বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র

উইকিসংকলন থেকে

বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র

শ্রীপ্রফুল্লরঞ্জন বসু রায়বি, এ,

শ্রীশ্যামদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

 এম, এ, সাহিত্য ভারতী

বুক কেবিন

পুস্তক বিক্রেতা

৪নং, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট,

কলিকাতা।

বিদ্যাসাগর বুক ষ্টল,

৪১ শঙ্কর ঘােষ লেন, কলিকাতা হইতে
এল, সি, মুখার্জ্জি কর্ত্তৃক প্রকাশিত ও
শ্রীকালীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্ত্তৃক

সর্ব্বসত্ত্ব সংরক্ষিত।

প্রথম মুদ্রণ, ভাদ্র, ১৩৫৩
মূল্য সাড়ে তিন টাকা।

মুদ্রাকর শ্রীগৌরচন্দ্র প_
নিউ মহামায়া প্রেস
৬৫।৭ কলেজ ষ্ট্রীট, কলিকাতা

নব জীবনের সঙ্কটপথে
হে তুমি অগ্রগামী,
তােমার যাত্রা সীমা মানিবে না
কোথাও যাবে না থামি।
শিখরে শিখরে কেতন তােমার
রেখে যাবে নব নব
দুর্গম মাঝে পথ করি দিবে
জীবনের ব্রত তব।

—রবীন্দ্রনাথ

ভূমিকা

 আজাদ-হিন্দ ফৌজের কীর্ত্তি-কাহিনী প্রকাশিত হইবার সংগে সংগেই নেতাজীর সম্বন্ধে পুস্তক প্রকাশের হিড়িক পড়িয়া গেছে। অনেকেই নেতাজীর প্রতি জনসাধারণের অপরিসীম শ্রদ্ধা ও নেতাজীর জীবন-কথা জানিবার জন্য তাহাদের আকুল আগ্রহের সুযােগ লইয়া স্বল্পতম পরিশ্রমেই এই শ্রেষ্টতম মহাপুরুষের জীবন-কাহিনী জনসাধারণের সমক্ষে উপস্থাপিত করিতে চাহিয়াছেন। নব্য বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানের জীবন-কথা রচনায় বাঙ্গালী গ্রন্থকারদের এই মানসিক শৈথিল্য ও শ্রদ্ধার অভাব, বাজার দখলের জন্য প্রকাশক ও গ্রন্থকারদের এই অশােভন ক্ষিপ্রতা আমাদিগকে অত্যন্ত বেদনা দিয়াছে। নেতাজীর সম্বন্ধে এতাবৎ প্রকাশিত বহু পুস্তকই শিশু-সাহিত্যপদবাচ্য হইয়াছে ও প্রশস্তিবাচনমাত্রে পর্য্যবসিত হইয়াছে। ফলে, বাংলাভাষায় অদ্যাপি নেতাজীর পূর্বাপর চিন্তাধারা ও সাধনা-সম্বলিত একখানি নির্ভরযােগ্য পূর্ণাঙ্গ জীবন-চরিতের বিশেষ অভাব রহিয়াছে। এই বহু-অনুভূত অভাব পূরণের জন্য আমরা নেতাজীর জীবনী রচনায় প্রয়াসী হইয়াছি। নেতাজীর কর্মজীবনের সহিত ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন এমন কোন কৃতী সাহিত্যিক ও কর্মী এই কার্য্যের গুরু দায়িত্ব গ্রহণে অগ্রসর হইয়া আসিলেই প্রথম প্রচেষ্টা হিসাবে আমাদের শ্রম সার্থক মনে করিব।

 নেতাজী সুভাষচন্দ্রের পুণ্য কীর্ত্তিকথা আজ আসমুদ্রহিমাচল সমগ্র ভারতের পরম শ্রদ্ধা ও ধ্যানের সম্পদ হইয়াছে। তাঁহার বিমল যশােগাথায় সমস্ত দিঙ্‌মণ্ডল মুখরিত। ভারতের মুক্তিসাধনার সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তিনি বাঙ্গালীর আসন পুনরায় সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্রের প্রতি অবাঙ্গালী ভারতবাসী, হিন্দু-মুসলমান, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ— সকল জাতির সমরনায়কদের অকুণ্ঠ ও অপরিসীম শ্রদ্ধা, ভক্তি ও আনুগত্যদর্শনে প্রত্যেক বাঙ্গালীই আজ গর্ব অনুভব করিতেছে। পরাধীন ভারতের মুক্তিপ্রচেষ্টায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র একাধারে গ্যারিবল্ডী, ওয়াশিংটন, লেনিন ও ডি, ভ্যালেরার স্থান অধিকার করিয়াছেন। এই বিশ্ব-বিশ্রুতকীর্ত্তি মহামানব বাঙ্গালী তথা ভারতবাসীকে বিশ্বজনসভায় অপূর্ব মহিমা ও প্রতিষ্ঠার আসন দান করিয়াছেন।

