আজ তার নাম খােয়াতে বসেছে। আমরা তিন সত্যের জোর মানি; বিচিত্রার পাতার নাম সম্বন্ধে দুইবার সত্যপাঠ হয়ে গেছে। তিনবারের বেলায় মুখ চাপা দেওয়া গেল।

 আর-একটা নাম ঠাউরেছি। সেটা এতই নির্বিশেষ যে গল্পমাত্রে নির্বিচারে খাটতে পারে। সরকারি জিনিসমাত্রেরই মতো সে নামে চমৎকারিতা নেই। নাই-বা রইল। জাপানে দেখেছি, তলােয়ারে ফলকটার উপরে কারিগর যখন তার কারুকলার আনন্দ ঢেলে দেয় খাপটাকে তখন নিতান্ত নিরলংকার করে রাখে। গল্প নিজেই নিজের পরিচয় দেবার সাহস রাখে যেন—নামটাকে যেন জোর গলায় আর আগে নকিবগিরি করতে না পাঠায়।

 ‘তিন পুরুষ’ নাম ঘুচিয়ে আমার গল্পের নাম দেওয়া গেল— ‘যােগাযােগ’।

—বিচিত্রা। অগ্রহায়ণ ১৩__
৪ অক্টোবর ১৯২৭ ‘কিন্তা’ জাহাজ। শ্যামের পথ

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র

 
 
 
 

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।