 বিগত শতকে বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে যে বিরাট জাগরণ ঘটিয়াছিল, জাতীয় জীবনের সর্বাবয়ব স্ফূর্ত্তি ও বিকাশের যে উৎসাহ ও উৎসবের সূচনা হইয়াছিল, যাহার ফলে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন প্রমুখ মনীষী ও কর্মবীরগণ ভারতীয় সংস্কৃতি ও চিন্তাধারায় অবিনশ্বর কীর্ত্তি স্থাপন করিয়া গিয়াছেন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র সেই জাগরণকালের বাঙ্গালীপ্রধানদের সাধনারই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যবাহী শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী সন্তান। রাষ্ট্রীয় সাধনার ক্ষেত্রে বাঙ্গালী যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যোজ্জ্বল প্রাণশক্তির পরিচয় দিয়া আসিয়াছে, নেতাজীর সাধনায়ও আমরা বাঙ্গালীর সেই স্বধর্মের পূর্ণ বিকাশই দেখিতে পাই।

 সম্প্রতি কয়েক বৎসর যাবৎ এক ভয়াবহ জাতীয় দৌর্ব্বল্য বাঙ্গালীর জীবনে কৃষ্ণমেঘের সঞ্চার করিয়াছে। মহাজাতি গঠনের ভিত্তি সুদৃঢ় করিতে হইলে যে গণবুদ্ধি ও গণশক্তির অপরিহার্য্য প্রয়োজন বাঙ্গালীর জীবনে তাহার শোচনীয় অভাব দেখা গিয়াছে। বাঙ্গালীর চারিত্রিক দৃঢ়তা অপেক্ষা ভাবাবেগবিহ্বলতাই সমধিক—ইহারই ফলে বাঙ্গালী দীর্ঘকাল একাসনে কোন আদর্শের সাধনায় নিমগ্ন থাকিতে পারে নাই। বাঙ্গালী চরিত্রবলে ও কর্ম্মক্ষমতায় যেমন দুর্বল, মেধা ও মননশীলতায় তেমনই শক্তিমান—বাঙ্গালী কর্মজগতে যেমন অপটু, ভাবজগতে তেমনই কল্পনাকুশল। ইহারই ফলে বাঙ্গালী ব্যক্তিজীবনে ব্যক্তিত্বসাধনার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিলেও সমষ্টিজীবনে, জাতীয়সাধনার ক্ষেত্রে তেমন সার্থকতা ও গৌরব অর্জন করিতে পারে নাই।

 এই দুর্গতির গাঢ় তমিস্রা ভেদ করিয়া নেতাজী জাতির সম্মুখে বিপুল আশা ও সম্ভাবনার আলোকবর্ত্তিকা হস্তে উপস্থিত হইয়াছেন। বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভ্রান্ত দৃষ্টি ও মৃত্যুঞ্জয় পৌরুষই সুভাষচন্দ্রকে বাঙ্গালী জাতির দেশনায়কের যোগ্যতা দান করিয়াছে। তাই বাঙ্গালীর জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রকে দেশনায়কের পদে বরণ করিয়া বলিয়াছেন— “নিজেদের মধ্যে দেখা দিয়েছে দুর্বলতা, বাইরে একত্র হয়েছে বিরুদ্ধশক্তি। আমাদের অর্থনীতিতে, কর্মনীতিতে, শ্রেয়োনীতিতে প্রকাশ পেয়েছে নানা ছিদ্র; আমাদের রাষ্ট্রনীতিতে হালে দাঁড়ে তালের মিল নেই। দুর্ভাগ্য যাদের বুদ্ধিকে অধিকার করে জীর্ণদেহে রোগের মতো, তাদের পেয়ে বসে ভেদবুদ্ধি·····এই রকম দুঃসময়ে একান্তই চাই এমন আত্মপ্রতিষ্ঠ শক্তিমান পুরুষের দক্ষিণ হস্ত, যিনি জয়যাত্রার পথে প্রতিকূল ভাগ্যকে তেজের সংগে উপেক্ষা কর্‌তে পারেন। সুভাষচন্দ্র, তোমার রাষ্ট্রিক সাধনার আরম্ভক্ষণে তোমাকে দূর থেকে দেখেছি····বহু অভিজ্ঞতাকে আত্মসাৎ করেছে তোমার জীবন। কর্ত্তব্যক্ষেত্রে দেখলুম তোমার যে পরিণতি তার থেকে পেয়েছি তোমার প্রবল জীবনীশক্তির প্রমাণ। তোমার এই চারিত্রশক্তিকেই বাঙ্গলাদেশের অন্তরের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেবার প্রয়োজন সকলের চেয়ে গুরুতর। নানা কারণে আত্মীয় ও পরের হাতে বাংলাদেশ যত কিছু সুযোগ থেকে বঞ্চিত ভাগ্যের সেই বিড়ম্বনাকেই সে আপন পৌরুষের আকর্ষণে ভাগ্যের আশীর্ব্বাদে পরিণত করে তুলবে, এই চাই।······হিংস্র দুঃসময়ের পিঠের উপরে চড়েই বিভীষিকার পথ উত্তীর্ণ হোতে হবে। এই দুঃসাহসিক অভিযানে উৎসাহ দিতে পার্‌বে তুমি, এই আশা করে তোমাকে আমাদের যাত্রনেতার পদে আহ্বান করি।”

 মহানায়কের যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রবীন্দ্রনাথ অন্তর্দৃষ্টিবলে সুভাষচন্দ্রের সাধনায় দেখিতে পাইয়াছিলেন, রবীন্দ্রনাথের সেই আশা ব্যর্থ হয় নাই। নেতাজীর চারিত্রিক দৃঢ়তা, নৈতিকশুচিতা, সংগঠনপ্রতিভা ও শৃঙ্খলানৈপুণ্য আজাদ-হিন্দ-ফৌজ গঠন ও আজাদ-হিন্দ-গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠায় চরম পরিণতি লাভ করিয়াছে।

 এই পশুবৎ-নিগৃহীত, ধূলি-লুণ্ঠিত, আত্মচৈতন্যহীন ভারতীয় জনগণের সীমাহীন দুর্দ্দশাদর্শনে দেশপ্রেমের জীবন্তবিগ্রহ সুভাষচন্দ্রের হৃদয় গভীর মমতায় ও অপরিমেয় অনুকম্পায় আপ্লুত হইয়াছিল—সমগ্র জাতির মুক্তি-পিপাসা তাঁহার অন্তরতম চেতনাকে অধিকার করিয়া এক দুর্বার আকুলতায় রূপ গ্রহণ করিয়াছে। মুক্তিসংগ্রামের নবজীবনযজ্ঞের উদ্গাতা নেতাজীর আহ্বানে তাই জাতিধর্মনির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিবিবর্জ্জিত হইয়া মুক্তিপতাকাতলে সমবেত হইয়াছিল।

 আজ আমরা স্বাধীনতার তোরণদ্বারে উপস্থিত হইয়াছি। দীর্ঘ দুইশত বৎসরের পরাধীনতার তমিস্রা সন্তরণ করিয়া স্বাধীনতাসূর্য্যের উদয়ালোকের অভ্রান্ত পদক্ষেপ আমরা শুনিতে পাইতেছি। জাতির এই নবজন্মক্ষণে মহামানব নেতাজী সুভাষচন্দ্রের তপঃশক্তি, সাধনা ও কর্মের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হইয়া বাঙ্গালী তাহার জাতীয়জীবনের, সমষ্টি-জীবনের সমস্ত আবিলতা ও দুর্বলতা দূর করিয়া মহাজাতিসৌধের ভিত্তি সুদৃঢ় করিয়া গড়িয়া তুলিবে—সমস্ত বাঙ্গালীরই এই আকুল কামনা। “ভারতবর্ষের রাষ্ট্রমিলনযজ্ঞে বাংলার সাধনা, আত্মাহতি ষোড়শোপচারে সত্য হোক, ওজস্বী হোক, বাংলার আপন বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল হইয়া উঠুক”—রবীন্দ্রনাথের এই আকুতি বিফল হইবে না। তাই নেতাজীর পুনরাবির্ভাবের জন্য সমগ্র বাঙ্গালী অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করিয়া আছে।

 এই গ্রন্থরচনায় হিতৈষী বন্ধু স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আমাদিগকে নানাভাবে সাহায্য করিয়াছেন এবং প্রয়োজনবোধে যে সকল গ্রন্থকর্ত্তা ও প্রকাশকের সহায্য গ্রহণ করিয়াছি তাহাদের সকলকেই আজ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করিতেছি।

 এই গ্রন্থের মূল পরিকল্পনাটির জন্য আমরা বন্ধুবর শ্রীপ্রদ্যোৎচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নিকট ঋণী। তিনি অযাচিতভাবে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করিয়া দিয়া আমাদিগের অশেষ ধন্যবাদভাজন হইয়াছেন।

 যে সকল গ্রন্থ ও সাময়িক পত্রের সাহায্য লওয়া হইয়াছে স্থানাভাববশতঃ তাহাদের সকলের নামের বিস্তৃত তালিকা দেওয়া সম্ভব হইল না। পরিশিষ্ট রচনায় বহুল পরিমাণে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সাহায্য লইয়াছি।

 শ্রীহরিমঙ্গল মালাকার, শ্রীননীগোপাল মজুমদার ও শ্রীগৌরাঙ্গ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রুফ-দেখা ও অনুলিপির কাজে বিশেষ সহায়তা করিয়াছেন।

 বিশেষ চেষ্টা সত্ত্বেও ছাপার ভুল রহিয়া গেছে।

 বইটি সুখপাঠ্য ও তথ্যপূর্ণ করিতে চেষ্টার ত্রুটি করি নাই। আমাদের উদ্যম কতটা সার্থক হইয়াছে। সহৃদয় পাঠকবর্গ তাহা বিচার করিবেন।

 বাঙ্গালার রাষ্ট্রীয় সাধনার মেরু-চূড়া সুভাষচন্দ্রের জীবন আলেখ্যচিত্রণে নিরত থাকিয়া মহাপুরুষ-সঙ্গলাভে এতদিন নিজেদের ধন্য মনে করিয়াছি। আজ তাই গ্রন্থসমাপ্তি-মুহূর্ত্তে মহাপুরুষের পবিত্রসঙ্গ-বিচ্ছেদ-বেদনা অনুভব করিতেছি।

২১০৪, কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীট
কলিকাতা।
জন্মাষ্টমী, ১৩৫৩।

গ্রন্থকার

সূচিপত্র।

বিষয় পৃষ্ঠা
১।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
২।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৩।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১০১৬
৪।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১৬১৯
৫।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
২০২২
৬।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
২৩২৪
৭-১০।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
২৫২৯
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৩০৩৬
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৩৭৪৬
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৪৭৫৭
১১-১৩।
স্বাধীন রাজনীতিক জীবন
দেশবন্ধুর স্থানে বাংলার নেতৃত্বপদে সুভাষচন্দ্র—জাতীয় মহাসভার মাদ্রাজ অধিবেশন—নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় মহাসমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদে—কলিকাতা কংগ্রেস—স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অধিনায়কত্ব—নেহেরু কমিটির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা—গান্ধী-নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত—স্বাধীনতা সঙ্ঘ—নিখিল ভারত যুবসঙ্ঘ—হিন্দুস্থান সেবাদল সম্মেলন—নিখিল ভারত লাঞ্ছিত রাজনৈতিক কর্মীদিবস।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৫৮-৬৭
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৬৮-৭৬
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৭৬-৮৪
১৪-১৫।
ইউরোপ প্রবাসে
বহির্দ্দেশে কংগ্রেসের দূত—বহির্জাগতিক প্রচার—বিঠলভাই প্যাটেলের সহিত সাক্ষাৎ—গান্ধীজী কর্ত্তৃক আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহারের প্রতিবাদ—অষ্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ইটালী ও বল্কান রাজ্য সমূহ পরিভ্রমণ—সাম্যবাদ সঙ্ঘ—পিতৃবিয়োগ ও দেশে প্রত্যাবর্ত্তন—পুনরায় বিলাত যাত্রা—‘ইণ্ডিয়ান স্ট্রাগল’—আয়রল্যাণ্ড পরিদর্শন—ডি, ভ্যালেরার সহিত সাক্ষাৎকার ও সৌহার্দ্দ্য।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৮৫-৯৬
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৯৬-৯৯
১৬-২৫।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১০০-১১৮
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১১৮-১২৬
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১২৬-১২৮
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১২৯-১৩২
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১৩২-১৩৫
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১৩৬-১৪১
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১৪২-১৫৩
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১৫৪-১৬২
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১৬৩-১৬৭
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১৬৭-১৭৬
২৬।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১৭৭-১৯৬
২৭-২৯।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
১৯৬-২১০
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
২১০-২২০
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
২২১-২২৭
৩০।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
২২৭-২৩১
৩১।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
২৩১-২৫০
৩২-৩৩।
মুক্তিনায়ক বিপ্লবী নেতাজী
আজাদ হিন্দ ফৌজের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গী।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
২৫১-২৭৭
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
২৭৮-৩০১
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৩০৩-৩০৯
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৩১০-৩২৩
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৩২৪-৩২৭
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৩২৮-৩৩২
 
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          
৩৩৩-৩৩৬

প্রস্তাবনা

 ১৯২৮ সালের কলিকাতা কংগ্রেস। কলিকাতাবাসী এরূপ দৃশ্য পূর্ব্বে কখনও প্রত্যক্ষ করে নাই। কংগ্রেস অধিবেশন সম্পর্কে এত উৎসাহ, এত উদ্দীপনা, এত সমারোহ আর কোনদিন হইয়াছে কিনা সন্দেহ। রাষ্ট্রপতি পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু হাওড়া স্টেশনে ট্রেণ হইতে অবতরণ করিলেন। ষ্টেশনের বাহিরে বিপুল জনতা—লক্ষ লক্ষ নরনারী, আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই দেশ-নায়ককে সম্বর্দ্ধনা জানাইতে আসিয়াছে। রাষ্ট্রপতির শোভাযাত্রার জন্য রাজকীয় ব্যবস্থা হইয়াছে। বিংশতি অশ্ববাহিত শকটে সভাপতি অধিবেশন মণ্ডপের দিকে চলিলেন। অগণিত নর-নারী শোভাযাত্রার অনুগমন করিতেছে। এরূপ বিরাট শোভাযাত্রা কংগ্রেসের ইতিহাসে অভূতপূর্ব্ব। শোভাযাত্রা কংগ্রেস মণ্ডপের দিকে চলিল। মণ্ডপের নিকট বিরাট প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হইয়াছে। বিশাল সভামণ্ডপে অধিবেশনের প্রতিনিধি এবং দর্শকদের বসিবার আসন নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। পণ্ডিত মতিলালকে লইয়া শোভাযাত্রা অধিবেশন মণ্ডপে উপস্থিত হইল। কিন্তু এই অপূর্ব্ব শোভাযাত্রাকেও যেন ম্লান করিয়া দিল পতাকা উত্তোলনের উৎসবে সামরিক কুচকাওয়াজ। কংগ্রেস অধিবেশন সম্পর্কে সহস্র সহস্র বাঙালী যুবক স্বেচ্ছাসেবকদলভুক্ত হইয়াছিলেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে অতি আড়ম্বরের সহিত নিখুঁতভাবে সামরিক কুচকাওয়াজ শিক্ষা দেওয়া হইয়াছিল। পণ্ডিত মতিলাল অগ্রসর হইয়া জাতীয় পতাকা উত্তোলন করিতেই আরম্ভ হইল অভিবাদন কুচ। দলে দলে স্বেচ্ছাসেবকগণ পতাকাকে অভিবাদন করিয়া ‘মার্চ’ করিয়া চলিয়াছে। পতাকার তলে কংগ্রেস সভাপতি পণ্ডিত মতিলাল খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবি পরিয়া সামরিক কায়দায় অভিবাদনের ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া। দক্ষিণ পার্শ্বে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন। সম্মুখে স্বেচ্ছাসেবকেরা ‘মার্চ’ করিয়া চলিয়াছে। সকলের পরিধানে খাকী খদ্দরের সামরিক পরিচ্ছদ—পায়ে সামরিক বুট। আকারে-প্রকারে, গঠন-প্রকরণে, শিক্ষায় ও সজ্জায়, কায়দায় ও ভঙ্গিতে সকলই পূর্ণাঙ্গ সামরিক বাহিনীর সমতুল্য। দলের পর দল নিখুঁত পদক্ষেপে চলিয়াছে। সমরবাদ্য তালে তালে বাজিতেছে। পদাতিক বাহিনী চলিয়া গেল—অশ্বারোহী বাহিনী চলিল। অশ্বারোহী বাহিনীর পরে মোটর-সাইকেল বাহিনী চলিল। কোন পরাধীন দেশে জাতীয় পতাকাতলে এত বিরাট, এত নিখুঁত এবং অপূর্ব্ব সামরিক কুচ হইয়াছে কিনা সন্দেহ। আড়ম্বর, উদ্দীপনা ও সংগঠনে ইহা ভারতের ইতিহাসে অতুলনীয়।

 সেইদিন পণ্ডিত মতিলালের বামপার্শ্বে দাঁড়াইয়া এক বলিষ্ঠদেহ, উন্নতকায় সৌম্যদর্শন যুবকও স্বেচ্ছাসেবকদের সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই যুবক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অধিনায়ক। এই অপূর্ব্ব শোভাযাত্রা, বিপুল সংগঠন, সামরিক শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্ত্তিতার মূলে ছিল তাঁহার অক্লান্ত চেষ্টা, অদম্য উৎসাহ ও অদ্ভুত কর্ম্মক্ষমতা। এই যুবকের আপাদমস্তক সামরিক বেশভূষায় আচ্ছাদিত ছিল। তাঁহার সেদিনের সেই সমরনায়কের বেশ, তেজোব্যঞ্জক রূপ বাঙ্গালার তরুণের মানসপটে আপন গর্ব্ব-গৌরবে, আপনার মহিমায় আজিও অপরিম্লান ভাবে অঙ্কিত রহিয়াছে। হয়ত সেদিন সমর-শোভাযাত্রা পরিদর্শনকালে সেই যুবকের মানস-নয়নে এক অনুপম স্বপ্নচ্ছবি ভাসিয়া উঠিয়াছিল। হয়ত তিনি ভাবিতেছিলেন, একদিন আসিবে যেদিন এমনিভাবে জাতীয় পতাকাতলে সহস্র সহস্র ভারতবাসী মুক্তিফৌজ গঠন করিবে—আয়র্ল্যাণ্ডের মত ভারতের ও জাতীয় বাহিনী গড়িয়া উঠিবে। জাতিধর্ম্মনির্ব্বিশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মাহুতিদানের জন্য সকলে যোদ্ধৃবেশ ধারণ করিবে।

 সেদিন কেহ ভাবে নাই যে এই যুবকের স্বপ্ন একদিন বাস্তবে মহনীয় রূপ পরিগ্রহ করিবে—তাঁহারই সংগঠনের যাদুমন্ত্রবলে চালিত হইয়া লক্ষ লক্ষ ভারতীয় তাঁহারই নেতৃত্বে স্বদেশের হৃত স্বাধীনতার পুনরুদ্ধারকল্পে জাতীয় পতাকাতলে অস্ত্র ধারণ করিবে—সেদিন কংগ্রেসের অধিবেশন সংশ্লিষ্ট শোভাযাত্রা ও স্বেচ্ছাসেবক-বাহিনীর আয়োজনে যে মহতী সম্ভাবনার অঙ্কুরোদ্গম হইয়াছিল তাহাই একদিন পত্র-পুষ্প-সুশোভিত হইয়া মহা-মহীরুহে পরিণত হইবে। উত্তরকালে এই যুবক ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোনের ইতিহাসে সম্পূর্ণ এক অভিনব অধ্যায় রচনা করিয়াছেন। ইনিই আজাদ হিন্দ্ ফৌজের সর্ব্বাধিনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। যে সংগঠনশক্তি আজ সমগ্র বিশ্বে বিস্ময়ের সৃষ্টি করিয়াছে তাহার অঙ্কুর আমরা দেখিতে পাই ১৯২৮ সালের কলিকাতা কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর গঠনে ও শোভাযাত্রায়। কলিকাতায় স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ ও শিক্ষাদানের কাজে তাঁহার যে সংগঠনশক্তি ও কর্ম্মক্ষমতার পরিচয় পাওয়া গিয়াছিল, কালক্রমে তাহাই পূর্ণ বিকশিত হইয়া তাঁহাকে আজাদ হিন্দ্ ফৌজের সংগঠক-নেতা ও রণদক্ষ সর্ব্বাধিনায়ক করিয়া তুলিয়াছে। সেদিনের সমর শোভাযাত্রা অনেকেরই ঈর্ষ্যা ও বিদ্রূপের কারণ হইয়াছিল। অনেকেই তাঁহার প্রতি ব্যঙ্গ ও কটূক্তি করিতে ছাড়ে নাই। শত শত বৎসরের পরপদানত, শৃঙ্খলিত, নিরস্ত্র ও নিঃসহায়, মহাত্মা গান্ধীর অহিংসামন্ত্রে দীক্ষিত ভারতবাসী যে সশস্ত্র সৈন্য বাহিনী গঠন করিয়া প্রত্যক্ষ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইতে পারে ইহা সেদিন স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।

 সেদিন সুভাষচন্দ্রের অন্তরে চিরজ্বলন্ত বহ্নির এই অভূতপূর্ব্ব প্রকাশকে ক্ষণস্থায়ী আলেয়ার দীপ্তি ভাবিয়া প্রবীণের দল অবিশ্বাস ও শ্লেষের হাসি হাসিয়াছিলেন। অহিংসামন্ত্রে দীক্ষিত কংগ্রেসের অধিবেশনে অনুষ্ঠিত এই রীতিমত সহিংস সামরিক কুচকাওয়াজকে ভাবালুতাপ্রসূত অবাস্তব কল্পনা জ্ঞানে গান্ধীজীও সার্কাসের অভিনয়ের সহিত তুলনা করিতে তিলমাত্র দ্বিধাবোেধ করেন নাই। বহুদিন পর্য্যন্ত যাহারা ব্যঙ্গভরে সুভাষচন্দ্রকে “জেনারেল অফিসার কমাণ্ডিং”এর সংক্ষেপিতরূপ ‘গক’ (G. O. C.) আখ্যায় আখ্যাত করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়াছিলেন, আজ তাঁহারাও বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গিয়াছেন। শৃঙ্খলিত ও পর-পদানত মাতৃভূমির বন্ধনমুক্তির অত্যুগ্র কামনাই এই অসম্ভবকে সম্ভব করিয়াছে। সেদিন যাঁহারা উপেক্ষাভরে বক্রকটাক্ষ করিয়াছিলেন আজ সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাঁহাদের মস্তক আপনা হইতেই শ্রদ্ধানত হইয়া আসিবে। স্বদেশের মুখােজ্জ্বলকারী, সার্থকজন্মা বাঙলার এই বীর সন্তানের অপরিমেয় শৌর্য্য ও মনােবল, অভাবনীয় রণচাতুর্য্য ও সংগঠনশক্তি পশ্চিমের ধুরন্ধর সমরনায়কদেরও ঈর্ষ্যার বস্তু হইয়াছে।

 আজ সমগ্র বাংলা তথা ভারতের অধিবাসী অন্তরের মণিকোঠায় পরমশ্রদ্ধাভরে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার ধ্যান করিতেছে। সুভাষচন্দ্রের অমরস্মৃতি ভারতবাসীর জপমালা হইয়াছে। এই বজ্রকঠোর ও কুসুমকোমল কর্ম্মবীরের পূত জীবন-কাহিনী জানিবার আকাঙ্ক্ষা সকলের হৃদয়েই অত্যুগ্র হইয়া উঠিয়াছে। দেশবাসীর এই আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্তির জন্যই আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।


এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত বলে অনুমান করা হচ্ছে কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।

বিঃদ্রঃ এই লেখা/রচনা/বইয়ের লেখকের মৃত্যুসাল কোনও তথ্যসূত্র দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। ভবিষ্যতে কোনো তথ্যসূত্র দ্বারা লেখকের মৃত্যুসাল সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে এলে, এই লেখকের রচনার প্রকৃত কপিরাইট অবস্থা যাচাই করা সম্ভব হবে। নতুন তথ্য অনুসারে এই বইটির কপিরাইট অবস্থা ভবিষ্যতে বিচার করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।